একটি অভাবনীয় প্রকাশনা প্রসঙ্গে

জ্যোতির্ময় নন্দী | শুক্রবার , ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ at ১০:৪৪ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের শিক্ষক ড. শিপক কৃষ্ণ দেবনাথের পিএইচডি অভিসন্দর্ভের গ্রন্থরূপে প্রকাশনা দেখে একই সাথে বিস্মিত ও আনন্দিত হয়েছি। বিস্ময়ের মুখ্য কারণটি হলো অভিসন্দর্ভটির বা গ্রন্থটির বিষয়বস্তু। আমাদের সুদূর অতীতের এমন একজন মহান দার্শনিক, কবি ও নাট্যকারের জীবন ও কর্ম এ অভিসন্দর্ভের উপজীব্য করা হয়েছে, দূরকালের দুরপনেয় কুয়াশায় আবৃত থাকার কারণে যা নিয়ে গবেষণা ও অধ্যয়ন রীতিমতো দুরূহ কাজ।

বিস্ময়ের গৌণ কারণটি কারো কারো কাছে অপ্রাসঙ্গিকও মনে হতে পারে জেনেও বলেই ফেলছি। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগকে অপেক্ষাকৃত দুর্বল একটা বিভাগ বলেই মনে করতাম, কিন্তু সেবিভাগেরই একজন শিক্ষকের এমন আলোকসঞ্চারী একটা উদ্যোগ আমার সমস্ত পূর্বধারণাকে অতিক্রম করে গেছে অনেক দূর।

আনন্দের কারণ হলো, আমাদের দেশে অজ্ঞাত বা বিস্মৃতপ্রায় একজন মহামানবকে নিয়ে আয়াসসাধ্য কাজটি সফলভাবে সম্পন্ন করা হয়েছে, এবং তা করেছেন এ অঞ্চলে উচ্চশিক্ষার প্রধান পাদপীঠ চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন শিক্ষক।

বলছিলাম, ধ্রুপদী সংস্কৃত সাহিত্যের অন্যতম বরপুত্র অশ্বঘোষকে নিয়ে এ বিশ্ববিদ্যালয়ের সংস্কৃত বিভাগের সহযোগী অধ্যাপক ড. দেবনাথের লেখা একটা বইয়ের ব্যাপারে, যেটি সম্প্রতি প্রকাশিত হয়েছে খ্যাতনামা প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান অ্যাডর্ন পাবলিকেশনস থেকে। বইটি আসলে ড. দেবনাথের ‘বৌদ্ধসংস্কৃত সাহিত্যে মহাকবি অশ্বঘোষের অবদান মূল্যায়ন’ শীর্ষক পিএইচডি অভিসন্দর্ভের মুদ্রিত রূপ। বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে প্রায় আড়াইশ পৃষ্ঠার এই শ্রমসাধ্য অনিতিবৃহৎ কাজটিকে মহাযানী বৌদ্ধ সংস্কৃত সাহিত্য বিষয়ক বিস্তারিত আলোচনায় এক উল্লেখযোগ্য সংযোজন বলা চলে।

প্রায় দুহাজার বছর আগেকার কবি, নাট্যকার, দার্শনিক অশ্বঘোষ (আনুমানিক ৫০ খ্রিস্টাব্দ১৫০ খ্রিস্টাব্দ)-কে মনে করা হয় মহাকবি বাল্মিকী ও ব্যাসের অন্যতম যোগ্য উত্তরসুরী এবং কালিদাস, ভাস প্রমুখ কবিনাট্যকার অনুসৃত পূর্বসুরী হিসেবে। তাঁর জীবন ও কর্মের সুবিস্তৃত পরিসর নিয়ে রচিত এ বইটির ভূমিকায় ড. দেবনাথ বলেছেন:

বহুমাত্রিক জ্ঞান ও অতুলনীয় প্রতিভার অধিকারী এ প্রবাদতুল্য পুরুষ সাহিত্যের নানা ক্ষেত্রে সগৌরবে বিচরণ করেছেন এবং প্রাচীন ভারতের সাহিত্যজগতকে করেছিলেন ঋদ্ধ থেকে ঋদ্ধতর। নানা আঙ্গিকের কালজয়ী সাহিত্যকর্ম রচনা এবং কীর্তিময় কর্ম সম্পাদন পূর্বক তিনি খ্যাতি অর্জন করেছেন মহাকবি, গায়ক, সুরকার, গীতিকার, নাট্যকার, ধর্মপ্রচারক, সামাজিক এবং সাংস্কৃতিক সংগঠক হিসেবে। তাঁর কালজয়ী সাহিত্যকর্ম বৌদ্ধ ধর্মদর্শন ও প্রাচীন ভারতীয় ইতিহাসঐতিহ্য বিষয়ক আকর গ্রন্থ হিসেবে স্বীকৃত। এই কীর্তিমানের জীবন ও সাহিত্যকর্ম সম্পর্কে স্বচ্ছ ধারণা প্রদান করাই এই গ্রন্থের প্রধান উদ্দেশ্য।

মুখবন্ধ, ভূমিকা, উপসংহার ও গ্রন্থপঞ্জি ছাড়াও একাধিক উপবিভাগে বিভক্ত অশ্বঘোষের জীবনচরিত, অশ্বঘোষের প্রকৃত সাহিত্যকর্ম, অশ্বঘোষের সাহিত্যকর্মের বিষয়বস্তুর স্বরূপ ও উৎস, অশ্বঘোষের রচনাশৈলী, রচনার উদ্দেশ্য এবং স্বাজাত্যবোধ, মহাকবি হিসেবে অশ্বঘোষের মূল্যায়ন : প্রেক্ষিত বুদ্ধচরিত শিরোনামের পাঁচটি অধ্যায়ে বিস্তারিত আলোকপাতের মাধ্যমে লেখকের উদ্দেশ্য অনেকটাই সফল হয়েছে বলা চলে। অশ্বঘোষ সম্পর্কে প্রায় অপরিচিত বাংলাভাষী সাধারণ পাঠক সমাজের জন্যে এধরনের একটা পূর্ণাঙ্গ গ্রন্থের সত্যিই প্রয়োজন ছিলো।

. দেবনাথের বইটির নিয়ে অধিকতর আলোচনার আগে বৌদ্ধধর্মীয় সংস্কৃত সাহিত্য প্রসঙ্গে কিছু বলার প্রযোজন মনে করছি। আমরা জানি, মহামতি বুদ্ধ তাঁর ধর্মীয় দেশনাগুলো সাধারণের অনায়াস বোধগম্য করার খাতিরে মূলত পালি বা পল্লিভাষাতেই দিয়েছেন, যেটা সংস্কৃত ভাষারই একটি তদ্ভব রূপ। বৌদ্ধধর্মের ত্রিপিটক, ধম্মপদ প্রভৃতি আদি আকর গ্রন্থগুলো এই পালি ভাষাতেই লেখা। কিন্তু বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণের পরেরকার কয়েক শতাব্দীতে তাঁর প্রবর্তিত ধর্মটি হীনযান ও মহাযান এ দুটো শাখায় বিভক্ত হয়ে যায়। বৌদ্ধ ধর্মসাধনার আদিরূপের লক্ষ্য ও উদ্দেশ্যকে অপ্রতুল বা অসম্পূর্ণ মনে করে পরবর্তী বৌদ্ধ আচার্যদার্শনিকেরা সেটাকে ‘হীনযান’ বা নিম্নবর্গের পন্থা আখ্যা দিয়ে ‘মহাযান’ বা উচ্চতর পন্থার প্রবর্তন করেন। এই মহাযানী গ্রন্থগুলো মূলত পালিতে নয়, বরং ভারতীয় শাস্ত্রালোচনার চিরায়ত পন্থা অনুসরণে সংস্কৃতেই রচিত হয়। অশ্বঘোষ ছাড়াও বসুবন্ধু, নাগার্জুন প্রমুখ দিকপাল দার্শনিকসাহিত্যিকেরা সংস্কৃতেই দেশনা ও গ্রন্থরচনা করেছেন, যেগুলো বৌদ্ধ ধর্মীয় গ্রন্থাবলী ও সাহিত্যে মহামূল্যবান সংযোজন হিসেবে বিবেচিত হয়ে থাকে। উল্লেখ্য, বর্তমান বিশ্বে ভারত, বাংলাদেশ, মায়ানমার, থাইল্যান্ড, কম্বোডিয়া বা কম্পুচিয়া প্রভৃতি দেশের বৌদ্ধেরা হীনযানী বা থেরবাদী এবং তিব্বত, মঙ্গোলিয়া, চিন, জাপান, কোরিয়া প্রভৃতি দেশের লোকেরা মহাযানী বৌদ্ধধর্মের অনুসারী।

৪০০ খ্রিস্টপূর্বাব্দে গৌতম বুদ্ধের মহাপরিনির্বাণ বা দেহাবসানের পর তাঁর প্রবর্তিত ধর্ম হীনযান ও মহাযানে বিভক্ত হয়ে পড়ে। এ দুটো মতের মধ্যে মোদ্দা পার্থক্যগুলো হলো:

. হীনযানের মূল লক্ষ্য হলো সাধকের ব্যক্তিগত বোধিলাভ ও নির্বাণ, যেক্ষেত্রে মহাযান গুরুত্ব দেয় সমাজের সমষ্টিগত বোধি অর্জন বা বোধিসত্ত্ব আদর্শগুলোর ওপর।

. মহাযান বুদ্ধের দেবত্ব বা দৈবিসত্তায় বিশ্বাস করে, যেটা হীনযান করে না।

. ধর্মসাধনার অঙ্গ হিসেবে মহাযান বুদ্ধমুর্তির পূজাকে উৎসাহিত করে, কিন্তু হীনযান সেটা করে না।

ঐতিহাসিক দিক থেকে বৌদ্ধধর্মের প্রচার ও সম্প্রসারণে হীনযানীদের তুলনায় মহাযানীরা অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে এবং বৃহত্তর ভৌগোলিক বলয়ে বুদ্ধের বাণী পৌঁছে দিয়েছে। এক্ষেত্রে অশ্বঘোষের রচনাবলী কাজ করেছে অন্যতম প্রধান পথিকৃৎ হিসেবে। ড. দেবনাথের বক্ষ্যমাণ গ্রন্থপাঠে এ ব্যাপারে একটা পরিষ্কার ধারণা পাওয়া যাবে।

অভিসন্দর্ভটি তৈরি করার ক্ষেত্রে ড. দেবনাথ ‘বিষয়বস্তু বিশ্লেষণ’ পদ্ধতি অনুসরণ করেছেন। অর্থাৎ তিনি বহু অবান্তর বিষয়ের তুষের মধ্যে থেকে গ্রহণীয় শস্যদানাগুলো গ্রহণ করেছেন। এ ব্যাপারে তিনি বলেছেন:

গবেষণার বিষয়টি মূলতঃ সাহিত্য নির্ভর, বিবৃতিমূলক এবং সমাজ বিজ্ঞানের আওতাভূক্ত। এ কারণে গবেষণা পদ্ধতি হিসেবে ‘Content Analysis’ পদ্ধতি গ্রহণ করেছি। প্রাচীন ভারতীয় অন্যান্য কবিসাহিত্যিকের মতো অশ্বঘোষের জীবনচরিত ও সাহিত্যকর্ম বিষয়েও সৃষ্টি হয়েছে বহু জনশ্রুতি বা কিংবদন্তী। ফলে অতিরঞ্জিত ও ঐতিহাসিক তথ্যসমূহ পৃথক্‌ করার ক্ষেত্রে আমি ‘Content Analysis’ পদ্ধতি গ্রহণ করাই যুক্তিযুক্ত বলে মনে করেছি এবং উক্ত পদ্ধতি অনুসরণ করে গ্রন্থটি রচনা করেছি।

এ পদ্ধতি অবলম্বন করার কারণে বইটিতে উপস্থাপিত তথ্য ও তত্ত্বগুলো যথেষ্ট নির্ভরযোগ্য হয়ে উঠেছে। এ ব্যাপারে আগামীতে আরো যাঁরা কাজ করবেন, তাঁদের অন্যতম প্রধান আকরগ্রন্থ হিসেবে বইটি গৃহীত ও ব্যবহৃত হতে পারবে বলে আমরা বিশ্বাস রাখি।

আমাদের প্রিয় শিক্ষাঙ্গন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সম্পাদিত এধরনের একটা মহৎ গবেষণাকর্মকে আমরা গভীর শ্লাঘার বিষয় বলেও মনে করি। আমাদের মহান সাহিত্যিক ও দার্শনিক উত্তরাধিকার নিয়ে এমন কাজ যত হবে, হিংসা ও বিনষ্টির পথে উন্মত্ত ধাবমান বর্তমান দেশকালে তা ততই মঙ্গলজনক হবে, এটা আমাদের একান্ত বিশ্বাস।

বইটি লিখতে গিয়ে সংস্কৃত, পালি, তিব্বতী, চীনা, ইংরেজি প্রভৃতি ভাষা থেকে বাংলা প্রতিবর্ণিকরণের মাধ্যমে স্বভাবতই প্রচুর উদ্ধৃতি ও লেখকনাম প্রভৃতি ব্যবহার করতে হয়েছে। এটা করতে গিয়ে যথেষ্ট সাবধানতা অবলম্বন করা সত্ত্বেও থেকে যাওয়া বেশকিছু ভুলভ্রান্তি আমাদের চোখে পড়েছে, যেগুলোর অধিকাংশ প্রুফ সংশোধকের অসাবধানতা বা নিতান্তই ‘ছাপাখানার ভূত’এর কাণ্ডও হতে পারে। বইটির সম্ভাব্য আগামী সংস্করণে লেখক ও প্রকাশক এ ব্যাপারে আরো সাবধানতা অবলম্বন করবেন বলে আশা রাখি।

বুদ্ধচরিত’, ‘সৌন্দরনন্দ’ প্রভৃতি ধ্রুপদী নাটক ও কাব্যের রচয়িকা অশ্বঘোষকে নিয়ে ড. শিপক কৃষ্ণ দেবনাথের এই মহান গ্রন্থটির বহুল প্রচার প্রসার কামনা করি। বইটি ঢাকা ও চট্টগ্রামে চলমান বইমেলায় অ্যাডর্ন পাবলিকেশন্সের স্টলে পাওয়া যাচ্ছে। এ ছাড়া বিভিন্ন অভিজাত পুস্তক বিপণী থেকেও এটা সংগ্রহ করা যাবে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধএকটি সুখপাঠ্য প্রবন্ধ সম্ভার
পরবর্তী নিবন্ধসঠিক পদ্ধতি অনুসরণ করলে সুস্থ থাকা সম্ভব