বর্তমানে বিশ্বব্যাপী বহুল আলোচিত বিষয়সমূহের মধ্যে অন্যতম অনুষঙ্গ হচ্ছে আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স (এআই) বা কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা। ইতিমধ্যে এর ব্যাপক দৃশ্যমানতা পৃথিবী জুড়ে নবতর রূপ পরিগ্রহ করেছে। এটি ধরিত্রীর সামগ্রিক গতিপ্রকৃতি ও মানুষের চিন্তা–ভাবনায় আমূল পরিবর্তন এনেছে। পূর্বে প্রযুক্তি কোম্পানিগুলো কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা ব্যবহার করলেও; বর্তমানে অন্যান্য খাতেও এর বহুল ব্যবহার ক্রমান্বয়ে বৃদ্ধি পেয়েছে। তরুণ উদ্যোক্তাদের হাত ধরে বাংলাদেশেও শুরু হয়েছে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার। বেসরকারি খাতে এর ব্যাপক ব্যবহারের পাশাপাশি সরকারি খাতেও অত্যাধুনিক এই প্রযুক্তি ব্যবহৃত হচ্ছে। বিজ্ঞানীদের পূর্বাভাস অনুযায়ী চিকিৎসাসেবা, অফিস–আদালত, শিল্প–কারখানা, সংবাদসংস্থা বা গণমাধ্যম, ভাষান্তর প্রক্রিয়া, টেলিফোন সেবা, বৈজ্ঞানিক গবেষণা, হোটেল–রেস্তোরাঁ, বিপণিবিতানসহ বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ কর্মক্ষেত্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ব্যবহার পরিলক্ষিত। বাংলাদেশের টেলিযোগাযোগ, মোবাইল ফোন অপারেটর, ব্যাংক, অনলাইন ও কৃষিখাতসহ অনেক খাতেই এর উপযোগিতায় ভাল ফল পাওয়া যাচ্ছে বলে সংশ্লিষ্টদের দাবি।
এছাড়াও শিল্প কারখানায় অপচয়–ব্যয় কমিয়ে মেশিনের সর্বোচ্চ ব্যবহার নিশ্চিতে পরিবেশ বান্ধব উৎপাদন ব্যবস্থায় কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সহায়ক ভূমিকা পালন করছে। কৃষিখাতেও এআই এর ব্যবহার শুরু হয়েছে। এআই সঠিক উৎপাদন চাষ–পদ্ধতির বিষয়ে যথার্থ সিদ্ধান্ত দিচ্ছে। মাটির গুণাগুণ গবেষণা করে বলে দিচ্ছে কোন ধরনের ফসল ঐ মাটিতে চাষ করা উচিত। চিকিৎসাসেবায় এগিয়ে আসছে এআই সফটওয়্যার। এটি চিকিৎসকদের এমআরআইয়ের মাধ্যমে ক্যানসার শনাক্ত করার কাজে সহায়তা করছে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা কাজে লাগিয়ে এমন সব ‘সেল্ফ লার্নিং সফটওয়্যার’ তৈরি করা হচ্ছে যা চিকিৎসা ক্ষেত্রে উল্লেখ্যযোগ্য অগ্রগ্রতি সাধন করবে। জটিল রোগের সুনির্দিষ্ট লক্ষণগুলো চিহ্নিত করতে চিকিৎসাবিদ্যায় হাইটেক প্রযুক্তির ব্যবহার উত্তরোত্তর বৃদ্ধি পাচ্ছে। ম্যাগনেটিক রেজোনেন্স ইমেজিং পদ্ধতির মাধ্যমে শরীরের অভ্যন্তরের অঙ্গ–প্রত্যঙ্গের বিস্তারিত চিত্র ফুটিয়ে তোলা হচ্ছে যাতে ডাক্তাররা সেই ছবি বিশ্লেষণে প্রকৃত অবস্থা সম্পর্কে ধারণা নিতে পারেন। কৃত্রিম পদ্ধতিতে ফুসফুসের রোগীর শ্বাসপ্রশ্বাস চালানোর বড় ঝুঁকি–ক্ষতি এড়াতে নতুন উদ্ভাবিত আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স এর মাধ্যমে এমন রোগির বাঁচার সম্ভাবনাও বহু বৃদ্ধি পেয়েছে।
২০২২ সালে নভেম্বরে উন্মুক্ত হওয়া চ্যাটজিপিটির ভাষাগত দক্ষতা ব্যবহারকারীদের দারুণ মুগ্ধ করেছে। এটি ব্যবহার করে সম্পূর্ণ উপন্যাস, কোড, টেলিভেশনের জন্য ধারাবাহিক নাটক ও গান লেখার মতো কর্মযজ্ঞ সম্ভব হয়েছে। বিজ্ঞানীদের অনুমান ২০৪৯ সালের মধ্যে রোবট বেস্ট সেলার বুক লিখতে সক্ষম হবে। ইতিমধ্যে জাপানে বুদ্ধিমান মেশিনের রচিত ছোট উপন্যাস সাহিত্য পুরস্কারের জন্য বিবেচিত হয়েছে। অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয়ের বিজ্ঞানীদের অভিমত, আগামী ১২০ বছরের মধ্যে মানুষের সব কাজ বুদ্ধিমান মেশিনের মাধ্যমে সম্পন্ন হতে পারবে। স্ট্যামফোর্ড ইউনিভার্সিটির গবেষকরা দাবি করছেন, তারা এমন একটি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা তৈরি করেছেন যেটি সহজেই শরীরের বিভিন্ন পরীক্ষা করে মানুষের মৃত্যুর ক্ষণ গণনা করে বলে দিতে পারবে।
লন্ডনভিত্তিক পরামর্শ প্রতিষ্ঠান পিডাব্লিউসি ২০২২ সালে এক হাজার কোম্পানির উপর পরিচালিত জরিপ অনুসারে, এসব কোম্পানির মধ্যে কেউ ছয়জনের মধ্যে একজন, আর কেউ চারজনের মধ্যে একজন কর্মীর নিয়োগে এআই ব্যবহার করেছে। এছাড়া অনেক কোম্পানিতে প্রায় ৪০ শতাংশ নিয়োগে এআই ব্যবহার করা হয়েছে। শুধু নিয়োগ নয়; চাকরিতে যোগ দেওয়ার পর একজন কর্মী কেমন কাজ করছে তারও খবর রাখছে এআই। অ্যামাজন, ইউনিলিভারসহ বিভিন্ন বহুজাতিক কোম্পানিতে কর্মী নিয়োগে কাজ করা মার্কিন প্রতিষ্ঠান ‘হায়ারভিউ’ জানিয়েছে, ভিডিও সাক্ষাৎকার গ্রহণের মাধ্যমে দ্রুত কর্মী নিয়োগ যথেষ্ট কার্যকর। এআই প্রযুক্তির কারণে নির্দিষ্ট বর্ণ–লিঙ্গের প্রতি পক্ষপাতমূলক আচরণ এড়ানো সম্ভব। দুঃখজনক হলেও সত্য যে, ২০২২ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রকাশিত জরিপে এআই প্রযুক্তিতে প্রশিক্ষণপ্রাপ্ত রোবট নারী ও অশ্বেতাঙ্গদের প্রতি বর্ণবাদমূলক আচরণ করেছে বলে অভিযোগ উত্থাপিত হয়েছে। এমতাবস্থায় যুক্তরাষ্ট ‘ইকুয়াল এমপ্লয়মেন্ট অপরচুনিটি কমিশন’ কর্মক্ষেত্রে এআই প্রযুক্তি ব্যবহারের নীতিমাল প্রকাশ করেছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নও একই বিষয়ে দুইটি আইন প্রণয়ন করতে যাচ্ছে। ইউরোপীয় ইউনিয়নের মতে, নাগরিক ও কোম্পানিগুলো এআই ব্যবহার করে লাভবান হতে পারে কিন্তু মৌলিক অধিকার ঝুঁকির মুখে পড়ার সমূহ সম্ভাবনাও রয়েছে। অতিসম্প্রতি নবনির্বাচিত মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প তাঁর দ্বিতীয় কর্মদিবসে যুক্তরাষ্ট্রে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা অবকাঠামোতে ৫০০ বিলিয়ন তথা পঞ্চাশ কোটি ডলার বিনিয়োগের ঘোষণা দিয়েছেন। যদিও টেসলা ও স্পেসএক্স এর প্রতিষ্ঠাতা ইলন মাস্ক প্রকল্পের ভবিষ্যৎ নিয়ে সংশয় প্রকাশ করেছেন।
আমাদের সকলের জানা, দৈনন্দিন কার্যপ্রণালীতে মানুষের মতো বুদ্ধিমত্তা দেখানো মেশিনই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা হিসেবে বিবেচিত। গবেষকগণ এর সংজ্ঞা নিয়ে একমত না হলেও; যুক্তরাষ্টের নর্থওয়েস্টার্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের কম্পিউটার বিজ্ঞানের অধ্যাপক ল্যারি বার্নবাউম এর মতে, ‘সাধারণত কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা হলো কম্পিউটার বিজ্ঞানের এমন একটি ক্ষেত্র, যেখানে বুদ্ধিদীপ্ত কাজ করতে যন্ত্র তৈরি ও প্রশিক্ষণের ওপর গুরুত্ব দেয়। যুক্তি–সমস্যা সমাধান–মানুষের ভাষা বোঝার ক্ষমতা–উপলব্ধি–শিক্ষণ–পরিকল্পনা–কোনো বস্তুর অবস্থানের পরিবর্তন ঘটানো বা কোনো বিষয়ে হস্তক্ষেপ করার মতো স্বয়ংসম্পন্ন মেশিনই কৃত্তিম বুদ্ধিমত্তার মেশিন হিসেবে বিবেচ্য। উচ্চ ক্ষমতার কম্পিউটার, রোবট ও অন্যান্য যন্ত্রাদি এর অন্তর্ভুক্ত। ১৯৫৬ সালে নিউ হ্যামশায়ারের হ্যানোভার শহরস্থ ডার্টমাউখ কলেজে অনুষ্ঠিত একাডেমিক কনফারেন্সে জন ম্যাক্যার্থি সর্বপ্রথম আর্টিফিসিয়াল ইন্টেলিজেন্স নামক টার্মটি প্রকাশ করেন। এজন্য তাঁকে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার জনক বলা হয়। তাঁর অন্যান্য সহযোগীরা হলেন– মার্ভিন মিনস্কি, অ্যালেন নিউয়েল ও হার্বাট এ সায়মন।
প্রযুক্তির উৎকর্ষতায় অভাবনীয় সাফল্যে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার প্রসার ভবিষ্যত বিশ্ববাসীর জন্য স্বস্তি–সুখ–স্বাচ্ছন্দ্যময় হওয়ার বিপরীতে এক অজানা আশঙ্কা গভীরভাবে অনুভূত হচ্ছে। বিশ্বখ্যাত বিজ্ঞানীদেরও তা চিন্তার কারণ হিসেবে প্রতিভাত। বিশ্বের ৫০টিরও বেশি দেশের বিপুল অর্থ ব্যয়ে যুদ্ধক্ষেত্রে ব্যবহারযোগ্য স্বয়ংক্রিয়ভাবে লক্ষ্য নির্ধারণ এবং শত্রুকে হত্যা করতে সক্ষম রোবট ও ড্রোন তৈরির সংবাদ জনমনে যারপরনাই আতঙ্ক তৈরি করছে। ৮ জুন ২০২৩ গণমাধ্যমে প্রকাশিত সূত্রমতে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা নিয়ে বিশ্বের বিশেষজ্ঞরা উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন। তাঁদের দাবি; এই প্রযুক্তি একদিন মানুষের বিপরীতে দাঁড়িয়ে যাবে। মানুষকে হত্যা করবে। সম্প্রতি কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা দিয়ে তৈরি বর্তমান বিশ্বের অত্যাধুনিক উন্নত মানবীয় রোবট ‘অ্যামেকা’ ভবিষ্যতে কি কঠিন অবস্থার মুখোমুখি হতে হবে তার আভাস দিয়েছে। লন্ডনে আয়োজিত ইন্টারন্যাশনাল কনফারেন্স অব রোবটিক্স অ্যান্ড অটোমেশন বিষয়ক সিম্পোজিয়ামে ‘ওপেন এআই’ এর চ্যাটজিপিটি ব্যবহার করে পর্যবেক্ষকদের প্রশ্নের উত্তর দিয়ে সবাইকে বিস্মিত করেছে। এর নির্মাতা প্রতিষ্ঠান কর্নওয়ালভিত্তিক ইঞ্জিনিয়ার্ড আর্টস এর প্রধান নির্বাহী কর্মকর্তার ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার দৃশ্যপট’ বর্ণনায় অ্যামেকা অত্যন্ত সাবলীলভাবে জানায়, ‘কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এবং রোবটিক্স নিয়ে সবচেয়ে যে ভীতিকর পরিস্থিতি আমি বিশ্বে কল্পনা করি তা হলো, রোবটরা হয়ে উঠবে অতি মাত্রায় শক্তিশালী। এতটাই শক্তি তারা সঞ্চয় করবে যে, তারা তাদের অজান্তেই মানবজাতিকে নিয়ন্ত্রণ করবে অথবা পরিচালনা করতে সক্ষম হবে। এর ফলে একটি নিষ্পেষিত সমাজব্যবস্থা গড়ে উঠবে, যেখানে ব্যক্তি বিশেষের অধিকারের প্রতি আর সম্মান দেখানো হবে না।’
চলতি বছরের মে মাসে ‘সেন্টার ফর এআই সেফটি’র আয়োজনে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিষয়ক প্রতিষ্ঠান ওপেন এআই, অ্যানথ্রোপিক এবং গুগলের কর্মকর্তাদের প্রদত্ত বিবৃতিতে বলা হয়েছে, কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা এক বিপর্যয় ঢেকে আনছে। ভবিষ্যতে বৈশ্বিক অগ্রাধিকারে রাখতে হবে কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার ঝুঁকিকে। মহামারি ও পারমাণবিক যুদ্ধের মতোই সামাজিক মাত্রায় ঝুঁকি রয়েছে এক্ষেত্রেও। আমরা এখনও কোনো বিপজ্জনক পরিস্থিতিতে পড়িনি। তবে এআই এবং রোবটিক্সের সঙ্গে সম্পর্কিত বড় রকমের ঝুঁকি এবং বিপদের বিষয়ে সচেতন হওয়া খুবই গুরুত্বপূর্ণ। তাই এখন এসব প্রযুক্তি এমনভাবে তৈরি হতে হবে যাতে ভবিষ্যতে কোনো বড় ক্ষতি বা নেতিবাচক প্রভাব এড়ানো যায়। একবিংশ শতাব্দীর বিখ্যাত বিজ্ঞানী স্টিফেন হকিং কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা সম্পর্কে বলেছেন, ‘এরা এক সময়ে আমাদের অতিক্রম করে যাবে। এর ফলে মানবজাতির বিলুপ্তি ঘটতে পারে। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তার উন্নয়ন কৌশল এমন স্তরে পৌঁছবে, যাতে মানুষের সাহায্য ছাড়াই এরা স্বয়ংক্রিয়ভাবে নিজেদের উন্নতি ঘটাতে পারবে। আর যদি এমনটি ঘটে, তাহলে আমাদের বুদ্ধিমত্তার বিস্ফোরণের সম্মুখীন হতে হবে; যার ফলে যান্ত্রিক বুদ্ধি আমাদের অতিক্রম করবে।’ মোদ্দাকথা সমগ্র মানবসমাজের জন্য ক্ষতিকর–সমৃদ্ধ মানবসম্পদ উন্নয়নে প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টির কৃত্রিম সংকটকে অবশ্যই পরাভূত করতে হবে। প্রযুক্তির প্রয়োগ প্রত্যাশিত, তবে এর অপপ্রয়োগ ও ভবিষ্যত মানববিধ্বংসী যেকোন অপ্রত্যাশিত পদক্ষেপ বর্জনীয়। কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা প্রসারের ক্ষেত্রেও পুরোবিশ্বের মনোযোগ যথার্থ আকর্ষিত না হলে ধ্বংসের কালো গহ্বরে নিপতিত হওয়ার সম্ভাবনা অপরিমেয় হতাশার কারণ হবে।
লেখক
শিক্ষাবিদ, সমাজ–অপরাধবিজ্ঞানী