ক্যানসার প্রতিরোধে সচেতনতা ও সরকারের উদ্যোগী ভূমিকা

রেজাউল করিম স্বপন | মঙ্গলবার , ২৫ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ at ৮:৩৯ পূর্বাহ্ণ

ক্যানসার প্রাণঘাতী একটি রোগ। প্রতি বছর বিশ্বে লাখ লাখ মানুষ এই রোগে আক্রান্ত হয়ে মারা যায়। প্রাথমিক অবস্থায় শনাক্ত করা গেলে অনেক ক্ষেত্রে এই রোগ নিয়ন্ত্রণ করা গেলেও থার্ড বা ফোর্থ স্টেজের রোগীর নিরাময় করা দুরূহ। তবে আশার কথা হচ্ছে পৃথিবী জুড়ে বিভিন্ন দেশে ক্যানসার প্রতিরোধের টিকা আবিষ্কারের জন্য জোর প্রচেষ্টা চলছে। হয়তো কয়েক বছরের মধ্যে এর টিকা আবিষ্কার করা হতে পারে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন বিশেষজ্ঞরা। প্রশ্ন হলো ক্যানসার কেন হয়? এ নিয়ে রয়েছে নানান মতবাদ ও গবেষণা প্রতিবেদন।তবে অনেকেই এই ব্যাপারে একমত যে, বেশিরভাগ ক্ষেত্রে খাদ্যাভাসের জন্য মানুষের শরীরে ক্যানসারের সৃষ্টি হয়। আমাদের দেশে খাদ্য হিসাবে আমরা যা গ্রহণ করি, বিশেষ করে জ্যাংক ফুড, অতিরিক্ত তেল/চর্বিযুক্ত ও অধিক মসল্লাযুক্ত ও ক্যমিক্যালযুক্ত খাদ্য, রেড মিট, ধুমপান ও কার্বোহাইড্রেট (ভাত, রুটি, আলু) এবং চিনি (যেটিকে সাদা বিষ বলা হয়), তা পাকস্থলীতে পরিপাক হওয়ার পরএর জিস্ট কোষে নিঃসরিত হয়। প্রতিটি কোষের একটা নিদিষ্ট পরিমানের চাহিদা রয়েছে। কিন্তু অতিরিক্ত খাদ্য গ্রহণের ফলে যে অতিরিক্ত জিস্ট উৎপন্ন হয় তার সবটুকু কোষ গ্রহণ করতে পারে না। সেই বাড়তি জিস্ট তখন শরীরের কোষের ফাঁকে গিয়ে জমা হয়। এগুলো দীর্ঘ সময় ধরে কোষের ফাঁকে জমা হতে থাকলে একসময় তা শক্তিশালী হয়ে পাশে থাকা কোষকে আক্রমণ করে ক্ষতিগ্রস্ত বা গ্রাস করে ফেলে। আর শরীরের যে কোনো অংশের কোষ ক্ষতিগ্রস্ত হয়ে অস্বাভাবিক বৃদ্ধি বা আচরণ করলে সেটিই ‘ক্যানসার’ রোগ।

উন্নত বিশ্বের মানুষ পরিমিত খাদ্য গ্রহণের সাথে ব্যায়াম ও কায়িক পরিশ্রমের মাধ্যমে শরীরের অতিরিক্ত চর্বি বা মেদ ঝরিয়ে রোগমুক্ত দীর্ঘ জীবন লাভ করে। কিন্তু তৃতীয় বিশ্বের অসচেতন জনগণ সেটি না বুঝে অস্বাস্থ্যসম্মত ইনব্যালেন্স খাদ্য গ্রহণ করে ক্যানসার ও ডায়াবেটিসসহ বিভিন্ন প্রাণঘাতী রোগে আক্রান্ত হয়। সেজন্য এসব দেশে ক্যানসার রোগে আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা অত্যধিক বেশি। বাংলাদেশেও ক্যানসার আক্রান্ত রোগীর সংখ্যা বেশি।

সমপ্রতি এক গবেষণায় জনসংখ্যাভিত্তিক ক্যানসার নিবন্ধনে দেখা গেছে, বাংলাদেশের একটি এলাকায় বছরে এক লাখ মানুষের মধ্যে নতুন ক্যানসার শনাক্ত হয়েছে ৫৩ জনের। এর মধ্যে পুরুষের স্বরযন্ত্রের ক্যানসার বেশি আর নারীদের বেশি স্তন ক্যানসার। ঐ এলাকায় যত মৃত্যু হচ্ছে, তার ১২% পেছনে রয়েছে ক্যানসার রোগ।

জনসংখ্যাভিত্তিক ক্যানসার নিবন্ধনের কাজটি করেছে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয়ের (বিএসএমএমইউ) পাবলিক হেলথ অ্যান্ড ইনফরমেটিকস বিভাগের শিক্ষক ও গবেষকেরা। কয়েকদিন আগে এক অনুষ্ঠানে এই নিবন্ধনের তথ্য উপস্থাপন করা হয়। ঐ অনুষ্ঠানে উপস্থিত বিশেষজ্ঞরা বলেন, জনসংখ্যাভিত্তিক ক্যানসার নিবন্ধনের তথ্য ক্যানসার প্রতিরোধ, প্রতিকার ও চিকিৎসায় ভূমিকা রাখবে।এই নিবন্ধন আরও বড় পরিসরে করা প্রয়োজন।

বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থার হিসাব অনুযায়ী (২০২২ সালের প্রতিবেদন) বাংলাদেশে প্রতিবছর ক্যানসারে আক্রান্ত হয় ১,৬৭,২৫৬ জন মানুষ। তখন জন সংখ্যা অনুসারে প্রতি লাখে ১০০ জন নতুন ক্যানসার রোগী দেখা যায়।

মূল উপস্থাপনায় বলা হয়, কিশোরগঞ্জ জেলার হোসেনপুর উপজেলায় ৪৬,৬৩১টি পরিবারের ২,০১,৬৬৮ জনকে তাঁরা গবেষণার আওতায় নিয়েছেন। তাতে দেখা গেছে, ২১৪ জনের কোনো না কোনো ক্যানসার আছে। অর্থাৎ প্রতি এক লাখ মানুষের মধ্যে ক্যানসারে আক্রান্ত ১০৬ জন। এতো দিন দেশে জনসংখ্যাভিত্তিক ক্যানসারের কোনো তথ্য বা পরিসংখ্যান ছিল না। কত মানুষ ক্যানসারে আক্রান্ত, কোন ক্যানসারে কত মানুষ বেশি ভুগছেন, তা বলা হতো অনুমিত হিসাব থেকে। বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থাও বাংলাদেশে ক্যানসারের অনুমিত হিসাব ব্যবহার করে। বাস্তব অবস্থা বোঝার উপায় হচ্ছে জনসংখ্যাভিত্তিক ক্যানসার নিবন্ধন। যা এই গবেষণায় করা হলো। তবে বেদনাদায়ক হচ্ছে ৭% কিছু বেশি ক্যানসার রোগী কোনো ধরনের চিকিৎসা নেন না। অনুষ্ঠানে বিশেষজ্ঞরা বলেন, মানুষের মধ্যে ক্যানসারের প্রকোপ বুঝতে হলে জনসংখ্যাভিত্তিক ক্যানসার নিবন্ধন থাকা প্রয়োজন। ভারত, শ্রীলঙ্কা, নেপাল, পাকিস্তান এমনকি আফগানিস্তানেও জনসংখ্যা ভিত্তিক ক্যানসার নিবন্ধন থাকলেও বাংলাদেশে তা এতোদিন ছিল না।

গবেষকরা কিশোরগঞ্জের হোসেনপুর উপজেলায় ২০২৩ সালের জুলাই থেকে ক্যানসার নিবন্ধন শুরু করেন। এরপর ২০২৪ সালের ১ জুলাই থেকে এ বছরের ১৪ জানুয়ারি পর্যন্ত আরও ১৩,৪১১টি পরিবারের তথ্য দ্বিতীয়বার নেন বা ফলোআপ করেন। সব তথ্যই উক্ত অনুষ্ঠানে উপস্থাপন করা হয়। এতে দেখা যায়, হোসেনপুরের মানুষের মধ্যে ৩৮ ধরনের ক্যানসারের সন্ধান পাওয়া গেছে। ক্যানসার রোগীদের ৯৩% বয়স ১৮ থেকে ৭৫ বছরের মধ্যে। তবে ১৮ বছরের কম বয়সের বেশ কয়েকজন ক্যানসার রোগীও আছেন।

নিবন্ধনের তথ্য পর্যালোচনায় দেখা গেছে,পুরুষের মধ্যে পাঁচটি ক্যানসার বেশি।এর মধ্যে আছে স্বরযন্ত্র ১৩%,পাকস্থলী ১০.%,ফুসফুস ৮.%, ঠোঁট ও মুখগহ্বর ৭% এবং খাদ্যনালির ৬.%। নারীদের প্রধান পাঁচটি ক্যানসারের মধ্যে আছে স্তন ৩৬.%, জরায়ুমুখ ১১.%, ঠোঁট ও মুখগহ্বর ১০.%, থাইরয়েড ৭.% এবং ডিম্বাশয়ের ৫.%

গবেষণায় দেখা যায়, ক্যানসারের রোগীদের মধ্যে ১৭% উচ্চ রক্তচাপ, ১১% ডায়াবেটিস, % হৃদরোগ এবং ৩% কিডনি রোগ আছে। ২% ক্যানসার রোগীর স্ট্রোকের ইতিহাস আছে। প্রায় ৭৬% পুরুষ ক্যানসার রোগীর ধূমপানের ইতিহাস আছে।

মুক্ত আলোচনায় একাধিক অংশগ্রহণকারী বলেন, সারা দেশের পরিস্থিতি বোঝার জন্য এ ধরনের নিবন্ধন আরো বড় পরিসরে হওয়া প্রয়োজন। একটি দেশের পরিস্থিতি জানাবোঝার জন্য অন্তত পাঁচ লাখ মানুষকে গবেষণার আওতায় নিতে হয়। এই গবেষণায় দুই লাখ মানুষের তথ্য নেওয়া হয়েছে। কেউ কেউ বলেন, বিএসএমএমইউর এই কাজ যেন অর্থের অভাবে বন্ধ হয়ে না যায়, সে ব্যাপারে সরকারের উদ্যোগী ভূমিকা দরকার।

অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথি বলেন, নিত্যনতুন জ্ঞান তৈরিতে গবেষণার বিকল্প নেই। বিএসএমএমইউ থেকে সেই গবেষণা হওয়া উচিত, যা রোগীদের কল্যাণে কাজে আসে। যেসব গবেষণা দেশের মানুষের, দেশের রোগীদের উপকার হবে, সে ক্ষেত্রে সরকারের সহায়তা অব্যাহত থাকবে। অনুষ্ঠানের সভাপতি ও বিএসএমএমইউর উপাচার্য বলেন, গণআকাঙ্ক্ষা পূরণ করে এমন গবেষণার জন্য অর্থের কোনো সমস্যা হবে না। জনসংখ্যা ভিত্তিক ক্যানসার নিবন্ধন থেকে যে পরিসংখ্যান পাওয়া গেছে, তা দেশের মানুষের ক্যানসার প্রতিরোধ, প্রতিকার ও ক্যানসার রোগীদের চিকিৎসায় বড় ভূমিকা রাখবে। একই সঙ্গে এই পরিসংখ্যান বাংলাদেশে ক্যানসার গবেষণার বহুমুখী দ্বার উন্মোচন করবে।

জন্ম থেকে মৃত্যু পর্যন্ত মানুষের শরীরের কোষগুলো একটিভ থাকে, এক সেকেন্ডের জন্যও এর কাজ বন্ধ থাকে না। এগুলো প্রতি মুহূর্তে খাদ্যের জিস্ট গ্রহণ করে কিন্তু পাকস্থলী দীর্ঘ সময় খালি থাকলে বা ১০১২ ঘণ্টার অধিক সময় খাদ্য গ্রহণ না করলে (যেটিকে ফাস্টিং বা মুসলমানেরা রোজা বলেন) পর্যাপ্ত জিস্ট তৈরি করতে পারে না। তখন কোষগুলো কোষের ফাঁকে জমে থাকা বর্জ্যগুলোকে খেয়ে পরিষ্কার করে ফেলে। কোষের ফাঁকে জমে থাকা বর্জ্য পরিষ্কার হয়ে গেলে ক্যানসার হওয়ার প্রবনতা থাকে না। আর এই বিষয়টি গবেষণায় বের করে ২০১৬ সালে জাপানের ডঃ ইয়োশিনোরি ওহসুমি ক্যানসার নিরাময়ের গবেষণার জন্য নোবেল পুরস্কার পান। বিষয়টি প্রকাশিত হওয়ার পর বিশ্বের বিভিন্ন ধর্মাবলম্বী কোটি কোটি মানুষ ফাস্টিং করা শুরু করেছেন। সামনে পবিত্র রমজান মাস, রোজা ইসলাম ধর্মের অতি গুরুত্বপূর্ণ একটি স্তম্ভ। এর গুরুত্ব অন্য সব এবাদতের চেয়ে অধিক, কারণ এটির প্রতিদান মহান আল্লাহ রাব্বুল আলামিন নিজে প্রদান করবেন। তাই এই মাসের ধর্মীয় গুরুত্ব অনুধাবন করে সব মুসলমানকে রোজা রাখা ও ধর্মীয় ভাব গাম্ভীর্য মেনে চলা উচিত।

লেখক: প্রাবন্ধিক ও কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপবিত্র রমজানের শুভ আগমন এবং প্রস্তুতিতে আমাদের করণীয়
পরবর্তী নিবন্ধবাংলাদেশের দারিদ্র্য পরিস্থিতি এবং ভবিষ্যৎ