পৃথিবীর সকল দেশে নৈতিকতাবোধ সম্পন্ন শিক্ষিত জনগোষ্ঠী তৈরি করার লক্ষ্যে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়ের সৃষ্টি তেমনিভাবে বাংলাদেশও এগিয়ে চলছে, প্রতিনিয়ত আমাদের শিক্ষিত জনগোষ্ঠীর হার বাড়ছে, কিন্তু শিক্ষিতের হার বাড়লেও নৈতিকতার হার কতটুকু বাড়ছে সেটা নিয়ে বরাবরই সন্দেহ থেকে যায়। প্রাথমিক স্তর বাদ দিলে মাধ্যমিক স্তর থেকে দিন দিন আমাদের নৈতিকতা এবং রুচিশীল হওয়ার কথা, কিন্তু একটি বিষয় লক্ষ্যণীয় সেই জনগোষ্ঠীর একটি অংশ শিক্ষিত হলেও বিকৃতরুচির দিকে ঝুঁকে যাচ্ছে।
সরজমিনে এবং তথ্য বিশ্লেষণে দেখা যায় অধিকাংশ শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্লাশরুম এবং টয়লেট বা ওয়াশরুমের দেয়ালে, দরজায়, টেবিলে অত্যধিক রকমের লেখালেখি থাকে তার মধ্যে অনেকগুলো অরুচিকর এবং বিকৃত মানসিকতার যা একটি শিক্ষিত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষার্থীদের কাছে আশা করা যায় না। যে প্রতিষ্ঠানে তারা লেখাপড়া করছে সেটি যে তাদের নিজের প্রতিষ্ঠান সে মানসিকতা তাদের মধ্যে বেড়ে উঠে না। নৈতিকতার অবক্ষয় থেকে বা বিকৃত মানসিকতা থেকে তারা এই কাজগুলো করে থাকে, যা অবশ্যই একটি মানসিক ব্যাধি। কারণ যারা তাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে বা পাবলিক প্লেসগুলোতে এই অরুচিকর কাজগুলো করছে তারা কিন্তু অন্যকেও প্রভাবিত করছে। কিন্তু একটি বিষয় লক্ষণীয় যে, যারা এই কাজটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে করছে সেটি তারা কিন্তু তার ঘরে বা দেয়ালে করছে না ফলে বুঝা যায় যে সে সেটি ইচ্ছাকৃতভাবেই করছে এবং সে মনে করছে এটি অন্যের সম্পত্তি, নষ্ট বা অসুন্দর হলে আমার ক্ষতি কী, আর আমি যে লিখেছি তা তো কেউ দেখেনি, সে কখনো ভেবেই দেখছে না এটি তার বিকৃতরুচির এর পরিচয় এবং একটি অমার্জনীয় অপরাধ।
আমাদের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে এখনো নকল প্রবণতা বিদ্যমান এবং তারই অংশ হিসেবে শিক্ষার্থীরা ক্লাসরুম বা টেবিলে বা সুন্দর দেয়ালে তাদের তাদের পঠিত বইয়ের কিছু অংশ লিখে ফেলে, এমনকি তার ভালো লাগা বা ভালোবাসার কথাও দেয়ালে লিখে রাখে। তাহলে প্রশ্ন উঠছে আমরা যে শিক্ষিত জনগোষ্ঠী তৈরি করছি তাদের মধ্যে আমরা কতটুকু শিষ্টাচার এবং কী নৈতিকতা সৃষ্টি করতে পেরেছি। তবে একটি প্রতিষ্ঠানের পক্ষে এসবের বিরুদ্ধে সার্বক্ষণিক তদারকি করা অসম্ভব এবং তাদের বিরুদ্ধে শাস্তি নেওয়ারও কোনো সুযোগ থাকে না কারণ কে বা কারা এই অসুন্দর অরুচিকর কর্মকান্ড করেছে তা নির্ধারণ করার খুব একটা সুযোগ নেই অথবা কে করেছে এমন সাক্ষী প্রমাণ পাওয়াও দুস্কর। তাই এমন অসুন্দরের বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণের চেয়ে বেশি প্রয়োজন সচেতনতা সৃষ্টি করা এবং এই লক্ষ্যে প্রাথমিক স্তর থেকে ধারাবাহিকভাবে শিষ্টাচার এবং নৈতিকতা সৃষ্টির বিষয়ে ব্যবস্থা গ্রহণ করা।
আমাদের অনেকেই হয়তো বিশেষ প্রয়োজনে বিভিন্ন মার্কেট, বিভিন্ন টার্মিনালে পাবলিক টয়লেটের ব্যবহার করতে হয়, কিন্তু টয়লেট ব্যবহার করতে গিয়ে লক্ষ্য করবেন টয়লেটের দরজা ও দেয়ালে মোবাইল নম্বর সহকারে কিছু হাতের লেখা, লেখাগুলি পড়তেই আপনার চোখ ছানাবড়া হয়ে যাবে– এতো অশ্লীল এসব কী? এ ছাড়াও উচ্চারণ অযোগ্য অনেক অশ্লীল ভাষা লিখা থাকে, এমনকি অনেক মেয়ের নামে মোবাইল নং সাথে আরো অনেক অরুচিকর ও নোংরা কথা লেখা থাকে। যারা মার্কেটের বাথরুমে দরজায় বা দেয়ালে, বাসের সিটের পিছনে বা কোনো পাবলিক প্লেসে লিখছেন তারা অবশ্যই লেখাপড়া জানা মানুষ, তাদের আমরা স্বশিক্ষিত বা শিক্ষিত হিসেবে ধরে নিলেও মানসিকতায় এদের শিক্ষিত বলবো না। শিক্ষিত একজন মানুষের রুচি ও মানসিকতার কি পরিমাণ অবনতি ঘটলে এধরনের লেখা লিখতে পারে তা আমার বোধগম্য নয়। একবার কি এরা ভেবে দেখেছে কোন স্কুল–কলেজের ছেলে–মেয়েরা যখন এসমস্ত বাথরুম ব্যবহার ও তাদের বাবা–মায়ের সাথে যখন এই সব বাসে ভ্রমণ করবে তখন কি বিব্রত অবস্থার সৃষ্টি হবে বা অভিভাবকরা কতটুকু লজ্জায় পড়বে। এসব নোংরা, অরুচিকর লেখা থেকে একটা বিষয় বুঝা যায় সবাই এক সাথে ও একইদিনে এই লেখাগুলি লিখেনি কেউ একজন শুরু করেছে এবং অন্য আরেকজন তা দেখে উৎসাহিত হয়েছে। আইন শৃঙ্খলা–বাহিনী বা সমাজ সচেতনদের চোখের সামনে দিয়ে চলছে এই সব প্রচারণা, যা মোটেও কাম্য নয়।
আমরা শিক্ষিত হয়ে এগিয়ে যাচ্ছি, এটি যেমন সত্যি তেমনি কিছু কিছু ক্ষেত্রে বিকৃত মানসিকতাও আমাদের ভর করছে। কোনো সভ্য দেশে বাস করে মানসিক বিকারগ্রস্ত থেকে আমরা এই কাজগুলি করছি এবং এই অসুন্দর কাজগুলো জেনে শুনে করছে আমাদের দেশের তথাকথিত একটি শিক্ষিত জনগোষ্ঠী। আমাদের মধ্যে একটি ধারণা সৃষ্টি হয়েছে অপরের ক্ষতি হলে আমার কী আসে যায়। আমরা প্রত্যেক ভালো ভালো কথা বলি পরিবেশ এবং সুন্দরের বিষয়ে কিন্তু যা বলি যা শুধু আলাপ আলোচনায় সীমাবদ্ধ থাকে বাস্তবায়নে আমরা ততটা আন্তরিক নয়। যেমন ধরুন দেয়াল লিখন এবং পোস্টার সাটানোর কারণে কোনো একটি সুন্দর দেয়াল অল্প কয়েকদিনের মধ্যে নষ্ট হয়ে যাচ্ছে, হোক সেটি সরকারি বা ব্যক্তিগত। কিন্তু কাজটি করার আগে একবারও ভাবা হয় না এর ফলে সুন্দর রং করানো কাজটি নষ্ট করায় কত আর্থিক ক্ষতি হলো এবং সেই কাজটি আমরা যারা জনগণের কথা বলি জনগণের প্রতিনিধি হিসেবে রাষ্ট্রের জন্য কাজ করি সেই রাজনৈতিক দলগুলোও করে থাকে। একটি বিষয় লক্ষণীয় বর্তমান সময়ে দেয়ালে সবচেয়ে বেশি পোস্টার লাগানো হচ্ছে প্রাথমিক থেকে বিশ্ববিদ্যালয় স্তরের কোচিং পরিচালনাকারী প্রতিষ্ঠানগুলো পক্ষে, রাজপথ ছেড়ে তারা ছড়িয়ে গেছে অলিতে গলিতেও। এই প্রতিষ্ঠানগুলো ব্যবসায়িক প্রচারণার অংশ হিসেবে এই কাজটি করছেন কিন্তু কতটুকু নৈতিক সেটি একবারও চিন্তা করছেন না, তার ব্যবসায়িক স্বার্থে অন্যের কি পরিমাণ ক্ষতি হচ্ছে।
প্রচারণার এই অসুন্দর বিকৃত কাজগুলো বাংলাদেশেই হয়তো সবচেয়ে বেশি বিশ্বের অন্যান্য রাষ্ট্রগুলোতে এমনটি খুব একটা দেখা যায় না। অন্যদেশ যদি এই অসুন্দর কাজগুলো থেকে বিরত থাকতে পারে তাহলে আমরা কেন পারবো না? আমাদের এর জন্য প্রয়োজন নতুন আইন সৃষ্টি এবং তার প্রয়োগ যার মাধ্যমে এই কাজ বন্ধ করা যায়। তবে শুধু আইন করে এই অসুন্দর কাজ থেকে আমরা সকলকে বিরত রাখতে পারবো না তার সাথে সাথে থাকতে হবে প্রত্যেক স্তরে নৈতিকতা সৃষ্টি এবং সচেতনতা বৃদ্ধির ব্যবস্থা করা।
লেখক
ডেপুটি রেজিস্ট্রার, বিজিসি ট্রাস্ট ইউনিভার্সিটি বাংলাদেশ