জুম’আর খুতবা

কুরআন মাজীদ ও হাদীস শরীফের আলোকে রমজানুল মুবারকের ফযীলত

অধ্যক্ষ মাওলানা মুহাম্মদ বদিউল আলম রিজভি | শুক্রবার , ২৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ at ১০:৩২ পূর্বাহ্ণ

সম্মানিত মুসলিম ভাইয়েরা!

ইসলামী বর্ষের ৯ম মাস রমযান মাস আত্মশুদ্ধির মাস। রহমত, মাগফিরাত, নাজাত ও তাকওয়া অর্জনের মাস। রমযান এমন এক পবিত্র ও মহিমান্বিত মাস যার প্রতিটি মুহূর্ত বরকতময়। দিনে হোক, রাতে হোক, প্রতিটি মুহূর্ত ইবাদত করার অবারিত সুযোগ রয়েছে এখানে। রোযা ইবাদত, ইফতার করা ইবাদত, তারাবীহ্‌ ইবাদত, তারাবীহর পর কিছুক্ষণ শয়ন করা ইবাদত, সাহরি ভক্ষণ করা ইবাদত। (তাফসীরে নঈমী, আনোয়ারুল বায়ান, পৃ: ২২)

আল কুরআনের আলোকে রোজা রাখার নির্দেশনা: মহান আল্লাহ তা’য়ালা এরশাদ করেছেন ‘রমযান মাস’ হল সে মাস যাতে নাযিল করা হয়েছে কোরআন, যা মানুষের জন্য হেদায়ত এবং সত্যপথযাত্রীদের জন্য সুস্পষ্ট পথ নির্দেশ আর ন্যায় ও অন্যায়ের মাঝে পার্থক্য বিধানকারী। কাজেই তোমাদের মধ্যে যে লোক এ মাসটি পাবে সে এ মাসের রোজা রাখবে। (সূরা : আলবাক্বারা, পারা: ০২, আয়াত: ১৮৫)

হাদীস শরীফের আলোকে রমজানুল মুবারকের ফযীলত : হযরত আবূ হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সওয়াব লাভের আশায় রমযানের সিয়াম পালন করবে, তার অতীতের গুনাহ্‌ করে দেওয়া হবে। (সহীহ্‌ বুখারী শরীফ, হাদীস: ১৯০১, মুসলিম, হাদীস:১৮১৭)

হযরত আব্দুর রহমান ইবনে আউফ রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, নবী করীম সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি ঈমানের সাথে সওয়াবের আশায় রমযানের রোযা পালন করবে, সে তার পাপরাশি থেকে এভাবে বের হয়ে যাবে যেমন যেদিন তার মায়ের উদর থেকে ভূমিষ্ট হয়েছে। (সুনানু নাসাঈ, হাদীস: ২২০৮)

রোযা ইসলামের গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ: পবিত্র রমযানে দীর্ঘ একমাস সিয়াম সাধনা করা ফরয। রোযা হলো খোদাভীতি অর্জন ও ইবাদতের সুনিবিড় অনুশীলন। সংযম ও আত্মনিয়ন্ত্রণের মাস ব্যাপী প্রশিক্ষণ কোর্স রমযান। তাকওয়া অর্জন রোযার অন্যতম উদ্দেশ্য। তাকওয়া অর্থ আত্মরক্ষা করা, বেঁচে থাকা, আল্লাহর ভয়ে সকল প্রকার অন্যায় পাপাচার, অশ্লীলতা ও অসামাজিক, অনৈতিক ও অনৈসলামিক কাজ থেকে সম্পূর্ণরূপে বিরত থাকাই তাকওয়া। যে পঞ্চ বুনিয়াদের উপর ইসলামের সুবিশাল ইমারত বিনির্মিত, রোযা এর মধ্যে গুরুত্বপূর্ণ স্তম্ভ।

মিথ্যাচার ও পাপাচার ত্যাগ না করে পানাহার ত্যাগের নাম সিয়াম সাধনা নয়: ব্যক্তি জীবনে, সমাজ জীবনে, পারস্পরিক লেনদেনে আলাপচারিতায়, ব্যবহারে আচরণে, কথনে, বলনে, মিথ্যাচার পরিত্যাগ করতে না পারলে রোযা পালন বা সিয়াম সাধনা অর্থহীন। অন্যায়অপকর্ম, সুদ, ঘুষ, মদ, জুয়া, মানুষের ক্ষতিসাধন, অপরকে কষ্ট দেয়ার মনমানসিকতা পরিত্যাগ করতে না পারলে এমন সিয়াম আল্লাহর প্রয়োজন নেই। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু তাআলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, যে ব্যক্তি মিথ্যা এবং তদানুযায়ী কাজ পরিত্যাগ করতে পারলনা, তবে এমন ব্যক্তির পানাহার পরিত্যাগ করার আল্লাহর কোন প্রয়োজন নেই। (তিরমিযী : হাদীস : ৭০৭, ইবনে মাযাহ্‌, হাদীস : ১৬৮৯।)

পবিত্র রমযানের বহুমাত্রিক তাৎপর্য প্রসঙ্গে রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম’র অমূল্য ভাষণ: পবিত্র রমযানের গুরুত্ব ও তাৎপর্য প্রসঙ্গে প্রিয় রাসূল সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লামের প্রদত্ত অমূল্য ভাষণে রয়েছেজাগতিক ও আধ্যাত্মিক উন্নতি। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত সালমান ফারসী রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, তিনি বলেন, শা’বানের শেষ দিন রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম আমাদের উদ্দেশ্যে ভাষণ দিলেন, ‘হে মানবমণ্ডলী! তোমাদের মাঝে এক মহা বরকতময় মাস ছায়া বিস্তার করেছে (আগমন করেছে) এটা এমন মাস যে মাসে রয়েছে হাজার হাসের চেয়ে শ্রেষ্ঠ একটি রজনী। এ মাসে সিয়াম পালন করা আল্লাহ ফরজ করে দিয়েছেন। এর রাতসমূহে (তারাবীহর) দাঁড়ানোকে নফল ইবাদত হিসেবে নির্দিষ্ট করেছেন। যে ব্যক্তি এ মাসে আল্লাহর নৈকট্য লাভের উদ্দেশ্যে একটি নফল কাজ করল, সে ঐ ব্যক্তির সমান সওয়াব পেল যে অন্য মাসে একটি ফরজ আদায় করল। আর যে ব্যক্তি এ মাসে একটি ফরজ আদায় করল সে ঐ ব্যক্তির সমান সওয়াব পেল যে অন্য মাসে সত্তরটি ফরজ আদায় করল। এটি সবরধৈর্যধারণের মাস, সবরের প্রতিদান হলো জান্নাত। এটি পারস্পরিক সহানুভূতি সহমর্মিতার মাস। এটি সেই মাস যে মাসে মু’মিনের রিযক্ব বৃদ্ধি করা হয়, যে ব্যক্তি এ মাসে কোন রোজাদারকে ইফতার করাবে, তা তার যাবতীয় গুনাহসমূহ (ছগীরা গুনাহ্‌) ক্ষমা এবং জাহান্নামের আগুন থেকে মুক্তির কারণ হবে। এ ছাড়া তার সাওয়াব হবে রোযা পালনকারীর সমান অথচ রোজাদারের সওয়াব বিন্দুমাত্র হ্রাস করা হবেনা। আমরা বললাম ইয়া রাসূলাল্লাহ্‌! আমাদের প্রত্যেক ব্যক্তি তো রোজাদারকে ইফতার করানোর সামর্থ রাখেনা, নবীজী বললেন, আল্লাহ্‌ পাক এ সওয়াব সেই ব্যক্তিকেও দান করবেন, যে লোক কোন রোযাদারকে এক চুমুক অথবা একটি খেজুর অথবা এক ঢোক পানি দ্বারা ইফতার করাবে। আর যে ব্যক্তি কোন রোযাদারকে পরিতৃপ্তভাবে খাওয়াবে আল্লাহ্‌ তা‘আলা তাকে আমার হাউজ (কাউসার) থেকে এমন পানীয় পান করাবেন, যার ফলে জান্নাতে প্রবেশের পূর্ব পর্যন্ত সে আর পিপাসার্ত হবে না। এটি এমন এক মাস যার প্রথম ভাগ রহমতের, মধ্যভাগ মাগফিরাতের, শেষভাগ জাহান্নাম থেকে পরিত্রাণের। আর যে ব্যক্তি এ মাসে নিজের অধীনস্ত লোকদের কার্যভার হালকা করে দিবে, আল্লাহ্‌ তাকে ক্ষমা করবেন এবং তাকে জাহান্নাম থেকে পরিত্রাণ ও মুক্তি দান করবেন। (বায়হাকী, শু‘আবুল ঈমান, মিশকাত, হাদীস : ১৮৬৮)

সিয়াম ও কুরআন কিয়ামত দিবসে সুপারিশ করবে: একমাত্র আল্লাহর ভয়ে দিনের বেলা খাওয়ার সুযোগ থাকা সত্ত্বেও রোযাদার পানাহার থেকে বিরত থাকে, রাতের বেলা এশা সালাত শেষে শরীর যখন ক্লান্ত, শারীরিক বিশ্রাম ত্যাগ করে কুরআন তিলাওয়াতের মাধ্যমে, খতমে তারাবীহতে অংশ গ্রহণ করে, একাধারে বিশ রাকাত তারাবীহ্‌ নামায কুরআনের তিলাওয়াত শ্রবণ করে ঈমানী চেতনাকে উজ্জীবিত করে অন্তরাত্মা আলোকিত করে, মহান আল্লাহ্‌ এ আমলের উত্তম প্রতিদান দিয়ে বান্দাকে ধন্য করবেন, বিনিময়ে পবিত্র রমযান ও কুরআন বান্দার জন্য সুপারিশ করবে। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, সাওম ও কুরআন কিয়ামত দিবসে বান্দার জন্য (আল্লাহর নিকট) সুপারিশ করবে। রোযা বলবে, হে আমার প্রভূ! আমি তাকে দিনের বেলা খাদ্য গ্রহণ ও প্রবৃত্তি চরিতার্থ করা থেকে বাধা দিয়েছিলাম। সুতরাং তার ব্যাপারে আমার সুপারিশ কবুল করুন।

প্রতিটি আমল নিজের জন্য রোযা আল্লাহরই জন্য: নামায, রোজা, হজ্ব, যাকাত, দান সাদকা, পিতামাতার সেবা, জনসেবা, সমাজসেবা, দ্বীনের খিদমত ইত্যাদি নেক আমলের বিনিময়ে জান্নাত পাওয়া যায়। কিন্তু রোজা এমন এক ইবাদত যে আমলের বিনিময়ে জান্নাতের মালিককে পাওয়া যায়। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত আবু হুরায়রা রাদ্বিয়াল্লাহু তা‘আলা আনহু থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ্‌ সাল্লাল্লাহু তা‘আলা আলায়হি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, মহান আল্লাহ্‌ বলেন, আদম সন্তানের প্রতিটি আমলই তার নিজের জন্য রোজা ব্যতীত। রোজা আমার জন্য। তাই আমি এর প্রতিদান নিজ হাতে দেবো। (সহীহ্‌ বুখারী, হাদীস : ১৯০৪)

অন্য একটি হাদীসে রয়েছে, প্রত্যেক আমলের জন্যই কাফ্‌ফারা রয়েছে, আর রোজা হচ্ছে আমার জন্য আমিই এর প্রতিদান দেবো। (সহীহ্‌ বুখারী, হাদীস: ৭৫৩৮), মহান আল্লাহ্‌ আমাদের সিয়াম পালন ও রমজানের পবিত্রতা রক্ষা করার তাওফিক দান করুন। আমিন।

লেখক: অধ্যক্ষ, মাদরাসাএ তৈয়্যবিয়া ইসলামিয়া সুন্নিয়া ফাযিল (ডিগ্রী), বন্দর, চট্টগ্রাম; খতীব, কদম মোবারক শাহী জামে মসজিদ।

 

মুহাম্মদ জাহিদুল ইসলাম

কুলগাঁও, বায়েজিদ, চট্টগ্রাম।

প্রশ্ন: সারা বিশ্বে একই দিনে রোজা পালন করা কতটুকু শরীয়ত সম্মত? সংক্ষেপে জানালে কৃতার্থ হব।

উত্তর: পবিত্র কুরআনে চাঁদ দেখার বিধান প্রসঙ্গে আল্লাহ তা’আলা এরশাদ করেছেন, হে প্রিয় হাবীব, আপনাকে নতুন চাঁদ সম্পর্কে (তারা) জিজ্ঞেস করছে, আপনি বলুন, সেটা সময়ের কতগুলো প্রতীক মানবজাতি ও হজ্বের জন্য। (সূরা: বাক্বারা, পারা: ০২, আয়াত: ১৮৯)

ভৌগলিক কারণে দেশে দেশে চাঁদ দেখার ভিন্নতা হয়ে থাকে। যে দেশে যখন চাঁদ দেখা যায় সে অনুযায়ী রোযা ও ঈদ পালনে শরীয়তের নির্দেশ রয়েছে। হাদীস শরীফে এরশাদ হয়েছে, হযরত আবু হুরায়রা (রা.) থেকে বর্ণিত, রাসূলুল্লাহ সাল্লাল্লাহু আলাইহি ওয়াসাল্লাম এরশাদ করেছেন, তোমরা চাঁদ দেখে রোজা রাখো, চাঁদ দেখে রোজা ছাড়ো, যদি আকাশ মেঘাচ্ছন্ন থাকে তবে শাবান মাস ত্রিশ দিনে পূর্ণ করো। (বুখারী ও মুসলিম)

চান্দ্রমাস প্রমাণিত হওয়ার জন্য চাঁদ দেখার সাথে সম্পৃক্ত। শাবানের ঊনত্রিশ তারিখ সূর্যাস্তের সময় চাঁদ দেখা ওয়াজিবে কেফায়া। চাঁদ দেখা গেলে রোজা রাখা আরম্ভ করবে। (আলমগীরি ১/২১৭, বাহারে শরীয়ত, ৫ম খন্ড, পৃ: ১৩৪)

সুতরাং সারা বিশ্বে একই দিনে রোজা ও ঈদ পালন করার দাবী অযৌক্তিক ও বাস্তবতা বিরোধী। জ্যোতিবিদ্যার আলোকে একথা বলা যে, চাঁদ উদিত হয়েছে বা হয়নি তা গ্রহণ যোগ্য নয়, যেহেতু চাঁদ দেখা বা সাক্ষী দ্বারা প্রমাণই বিবেচ্য। (আলমগীরি, বাহারে শরীয়ত, ৫ম খন্ড, পৃ: ১৩৫)

পূর্ববর্তী নিবন্ধআবদুল্লাহ আল নোমান : এক পরিশীলিত রাজনীতিবিদ
পরবর্তী নিবন্ধইসহাক নুর ফাউন্ডেশনের ইফতার সামগ্রী বিতরণ