২৮ মার্চ ২০২২ বৃটিশ হাইকমিশনার এবং বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত বৃটিশ এম পি রওশন আরা’ র সাথে লাঞ্চ করার সুযোগ হয়েছিল। তারিখ মনে রাখার কৃতিত্ব আমার নয়, আই ফোনের। সেই সময়ে তোলা ছবি দেখতে গিয়ে তারিখটা পেয়ে যাই। সেদিন আলোচনায় রোহিঙ্গা বিষয়টি মূলত আলোচনায় প্রাধান্য পাচ্ছিল। সেই আলোচনার সময় স্পষ্ট করে উল্লেখ করেছিলাম রোহিঙ্গা এবং রাখাইনদের মাঝে যে সাম্প্রদায়িক এবং ধর্মীয় সম্প্রীতি বিদ্যমান ছিল তা নষ্টে মূলত বৃটিশরাই দায়ী। এবং এটা করা হয়েছে ১৯৪২ সালে দ্বিতীয় বিশ্ব–যুদ্ধ চলাকালীন সময়ে। বৃটিশরা আরাকান পর্ব্বতমালা ধরে যখন ইম্পল কোহিমা’র লক্ষ্যস্থলের দিকে অগ্রসর হচ্ছিল তখন রোহিঙ্গাদের রাখাইন এবং জাপানিজদের বিরুদ্ধে ব্যবহার করে। বলাবাহুল্য রোহিঙ্গারা ধর্মীয় দিক থেকে মুসলমান আর রাখাইনরা বৌদ্ধ ধর্মাবলম্বী। ভারতীয় উপ–মহাদেশে হিন্দু–মুসলমান ডিভাইড এন্ড রুল কৌশলে বৃটিশরা যেমন তাদের শাসন ব্যবস্থা বজায় রেখেছিল। আরাকানেও তারা রাখাইন–রোহিঙ্গা’য় বিভক্ত করে তাদের যুদ্ধের রসদ নিঃশ্চিত করেছিল। যুদ্ধের এক পর্যায়ে বৃটিশরা পিছু হটলে রাখাইন এবং জাপানিজদের হাতে লক্ষাধিক রোহিঙ্গা হত্যাকাণ্ডের শিকারে পরিনত হয়। বলাবাহুল্য রোহিঙ্গা – রাখাইন সে বিভক্তি এখনও বিদ্যমান। এ প্রসঙ্গ টেনে আমি বৃটিশ হাইকশিনারকে উদ্দেশ্য করি বলি ‘ইউক্রেন যুদ্ধে আপনারা এখন একজন কমেডিয়ানকে নাচিয়ে যাচ্ছেন, তার দেশ ধ্বংস হয়ে যাচ্ছে অথচ সেদিকে তার কোন ভ্রুক্ষেপ নাই’। রওশন আরা এম পি আমাকে বলেন ‘আপনার মন্তব্য খুবই তির্যক এবং কড়া’। সে আলোচনা এখানেই থাক।
এবার ফিরে আসি প্রসঙ্গে, মিউনিখ নিরাপত্তা সম্মেলনে বিশ্বের তাবৎ নেতারা হাজির। ১৫ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ঐ সব সামরিক এবং বেসামরিক নেতাদের সামনে রেখে সদ্য নির্বাচিত মার্কিন ভাইস প্রেসিডেন্ট জে ডি ভ্যান্স হুইসেল ব্লোয়ারের কাজটি করেন। তার বক্তব্যে তিনি বিশ্বের নানা প্রান্তের নানা উদ্বেগ উপর্সগের জন্য রাশিয়া ইরান বা চীনের দিকে আঙ্গুলি না তুলে সরাসরি ইউরোপের বিভিন্ন দেশের বিশেষ করে র্জামানি, যুক্তরাজ্য, সুইডেন, রুমানিয়া, বেলজিয়াম ইত্যাদি দেশের নাম উল্লেখ করে নানা অভিযোগ উত্থাপন করেন। তিনি ইউরোপে গণতান্ত্রিক মূল্যবোধের নানা অবক্ষয় অসঙ্গতির কথা তুলে ধরেন। তার বক্তব্যের এক পর্যায়ে তিনি ইউরোপিয়দের তাদের নিরাপত্তা নিশ্চিতে আরো বেশি সক্ষম এবং সংগঠিত হওয়ার বিষয়টি তুলে ধরেন। এই থেকে শুরু।
ইউক্রেন বা ইউরোপিয়দের বাদ দিয়ে সৌদি আরবের রিয়াদে রাশিয়া–আমেরিকার ইউক্রেন শান্তি আলোচনা। এর প্রতিক্রিয়ায় দ্রুততম সময়ে ফরাসী রাজধানী প্যারিসে ইউরোপিয় নেতাদের করনীয় নিয়ে আলোচনা বৈঠক। বৈঠকে ইউক্রেন বা ইউরোপিয়দের বাদ যাওয়ার সমালোচনার উত্তরে মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প অনেকটা কটাক্ষের সুরে বলেন বিগত তিন বছর ইউক্রেন বা ইউরোপ যুদ্ধ বন্ধের আলোচনা করেনি কেন? তিনি তার পূর্বসুরি জো বাইডেনের ইউক্রেন যুদ্ধ বন্ধে কোন ভূমিকা না রাখার বিষয় উল্লেখ করে বলেন ‘এটা অত্যন্ত পরিতাপের, অত্যন্ত বেদনার, অনেকটা হৃদয়বিদারক। এটা অনেক আগে শুরু হওয়া উচিত ছিল, তা হলে হাজার হাজার সৈন্য বাড়িঘর, সাধারণ মানুষ এ যুদ্ধের অভিশাপ থেকে বেঁচে যেত। আমার কাছে রাশিয়ান বা ইউক্রেনিয়ান সবাই মানুষ। এ যুদ্ধ আগে বন্ধ হলে আজ ইউক্রেনের মারিও পোল, ধনবাস সহ বিপুল পরিমাণ ভূমি রাশিয়ার কবলে পড়তে হত না। ট্রাম্প প্রশ্্ন তোলেন ইউক্রেন এ যুদ্ধ শুরু করতে গেল কেন?”
প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ইউক্রেন যুদ্ধের ব্যয়ভার নিয়েও প্রশ্ন তোলেন। তার বক্তব্য ইউরোপ যেখানে এ যুদ্ধে ১০০ বিলিয়ন ডলার ব্যয় করেছে সেখানে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র ৩০০ বিলিয়ন ডলারের বেশি ব্যয় করেছে। এ ব্যয়ে সামঞ্জস্য থাকা উচিৎ ছিল। তিনি প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ করেন ‘আমি ব্যক্তিগতভাবে জেলেনেস্কিকে পছন্দ করি তবে তাতে কিছু আসে যায় না, প্রেসিডেন্ট হিসাবে সে চূড়ান্তভাবে অযোগ্য’।
বেদনার বা পরিহাসের বিষয় হল এখন মার্কিন প্রেসিডেন্ট ইউক্রেন যুদ্ধে ব্যয়িত বিপুল অর্থের পরিবর্তে সেদেশের খনিজ সম্পদের পঞ্চাশ শতাংশের উপর দখল দাবী করছে। এব্যাপারে ইউক্রেনীয় প্রেসিডেন্ট জেলেনেস্কি পড়ে গেছেন মহা ফেস্যাদে আর রাশিয়া – আমেরিকা ইউরোপকে বাদ দিয়ে রিয়াদে সরাসরি আলোচনায় বসাতে ইউরোপ পড়ে গেছে একেবারে বেকায়দায়।
এখন ডোনাল্ড ট্রাম্প যুদ্ধে জড়ানোর যে দোষারোপের আঙ্গুল ইউক্রেনের দিকে তুলছেন সেটি কি সঠিক? এ ব্যাপারে কলম্বিয়া বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রফেসর জেফরি স্যাকস এর বয়ান হল ইউক্রেন যুদ্ধের দায় ইউক্রেন বা ইউরোপের নয় বরং আমেরিকার। তার ভাষ্য মতে ইউক্রেন যুদ্ধের বীজ বপন করা হয় ১৯৯০ সালের ৯ ফেব্রুয়ারি। সেদিন রাশিয়ার তৎকালীন প্রেসিডেন্ট গর্ভাচেব’কে আমেরিকার সেক্রেটারী অব স্টেট জেমস বেকার ওয়াদা করেছিলেন রাশিয়া যদি জামার্নীর পুনঃএকত্রিকরণে সম্মত হয় তবে ন্যাটো তার সম্প্রসারলে একপাও আর পূর্ব দিকে আগাবে না। সে ভরসায় রাশিয়া তার সামরিক জোট ‘ওয়ারশ’ বিলুপ্ত করে। পরবর্তীতে আমেরিকানরা তাদের দেওয়া ওয়াদা রাখেনি। ন্যাটো রয়ে যায়, আমেরিকা ন্যাটো বিলুপ্ত করেনি।
১৯৯৪ এ এসে আমেরিকার প্রেসিডেন্ট বিল ক্লিনটন ঘোষণা করেন ‘ন্যাটো উইল নট এক্সক্লুড এ্যানি কানট্্ির’ অর্থাৎ ন্যাটো কোনো দেশকেই ন্যাটোভূক্ত হতে না করবে না। সে বছরই পোল্যান্ড, হাঙ্গেরি এবং চেকোস্লোভাকিয়া ন্যাটো জোটে যোগদান করে। এরই মাঝে আমেরিকা ন্যাটোকে সঙ্গী করে আফগানিস্তান এবং এর পরই ইরাক আক্রমণ করে। রাশিয়া তখনও পর্যবেক্ষক। ২০০৪ সালের ২৯ মার্চ বুলগেরিয়া, লিথুয়ানিয়া. লাটভিয়া ইত্যাদি দেশ ন্যাটোভুক্ত হয়। এর মাঝেই উসকানির আরো ক্ষেত্র প্রস্ত্তুত হয়।
২০০২ সালে আমেরিকা একক সিদ্ধান্তে রাশিয়ার সাথে সম্পাদিত ৩০ বছরের পুরানো এ বি এম বা এ্যান্টি ব্যালেস্টিক মিসাইল চুক্তি থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করে। এর পর পরই ইউরোপে রাশিয়ার নাকের ডগায় আমেরিকা তার মিসাইল সিস্টেম স্থাপন করে। রাশিয়ার প্রেসিডেন্ট শুধু যে প্রেসিডেন্ট তা নন তিনি একসময়ের ‘কে জি বি’র তুখোর গোয়েন্দাও ছিলেন। রাশিয়া আমেরিকার মিসাইল সিস্টেমের প্রতিরোধ ব্যবস্থায় মনোযোগী হয় এবং এ থেকে স্নায়ু যুদ্ধোত্তর দু দেশের মাঝে আরেকটি সামরিক প্রতিযোগিতার ক্ষেত্র প্রস্ত্তুত হয়।
এরই মাঝে আমেরিকা ইউক্রেনে ‘কালার রেভূলেশন’এর মাধ্যমে সরকার পরিবর্তন ঘটায়, সামনে নিয়ে আসে কমেডিয়ান বা ভাঁড় জেলেনেস্কিকে। জেলেনেস্কি ইউক্রেনকে ন্যাটো ভূক্ত করার জন্য মরিয়া হয়ে উঠে। ফলশ্রুতি ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২২ রাশিয়ান প্রেসিডেন্ট ভ্লাদিমির পুতিন স্পেশাল মিলিটারী অপারেশন শুরু করেন।
রাশিয়ার এই স্পেশাল মিলিটারী অপারেশনের বিপক্ষে আমেরিকা এবং পুরা ইউরোপ ইউক্রেনের পক্ষ নিয়ে রাশিয়ার উপর একের পর এক অর্থনৈতিক অবরোধ আরোপ করতে থাকে। এক সময়ে মনে হয়েছিল রাশিয়া অবরোধের চাপ সহ্য করতে না পেরে ইউক্রেনের সাথে আলাপ আলোচনার মাধ্যমে একটা দফরফা করবে। এটি ছিল ভ্রান্তি বিলাস। বরং রাশিয়া চীন, ভারত এবং ইরানের মত দেশের সাথে গাঁটছাড়া বেঁধে আমেরিকা ইউরোপের সেই অবরোধকে শুধু বৃদ্ধাঙ্গুলিই প্রদর্শন করেনি বরং তার অর্থনীতিকে আরো চাঙ্গা করে তোলে একই সাথে সমরাঙ্গনেও ইউক্রেনের একের পর এক ভূমি দখলে নিতে থাকে।
ইউরোপিয় ইউনিয়ন তথা জার্মানী, ফ্রান্স, যুক্তরাজ্য পোল্যান্ডের মত দেশগুলি ইউক্রেনের জন্য যাবতীয় সামরিক রসদ যোগান দিতে থাকে। সবার উপরে ছিল আমেরিকা। এই আমেরিকই এখন একেবারে ১৮০ ডিগ্রি বেঁকে বসেছে। এরই মাঝে ফরাসী প্রেসিডেন্ট ম্যাঁক্রো, বৃটিশ প্রধান মন্ত্রী খের স্টারমার দেন দরবারের জন্য ওয়াশিংটনে হাজির হন। পাশাপাশি ২৪ ফেব্রুয়ারি ২০২৫ ইউক্রেনের রাজধানী কিয়েভে কানাডাসহ ইউরোপিয় নেতারা কিভাবে ইউক্রেনকে এই দুঃসময়ে সহায়তার হাত বাড়ানো যায় তা বিবেচনার জন্য বৈঠকে মিলিত হয়েছেন। এর ফলাফল যাই হোক ইউক্রেনের পাশ থেকে আমেরিকার সরে যাওয়া ইউরোপিয়দের জন্য চরম এক নিরাপত্তা ঝুঁকি তৈরি করেছে নিঃসন্দেহে।
দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর আমেরিকার যে নিরাপত্তা বলয়ে নিশ্চিত হয়ে ইউরোপিয়রা জীবন যাপনে অভ্যস্থ হয়ে পড়েছে সেই ইউরোপই এখন নিজেদের নিরাপত্তার এক বেকায়দার ধ্রুমজালে আটকা পড়েছে।
আমেরিকার প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের এই ১৮০ ডিগ্রি বেঁকে বসা এটা কি শুধু মাত্র মানবিক কারণে নিশ্চয়ই নয়। এটা যদি হত তাহলে নির্মমতার চূড়ান্ত শিকার গাজার ব্যাপারে ট্রাম্পের একই নীতি বিশ্ববাসী প্রত্যক্ষ করত কিন্ত্তু সেটি হয়নি। তা হলে ট্রাম্পের উদ্দেশ্য কী? চীনের বিরুদ্ধে বাণিজ্য যুদ্ধ বা ভবিষ্যৎ তাইওয়ান নিয়ে কোনো সংকটে আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প কি রাশিয়াকে কাছে টানতে উদ্যোগী হয়েছে। এটা দেখার জন্য আমাদের খুব বেশিদিন অপেক্ষায় থাকতে হবে না। চীন নিশ্চয় এ বিষয়টি বিবেচনায় নিয়ে এরই মধ্যে তার কৌশল প্রণয়ন শুরু করেছে।
লেখক: কথাসাহিত্যিক, প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট; সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক।