চট্টগ্রাম দেশের অর্থনৈতিক স্নায়ু কেন্দ্র হলেও বাণিজ্যিক রাজধানী কেবল ঘোষণা হয়েই রইলো

এম এ আই ফিরোজ চাষী | বৃহস্পতিবার , ২৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ at ৬:০৬ পূর্বাহ্ণ

দেশের বৃহত্তম সমুদ্রবন্দর চট্টগ্রাম। এটি দেশের দ্বিতীয় বৃহত্তম বাণিজ্যিক শহরও বটে। আবার এই চট্টগ্রামকেই বলা হয় প্রাচ্যের রানি। এটি দেশের ব্যবসাবাণিজ্যের অন্যতম প্রধান কেন্দ্র। উপমহাদেশের বৃহত্তম শিপইয়ার্ডও এই চট্টগ্রামে। দেশের আমদানিরপ্তানি পণ্যের ৯৩ শতাংশ পরিবহন হয় এই চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে। চট্টগ্রাম বন্দর ও কাস্টম হাউসের মাধ্যমে সরকারের প্রায় ৬৫% রাজস্ব অর্জিত হয়। ভৌগোলিক অবস্থানের দিক থেকেও চট্টগ্রাম অনন্য। ফলে ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদরা মনে করেন, চট্টগ্রামের উন্নয়ন মানেই দেশের উন্নয়ন। বিশ্বব্যাপী বন্দর শহরগুলোকে দেশের অর্থনৈতিক উন্নয়নে বিশেষ গুরুত্ব দেওয়া হয় এবং এই শহরগুলোকে বাণিজ্যিক রাজধানী হিসেবেই গড়ে তোলা হয়। উদাহরণস্বরূপ, মুম্বাই এবং নিউইয়র্ককে শুধুমাত্র সমুদ্রবন্দর থাকার জন্য অগ্রাধিকার দেয়া হয়। তাই চট্টগ্রাম বাংলাদেশের বাণিজ্যিক রাজধানী হওয়ার ক্ষেত্রে বিপুল সম্ভাবনা রয়েছে।

চট্টগ্রাম বন্দরটি খ্রিস্টপূর্ব ৪র্থ শতাব্দী থেকে চালু রয়েছে এবং আধুনিক সময়ে ব্রিটিশ ভারতে ১৮৮৭ সালের পোর্ট কমিশনারস অ্যাক্ট অনুসরণ করে পোর্ট কমিশনার এবং পোর্ট রেলওয়ে দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হয়। ১৯৪৭ সালে দেশভাগ এবং পরবর্তীকালে বন্দর ট্রাফিক বৃদ্ধির পর, আধুনিক চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ ১৯৬০ সালে চট্টগ্রাম পোর্ট ট্রাস্ট হিসাবে তার অস্তিত্ব শুরু করে। ক্রমাগত সমপ্রসারণ এবং কার্যকর শাসনের অভাবের কারণে, বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের পর পোর্ট ট্রাস্টকে সরকারের মধ্যে আধাস্বায়ত্তশাসিত মর্যাদা দেওয়া হয় এবং ১৯৭৬ সালে চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষের নামকরণ করা হয়।

চট্টগ্রাম বর্তমানে শিল্প উৎপাদনের ৪০ শতাংশ, আন্তর্জাতিক বাণিজ্যের ৮০ শতাংশ এবং সরকারের রাজস্বের ৫০ শতাংশ উৎপন্ন করে। শত শত বছর ধরে, চট্টগ্রাম এই অঞ্চলের অর্থনীতির একটি অনিবার্য অংশ। কিন্তু চট্টগ্রাম বিশ্বের অন্যান্য বাণিজ্যিক কেন্দ্রের মতো গড়ে ওঠেনি। শুধু বাংলাদেশের অর্থনীতিতে নয়, আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও উন্নয়নেও বন্দরনগরী চট্টগ্রামের কৌশলগত গুরুত্ব রয়েছে। আঞ্চলিক সংযোগে এটি অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে।

চট্টগ্রামকে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক রাজধানী হিসাবে বলা হয়ে থাকে। তবে ‘বাণিজ্যিক রাজধানী’ শিরোনামটিকে রাজনৈতিক হাতিয়ার হিসাবেই ব্যবহৃত একটি শ্লোগান বলা যেতে পারে। এটা সত্য যে, বাণিজ্যিক রাজধানী হিসাবে এ শহরকে রূপান্তর করতে বিগত কোনো সরকারই প্রয়োজনীয় কোনো পদক্ষেপ এবং নীতিমালা গ্রহণ করেনি। তাই কেবল তত্ত্বের ক্ষেত্রেই বলা যেতে পারে বাংলাদেশের বাণিজ্যিক রাজধানী চট্টগ্রাম।

যদিও চট্টগ্রাম এর ভৌগলিক অবস্থান, ভারতীয় উপমহাদেশ এবং দক্ষিণ এশিয়া জুড়ে আঞ্চলিক সংযোগে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে থাকে। উত্তরপূর্ব ভারত, মিয়ানমার, নেপাল, ভুটান এবং দক্ষিণপূর্ব চীনের জন্য একটি বিশ্বব্যাপী আর্থিক কেন্দ্র এবং আঞ্চলিক ট্রান্সশিপমেন্ট হওয়ার সম্ভাবনা রয়েছে বাণিজ্যিক রাজধানী অভিহিত এই চট্টগ্রামে। ব্রিটিশ এমনকি পাকিস্তানী শাসন আমলেও ভৌগলিক অবস্থানের কারণে সম্ভাবনাময় বিবেচনা করে, চট্টগ্রামকে অগ্রাধিকার দেয়া হয়েছিল। বিশ্বব্যাপী বন্দর শহরগুলিকে দেশগুলির অর্থনৈতিক উন্নয়নের জন্য বিশেষ গুরুত্ব দেয়া হয় এবং এই শহরগুলি বাণিজ্যিক রাজধানী বা কেন্দ্র হিসাবে বিকশিতও হয়।

বাংলাদেশের বাণিজ্যিক রাজধানী হওয়ার জন্য চট্টগ্রামের সকল সম্ভাবনা রয়েছে। চট্টগ্রামের প্রাকৃতিক সুবিধাগুলিযেমন বিশ্বের ১০০ শীর্ষতালিকাভুক্ত সমুদ্রবন্দর, ভৌগলিক অবস্থান এবং একটি গভীর সমুদ্র বন্দরের সম্ভাবনার কারণে রাজনৈতিক নেতারা এবং নীতিনির্ধারকরা চট্টগ্রামকে একটি বাণিজ্যিক রাজধানীতে পরিনত করতে আগ্রহী হন। তদুপরি চট্টগ্রামে নদীর সংযোগ, পর্যটন, অর্থনীতি এবং বিদ্যুৎ উৎপাদন করার সুযোগের বিশাল সম্ভাবনা রয়েছে। ব্যবসায়ীদের মতে, প্রায় ৯৮% কনটেইনার রপ্তানি এবং আমদানি চট্টগ্রাম বন্দরের মাধ্যমে পরিচালিত হয়। বাংলাদেশের অন্যতম বৃহত্তম রপ্তানি প্রক্রিয়াকরণ অঞ্চল, সিতাকুন্ড, কালুরঘাট এবং ভারী শিল্প অঞ্চল, ২টি বিশাল ডিপো, জ্বালানী তেল, ২টি গ্যাস ক্ষেত্র, ২২টি চা বাগান এবং একটি প্রধান চা নিলাম কেন্দ্র সমুদ্রবীর চট্টগ্রামেই অবস্থিত।

এস এম সিরাজুদ্দৌলার নেতৃত্বে এক সময় গঠিত হয়েছিল, বাণিজ্যিক রাজধানী বাস্তবায়ন পর্ষদ (বারাবাপ) নামের একটি সংগঠন। বেশ তৎপর থাকলেও এখন নিষ্ক্রিয় বলা চলে। তবে এ সংগঠনের সাথে নির্বাহী প্রধান হিসাবে বিশিষ্ট ইতিহাসবিদ, চট্টলার কৃতি সন্তান ও সাবেক উপাচার্য অধ্যাপক আবদুল করিম যুক্ত ছিলেন। তিনি বলেছেন, রাজনৈতিক দলগুলি কেবল ক্ষমতায় উঠতে নানা প্রতিশ্রুতি দিতে থাকে, ক্ষমতায় গিয়ে তারা তাদের সমস্ত প্রতিশ্রুতি পরে ভুলে যায়। এটা বলার অপেক্ষা রাখে নাসমস্ত সম্ভাবনা থাকা সত্ত্বেও, চট্টগ্রাম নিয়ে সরকারি নীতিনির্ধারকদের অবহেলা অব্যাহত আছে। এটি দেশের বাণিজ্যিক কেন্দ্র করার আগে শহরটিকে আরো অনেক দীর্ঘ পথ পাড়ি দেয়ার প্রয়োজন রয়েছে।

বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরী কমিশন (ইউজিসি) এর অর্থনীতির অধ্যাপক ড. মুইনুল ইসলাম বলেছেন, চট্টগ্রামকে বাণিজ্যিক রাজধানীর মর্যাদা দেয়ার জন্য নীতি ও ধারণাগুলির যথাযথ বাস্তবায়নে অবহেলা ছিল। অবকাঠামোগত উন্নয়ন ছাড়া লক্ষ্য অর্জন করা সম্ভব নয়। উপাচার্য অধ্যাপক মুহাম্মদ সিকান্দার খান উল্লেখ করেছেন, একটি শহরে একটি বাণিজ্যিক কেন্দ্র হওয়ার জন্য প্রাকৃতিক, প্রশাসনিক এবং আর্থিক এই তিন ধরণের সমর্থন প্রয়োজন। চট্টগ্রামে সমস্ত প্রাকৃতিক উপাদান রয়েছে, তবে প্রশাসনিক ও আর্থিক সহায়তার ক্ষেত্রে বিশাল অনুপস্থিতি বিদ্যমান। চট্টগ্রামকে বাণিজ্যিক রাজধানীর মর্যাদা দিতে নীতি ও ধারণার যথাযথ বাস্তবায়নে গাফিলতিও রয়েছে।

বলার অপেক্ষা রাখেনা, চট্টগ্রাম বাংলাদেশের অর্থনৈতিক স্নায়ু কেন্দ্র। ব্যবসায়ে রপ্তাানি ও আমদানির জন্য প্রায় ৫৫ টি পরিসেবা প্রয়োজন, এই পরিসেবাগুলির অর্ধেকটাই চট্টগ্রামে অনুপস্থিত। চট্টগ্রামে একটি বন্দর রয়েছে, যদিও এটির ব্যবসায়িক সকল কার্যক্রম ঢাকা থেকে পরিচালিত হয়। নৌ বা বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ের একটি শাখা বা ডেস্ক পর্যন্ত চট্টগ্রামে নেই। এছাড়াও, ব্যাংক বা বীমা সংস্থাগুলির একটি প্রধান অফিস চট্টগ্রামে নেই। ইউনিলিভার বাংলাদেশ, বার্জার পেইন্টস, স্ট্যান্ডার্ড চার্টার্ড ব্যাংকর মতো স্থানীয় এবং আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন ব্র্যান্ডগুলি চট্টগ্রামে তাদের যাত্রা শুরু করেছিল। প্রথম রেডিমেড গার্মেন্টস কারখানাটিও চট্টগ্রাম সেটআপ করা হয়েছিল। তবে শেষ পর্যন্ত তাদের সকলকে তাদের ব্যবসাসংক্রান্ত কার্যক্রম রাজধানীতে কেন্দ্রীভূত করায় তাদের ব্যবসাগুলি ঢাকায় স্থানান্তর করতে তারা বাধ্য হয়েছে।

রাজনৈতিক দল হিসেবে বিএনপিই প্রথম চট্টগ্রামকে বাণিজ্যিক রাজধানী করার প্রতিশ্রুতি দিয়ে ঐতিহাসিকভাবে তাদের রাজনৈতিক দায়িত্বশীলতার পরিচয় দিয়েছে। কিন্তু তার যথাযথ বাস্তবায়নে ছিল অনেকটাই অনগ্রসর। কথা হলো, যা বাস্তবায়ন করতে পারবেন না, তার ঘোষণা দেয়ার সাহসটা দেখালেন কেন? মনে রাখা দরকার, ১৯৯১ সালে জাতীয় নির্বাচনের সময় চটজলদি করে বিএনপি প্রথম রাজনৈতিক দল হিসাবে চট্টগ্রামকে বাণিজ্যিক রাজধানী করার প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল। নির্বাচনের পর ক্ষমতায় এসে চট্টগ্রামে বিএনপি সরকারের ৮ জন দায়িত্বশীল মন্ত্রী নিয়োগ পেলেও, বাণিজ্যিক রাজধানী ঘোষণার মধ্যেই থেকে গেছে।

২০০৯ এর পরে চট্টগ্রাম বন্দরের উন্নয়নের জন্য অনেক মেগা প্রকল্প নেয়া হয়েছে। তবে বিমানবন্দর উন্নয়ন, বন্দরের অবকাঠামো বিকাশ, গ্যাসবিদ্যুৎপানির স্থবিরতা সংকট সমাধানসহ কিছু সড়ক এবং জলপথ সংযোগ দরকার ছিল। কর্ণফুলি টানেল, বে টার্মিনাল, টুইন সিটি প্রজেক্ট, মেরিন ড্রাইভ রোড, এলএনজি টার্মিনাল, গভীর সমুদ্রবন্দর, কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎকেন্দ্র এবং মিরেরসরাইয়ে বিশেষায়িত অর্থনৈতিক অঞ্চলসহ মেগা প্রকল্পগুলি গৃহীত হয়। এখন বাণিজ্যিকভাবে গুরুত্বপূর্ণ অফিসগুলি, সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়, ব্যাংক এবং সংশ্লিষ্ট বিভিন্ন প্রধান কার্যালয়গুলিকে চট্টগ্রামে স্থানান্তরিত করার জন্য সরকারের এখনই পদক্ষেপ নেয়া দরকার।

এই পরিপ্রেক্ষিতে, জাতীয় অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি ত্বরান্বিত করার লক্ষ্যে, আঞ্চলিক অর্থনৈতিক সহযোগিতার জন্য চট্টগ্রামের কৌশলগত সুবিধাগুলিকে কাজে লাগানোর সময় এসেছে। প্রশাসনিক পুঁজি থেকে বাণিজ্যিক পুঁজিকে ধীরে ধীরে বিচ্ছিন্ন করার দিকে এগিয়ে যাওয়া সময়ের দাবি। এ জন্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে ঐতিহ্যগত প্রয়োজনভিত্তিক জাতীয় বিনিয়োগের পরিবর্তে রাজনৈতিক প্রশাসনিক পুনর্গঠনের পাশাপাশি একটি সুপরিকল্পিত, নিয়মতান্ত্রিক ও সমন্বিত জাতীয় বিনিয়োগ খুবই জরুরি। বিভিন্ন বাস্তবায়ন মডিউলসহ উন্নয়ন বাজেটে বিশেষায়িত সেগমেন্ট আমাদের রাজনৈতিক নেতারা বিবেচনা করতে পারেন।

লেখক: সমাজচিন্তক ও সাংবাদিক।

পূর্ববর্তী নিবন্ধএকটি বাংলাদেশ
পরবর্তী নিবন্ধবৈষম্যমুক্ত সমাজ বিনির্মাণে যাকাতের ভূমিকা