ভাষা আন্দোলনে নারীদের ভূমিকা যেন ভুলে না যাই

রোকসানা বন্যা | শনিবার , ১ মার্চ, ২০২৫ at ১১:০৯ পূর্বাহ্ণ

১৯৪৭ সালে ভারত বিভক্তির পর পাকিস্তানে রাষ্ট্রভাষার প্রশ্নে বিরোধ জন্ম নেয়। পাকিস্তানের শাসকগোষ্ঠীরা মানুষের মুখের ভাষা বাংলাকে অস্বীকার করে উর্দু ভাষাকে চাপিয়ে দেয়ার ষড়যন্ত্র করে। প্রতিবাদে সোচ্চার হন বাংলার মানুষেরা। ১৯৪৮ সালের মার্চে সীমিত পর্যায়ের আন্দোলন হয়। ১৯৫২ সালের একুশে ফেব্রুয়ারি তা চরম আকার ধারণ করে। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে রাজপথে বেরিয়ে আসে বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা। শাসকগোষ্ঠী আর তার প্রশাসন মাঠে নামে। আন্দোলনকারীদের ওপর লাঠিচার্জ, কাঁদানে গ্যাস নিক্ষেপ ও গুলি ছোড়ে। বরকত, রফিক, জব্বার, সালাম ভাষা রক্ষার্থে প্রাণ দিলো। এ খবর ছড়িয়ে পড়লে দেশবাসী প্রচন্ড বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। অনেক সংগ্রাম, রক্তের বিনিময়ে আমরা বাংলাভাষা অর্জন করেছি। একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের অহংকার। ভাষার জন্য শুধু আমরাই আন্দোলন, সংগ্রাম করে রক্তের বিনিময়ে এই বাংলাভাষাকে অর্জন করতে পেরেছি। বিশ্বের কোথাও মাতৃভাষার জন্য এভাবে আন্দোলন হয়নি। ১৯৪৭ সালে দেশভাগের সময় পূর্ব বাংলার বাংলা ভাষাভাষী ৪ কোটি ৪০ লাখ জনগণ পাকিস্তান অধিরাজ্যের অংশ হয়ে যায়। করাচিতে জাতীয় শিক্ষা সম্মেলনে একমাত্র উর্দুকে রাষ্ট্রভাষা এবং স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ে ব্যবহার করার প্রস্তাব করা হয়। সঙ্গে সঙ্গে এর প্রতিবাদ দেখা দেয়। ঢাকায় ছাত্ররা র‌্যালি বের করেন। বৈঠকে বাংলাকে পাকিস্তানের একটি সরকারি ভাষা এবং পূর্ব বাংলার শিক্ষার মাধ্যম করার সিদ্ধান্ত নেয়া হয়। তবে, পাকিস্তান পাবলিক সার্ভিস কমিশন অনুমোদিত বিষয় তালিকা থেকে বাংলাকে বাদ দেয় এবং একই সঙ্গে মুদ্রার নোট এবং স্ট্যাম্প থেকে বাংলা মুছে ফেলা হয়। পাকিস্তানের কেন্দ্রীয় শিক্ষা মন্ত্রী ফজলুর রহমান উর্দুকে পাকিস্তানের একমাত্র রাষ্ট্র ভাষা করতে ব্যাপক প্রস্তুুতি নেন। এতে বাঙালি জনগণ বিক্ষুব্ধ হয় এবং ছাত্রদের একটি বড় অংশ আনুষ্ঠানিকভাবে বাংলাকে একটি সরকারি ভাষা করার দাবিতে ১৯৪৭ সালের ৮ ডিসেম্বর বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্ররা ক্যাম্পাসে জড়ো হন। পরে ছাত্ররা ঢাকায় মিছিল ও সমাবেশের আয়োজন করেন। ১৯৫২ সালে পাকিস্তানের সংখ্যাগরিষ্ঠ নাগরিক ছিল বাঙালি, মোট নাগরিকের প্রায় ৫৪%। ঐ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি শুধুমাত্র উর্দুকে জাতীয় ভাষা হিসেবে ঘোষণার প্রতিবাদে বাঙালি ছাত্ররা সরকারের বিরুদ্ধে সোচ্চার হয়ে ওঠেন। ১৪৪ ধারা ভঙ্গ করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গণে জড়ো হতে শুরু করেন। সশস্ত্র পুলিশ বেষ্টিত ছাত্ররা বিশ্ববিদ্যালয় গেটে জড়ো হয়ে প্রতিবন্ধকতা ভাঙার চেষ্টা করেন। ক্যাম্পাসে মিছিল করেন। ছাত্রদের চলে যাবার সময় পুলিশ ১৪৪ ধারা লঙ্ঘনের দায়ে কিছু ছাত্রকে গ্রেফতার করেন। গ্রেফতারের সংবাদ পেয়ে বিক্ষুব্ধ ছাত্ররা পূর্ব বাংলা গণপরিষদ অবরোধ করে সেখানে তাদের প্রস্তাব উপস্থাপনের দাবি জানান। ছাত্রদের একটি দল বিল্ডিঙের মধ্যে দ্রুত ঢোকার চেষ্টাকালে পুলিশ গুলি চালায় এবং তাতে সালাম, রফিক, বরকত, জব্বার, শফিউর সহ নিহত হন। হত্যাকাণ্ডের সংবাদ ছড়িয়ে পড়লে সারা শহর জুড়ে বিক্ষোভ ছড়িয়ে পড়ে। দোকানপাট, অফিস ও গণপরিবহন বন্ধ করে দেওয়া হয় এবং ধর্মঘট শুরু হয়। ১৯৫২ সালের ২১ ফেব্রুয়ারি ১৪৪ ধারা ভাঙার ক্ষেত্রে বিতর্ক সৃষ্টি হলে নারী ভাষাসংগ্রামীরা এর পক্ষে মত দেন। এই আন্দোলনের সাথে বেগম আফসরুন্নেসা, লিলি খান, আনোয়ারা খাতুনও যুক্ত ছিলেন। বাংলার ভাষা আন্দোলনে আরো যে সকল নারীরা উল্লেখযোগ্য ভূমিকা নেন, তাঁরা হলেন সুফিয়া কামাল, নীলিমা ইব্রাহিম ও শাফিয়া খাতুন। এঁরা ভাষাসৈনিক হিসেবে প্রণম্য। নারীরা যে কোনো আন্দোলনসংগ্রামে পিছিয়ে ছিলেন না। বরঞ্চ অনেক ক্ষেত্রে ছিলেন অগ্রভাগে। ব্রিটিশবিরোধী আন্দোলনে মাস্টারদার সাথে সহযোদ্ধা ছিলেন প্রীতিলতা, কল্পনা দত্তরা। ভাষা আন্দোলনের শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত নারীদের ভূমিকা ছিল অনন্য।

সেদিন সকাল থেকেই স্কুলকলেজের মেয়েরা ছোট ছোট দলে এসে আমতলার সভায় যোগ দেন। নারী ভাষাসংগ্রামীরা পুলিশের ব্যারিকেড ভেঙে দেওয়ার মাধ্যমে আন্দোলন দমাতে পুলিশের জারি করা ১৪৪ ধারা প্রথমেই ভেঙে দিতে সক্ষম হন। ১০ জন করে বের হওয়া প্রথম দুটি দলের অনেকেই গ্রেপ্তার হন। তৃতীয়বার দল নিয়ে বেরিয়ে ব্যারিকেড ধরে টানাটানি শুরু করেন ছাত্রীরাই। সেদিন পুলিশের লাঠিচার্জ আর টিয়ারশেলে অনেক ছাত্রী আহত হন।

১৯৫২ সালের ২২ ফেব্রুয়ারি গায়েবানা জানাজা, শোক মিছিল ও ২৩ ফেব্রুয়ারি ১৯৫২ হরতালসহ প্রতিটি কর্মসূচিতে নারীরা অংশগ্রহণ করেন। ভাষা আন্দোলনে পাকিস্তান আর্মি ও পুলিশের তাক করা বন্দুকের নলকে উপেক্ষা করে পুরুষের পাশাপাশি নারীরাও এক সারিতে ছিলেন সব মিছিলে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রীরা রাতে লুকিয়ে পোস্টার এঁকেছেন। আহতদের চিকিৎসায় অগ্রণী ভূমিকা রাখেন ঢাকা মেডিকেল কলেজের ছাত্রীরা। আন্দোলনকে বেগবান করতে বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাঁদা তুলেছেন নারীরা। উল্লেখিত নারীরা ছাড়াও আরো কিছু নারীদের কথা জানা যায় আতাউর রহমান খানের সাক্ষাৎকার থেকে। তিনি বলেছেন২১ ফেব্রুয়ারির দুই তিন দিন পর তারা কয়েকজন আজিমপুর কলোনীতে গিয়েছিলেন ভাষা আন্দোলনের চাঁদা তুলতে। সেই সময় অনেক মহিলা ফ্লাটের উপর থেকে তাদের দেখে স্বেচ্ছায় টাকাপয়সা ছুঁড়ে দিয়েছিলেন। এমনটি অনেক মহিলা তাদের প্রিয় সোনার অলংকার যেমনআংটি, কানের দুল, গলার হারও ছুড়ে দিয়েছিলেন। সেই সময়ে নারীদের ভাষার প্রতি আবেগঘন ভালোবাসা, অনুভূতি দেখে তিনি অভিভূত হয়েছিলেন।

সুখের কথা নারীদের স্বকীয়তা ও স্বাতন্ত্র্যবোধের প্রথম উন্মেষ ঘটেছিলো তখন থেকে। এই উপলব্ধির মধ্য দিয়ে স্বাধীনতার ভিত তৈরি হয়েছিলো এবং তারই ফলশ্রুতিতে আমরা লাভ করেছি স্বাধীনতা।

ভাষা আন্দোলনে জড়িত থাকায় অনেক নারীকে জেলে যেতে হয়। অনেক ছাত্রী শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান থেকে বহিস্কৃত হন। শুধু ঢাকাতেই নয়, ঢাকার বাইরেও নারীরা ভাষা আন্দোলনে একাত্মতা প্রকাশ করেন। তারাও পুলিশি নির্যাতনের শিকার হন। আমাদের নারীরা মহান মুক্তিযুদ্ধেও অংশগ্রহণ করেছিলেন। রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন থেকে বাংলা ভাষা আন্দোলন। সমস্ত ভাষা আন্দোলনে হাতে হাত মিলিয়ে অংশ নিয়েছেন অজস্র নারী ভাষা সংগ্রামী। ভাষা সংগ্রামীরা ভাষা আন্দোলনের দুর্বার প্রতিরোধ গড়ে তুলেছেন। এই পথ কণ্টক জেনেও দোর্দন্ড শক্তিতে এগিয়ে এসেছেন নিজের মাতৃভাষার সম্মান রক্ষার্থে। ভাষা আন্দোলনে পৃথিবীর নানা প্রান্তে অজস্র নারী দাঁড়িয়েছিলেন। বাংলা ভাষাকে রাজ্যের দাপ্তরিক ভাষা করার জন্য আন্দোলন হয়েছিল আসামেও। ভাষার জন্য নিজের জীবন উৎসর্গকারী একমাত্র নারী ছিলেন ১৬ বছরের এক কিশোরী। নাম তার কমলা ভট্টাচার্য। কমলা ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৪৫ সালে তৎকালীন আসাম প্রদেশের সিলেটে। বাবা রামরমণ ভট্টাচার্য ও মা সুপ্রবাসিনী দেবীর সাত সন্তাানের মধ্যে পঞ্চম, কমলা। কমলারা ছিলেন তিন ভাই ও চার বোন। ১৯৫০ সালে পূর্ব পাকিস্তানে সাম্প্রদায়িক দাঙ্গা ও সংখ্যালঘুদের উপর নির্যাতন শুরু হলে তার রেশ সিলেটেও এসে পড়েছিল। তাই একটা সময় দেশ ত্যাগ করে আসামে চলে গেলেন।

কমলার মতো শহীদদের রক্তে পরবর্তীতে বাংলাকে দাপ্তরিক ভাষা করার সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছিল আসাম সরকার। এতো কিছুর পরও বর্তমানে বাংলা ভাষার দৈন্য চেহারা দেখে মন ভারাক্রান্ত হয়। এতে ত্যাগ, তিতিক্ষার পর আন্দোলনের সুবর্ণ ফসল পেয়ে আমরা ধন্য হয়েছিলাম। ইদানীং বাংলা ভাষা চর্চায় তা দেখা যাচ্ছে না। ভাষা আন্দোলনের চেতনায় উজ্জীবিত সেই মূল্যবোধ হারিয়ে যাচ্ছে দিনদিন। সর্বস্তরে বাংলা ভাষার ব্যবহারের পরিবর্তে সাম্প্রদায়িকতার নামে অনেক শব্দের আমদানি করার সচেতন প্রয়াস চালাচ্ছে একশ্রেণির মানুষ। এইসব ভাষা সৃষ্টির মাধ্যমে বাংলা ভাষাকে একধাপ নিচে নামিয়ে দিয়েছে। আজন্ম পরিচিত ভাষার বিকৃতির ছড়াছড়ির ব্যবহারে ভাষা হয়ে উঠেছে দুর্বোধ্য ও ব্যবহারের অযোগ্য। ভাষা আন্দোলনের ইতিহাসে বিকৃতি ঢুকে তার সাফল্যকে ব্যর্থ করে দিচ্ছে। বাংলা ভাষার শ্রুতি মাধুর্য হারিয়ে যাচ্ছে। ২১ শে ফেব্রুয়ারি আমাদের অহংকার, আমাদের সংস্কৃতি, আমাদের ধারক ও বাহক। আমরা বাঙালি, আমাদের মাতৃভাষা বাংলা। তা এই একুশের মাধ্যমেই জেনেছি আমরা। তাই এখন বেশি প্রয়োজন আমাদের ভাষা বাংলাকে শুদ্ধভাবে লেখা ও চর্চা করা। আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসে শহীদদের প্রতি বিনম্র শ্রদ্ধা রইল।

জান দেবো, তবু জবান দেবো না’।

পূর্ববর্তী নিবন্ধদৃঢ়তার জয়গান
পরবর্তী নিবন্ধপাঁচলাইশ থানা স্বেচ্ছাসেবক দলের কর্মী সভা