চলতি মাসে বাংলাদেশ শিল্পকলা একাডেমির প্রশিক্ষণ বিভাগের আয়োজনে প্রথমে দেশের প্রতিটি জেলায় এবং এরপর প্রতিটি বিভাগে অনুষ্ঠিত হলো নাট্যকর্মশালাভিত্তিক প্রযোজনা নিয়ে ‘মুনীর চৌধুরী ১ম জাতীয় নাট্যোৎসব।’ চট্টগ্রাম বিভাগের ১১টি জেলার নাটক স্ব স্ব জেলায় মঞ্চস্থ হওয়ার পর ১৪ থেকে ১৮ ফেব্রুয়ারি প্রতিদিন দুটি নাটক মঞ্চস্থ হয় বিভাগীয় পর্যায়ে চট্টগ্রাম শিল্পকলা একাডেমি মিলনায়তনে। প্রতিদিন মিলনায়তন পূর্ণ দর্শক ১১ জেলার ১১ টি নাটক উপভোগ করেছেন। সারাদেশ জুড়ে একই সাথে অনুষ্ঠিত হওয়া এ ধরনের নাট্যৎসব এই প্রথম যা নাট্যামোদীদের মধ্যে উৎসাহ উদ্দীপনা সৃষ্টি করেছে। এই নাট্য উৎসবের মধ্য দিয়ে যেমনি উঠে আসবেন অনেক নতুন নাট্যকার, শিল্পী, কলাকুশলী; তেমনি সারা দেশের নাট্যকর্মীদের মধ্যেও গড়ে উঠবে হার্দিক আন্তঃসংযোগ যা পারস্পরিক চিন্তাভাবনার বিনিময় ঘটাতে সহযোগিতা করবে।
একটি উৎসবের নিয়মানুযায়ী এই উৎস কয়েকটি নাটক স্বভাবতই উল্লেখযোগ্য ও দর্শকপ্রিয়তা অর্জনে সমর্থ হয়েছে। আমরা সেগুলি নিয়ে ক্রমশ আলোচনার আশা রাখি। প্রথমেই আমরা আলোচনা করছি জেলা শিল্পকলা একাডেমি খাগড়াছড়ির প্রযোজনা ‘মোধই’ নিয়ে।
মোধই–মারমা ভাষার একটি শব্দ, যার বাংলা প্রতিশব্দ ‘ঘূর্ণিঝড়’। নাটকটি উইলিয়াম শেক্সপিয়রের ‘টেম্পেস্ট’ নাটকের বাংলা রূপান্তর। রূপান্তর ও নিদের্শনায় ছিলেন চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়ের নাট্যকলা বিভাগের সহকর্মী অধ্যাপক আরাফাতুল আলম। টেম্পেস্ট শব্দের মারমা প্রতিশব্দ মোধই। পুরো নাটকটি প্রতিস্থাপন করা নৃগোষ্ঠী পারিপার্শ্বিকতায়। নাটকের চরিত্রগুলির নামকরণও করা হয়েছে মারমা, চাকমা, ত্রিপুরা ও চাক ভাষায়। মূল নাটকের ইংরেজি নামের ভাবার্থ অনুসরণে নামকরণগুলি করা হয়েছে। বিভিন্ন চরিত্রের পোশাক–আশাক, রূপসজ্জা ও সাজসজ্জা ও নাটকের প্রয়াসের ব্যবহারে বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর স্বকীয়তা অক্ষুন্ন রাখার উদ্যোগটিও প্রশংসনীয়। তবে নাটকের সংলাপগুলি রাখা হয়েছে বাংলায়। এর প্রধান কারণ বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর মধ্যে আন্তঃভাষাগত সংযোগ ও সমন্বয়। একই সঙ্গে বাংলাভাষী দর্শকের কাছেও এর মধ্যে দিয়ে সহজে পৌঁছুনো সম্ভব হয়েছে। নাটকে উচ্চারিত যাদুমন্ত্রগুলি রাখা হয়েছে ত্রিপুরা ভাষায়, যেগুলি প্রথমে বাংলায় রচনা করেছেন নাটকের নির্দেশক। এতসব নাট্যক্রিয়ার ফলে নাটকটির সামগ্রিক মঞ্চায়নে একটা অভিনবত্ব শুরু থেকে লক্ষণীয় ছিল।
শেক্সপিয়রের নাটকের সর্বজনীনতা তাঁকে প্রায় পাঁচশত বছর ধরে বিশ্বজুড়ে প্রাসঙ্গিক করে রেখেছে, যা ক্রমশ আরও বৃদ্ধিমান। তাঁর নাট্যকর্মের বিষয় বৈচিত্র্য সামাজিক ও রাজনৈতিক প্রেক্ষাপটে আজো বিশ্বের দেশে দেশে সমাদৃত। শেক্সপিয়রের নাটক চিরন্তন ধ্রুপদীয়ানার মানদন্ডে যেমন উত্তীর্ণ, তেমনি নাট্যরসের গুণে সর্বস্তরের নাট্যামোদীদের কাছে আদরণীয়। এর মধ্যে টেম্পেস্ট নাটকটি বিষয় ও আঙ্গিকগত দিক থেকে অনেকটাই স্বতন্ত্র। জেলা শিল্পকলা একাডেমি খাগড়াছড়ির প্রযোজনা কেন্দ্রিক নাট্য কর্মশালায় প্রশিক্ষক ও নির্দেশক আরাফাতুল আলম শেক্সপিয়রের ব্যতিক্রমধর্মী এই নাটকটিই নির্বাচন করেছেন কর্মশালা পরবর্তী মঞ্চায়নের জন্যে। ১১টি নাটকের মধ্যে এই নাটকটি ছিল ব্যতিক্রমধর্মী। যার মঞ্চায়ন নাট্যশিক্ষার্থীদের নাট্যশিক্ষাণের পাশাপাশি নাটক পিয়াসী সাধারণ দর্শকদেরও পরিতৃপ্ত করতে সক্ষম হয়েছে। বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর সমন্বয় নাটকটিতে জাতীয় সংহতি নির্মাণের পাশাপাশি আন্তঃসাংস্কৃতিক মেলবন্ধন গড়ে উঠেছে, যেটি বাংলাদেশের সাংস্কৃতিক ও আর্থ সামাজিক পরিমণ্ডলে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ।
টেম্পেস্ট নাটকের কাহিনী অনেকেরই জানা। বাংলা রূপান্তরে (নাটকের ও চরিত্রের নৃগোষ্ঠী নামকরণে) মোধই নাটকের কাহিনী সংক্ষেপ মূলানুগভাবে এ রকম: তৈশা রাজ্যের ক্ষমতাচ্যুত রাজা তংগ্রি কন্যা লাব্রেসহ এক নির্জন দ্বীপে নির্বাসিত হন। জাদুবিদ্যায় পারদর্শী তংগ্রি ১৫ বছর পর এক প্রলয়ঙ্করী সামুদ্রিক ঝড় সৃষ্টি করেন। যার অভিঘাতে তার বিশ্বাসঘাতক ভাই অংজাই, মায়ুং রাজ্যের রাজা মায়ুং ও তার পুত্র তায়ুংসহ অন্যান্যরা এই দ্বীপের এক প্রান্তে এসে পড়ে। নিয়তির খেলায় তায়ুং ও লাব্রের মধ্যে প্রণয়ের সঞ্চার হয়।
অন্যদিকে সে দ্বীপে তংসিত্রা নামে এক পশুমানব রয়েছে যার মা এক সময় সে দ্বীপের অধিষ্ঠাত্রী ছিলেন। কেফে ও টিংকুলো নামের দুই মদ্যপের সঙ্গে মিলে তংগ্রিকে হত্যার ষড়যন্ত্র করে তংসিত্রা। এদিকে অংজাই, মায়ুং ও গঞ্জালো তাদের অতীত কৃতকর্মের কথা স্মরণ করে নির্বাসিত রাজা তংগ্রির জন্যে অনুতপ্ত হয়। তংগ্রির অনুগত এরিয়েল নামে এক অদৃশ্য পরী তার অলৌকিক ক্ষমতায় তংসিত্রার সমস্ত কূটকৌশল ও ষড়যন্ত্র ব্যর্থ করে দেয়। রাজা তংগ্রি এরিয়েলের মাধ্যমে মায়ুং ও অংজাইয়ের অনুশোচনার কথা জানতে পারেন। অবশেষে তংগ্রি সবাইকে ক্ষমা করে দেন। তায়ুং ও লাব্রের শুভ পরিণয় স্থির। তাংগ্রি জাদুবিদ্যা বিসর্জন দিয়ে সবাইকে মুক্ত করে দেন। এবং এরপর সবাই তৈশা ও মায়ুং অভিমুখে উদ্ধার পাওয়া জাহাজে চড়ে যাত্রা করেন।
শেক্সপিয়রের রূপকধর্মী দু’আড়াই ঘন্টা সময়ের এই নাটকটিকে নির্দেশক আরাফাতুল আলম মাত্র ৪৫ মিনিটে মঞ্চবন্দী করতে বাধ্য হয়েছেন কর্মশালার নির্ধারিত সময়সীমার কারণে। কিন্তু এর ফলে নাটকটি সুসংহত হয়েছে। এবং এটি রীতিমতো একটি দুরূহ কাজ যা সম্ভব হয়েছে ১৫দিন ব্যাপী বিরামহীন কর্মশালা, প্রশিক্ষণ ও মহাড়ার কারণে, যার মধ্য দিয়ে পাওয়া গেছে পরিশ্রম ও মেধালব্ধ একট যুথবদ্ধ নাট্যমঞ্চায়ন নির্দেশক, অভিনয়শিল্পী ও কলাকুশলীদের আন্তরিক ও দায়বদ্ধ টিমওয়ার্কের সমন্বয়ে।
এ আলোচনাটি লেখা হয়েছে নাটকটির দ্বিতীয় মঞ্চায়ন দেখে। আশা করি এ নাটকের ক্রমান্বয় মঞ্চায়নের মধ্য দিয়ে এর সময়সীমা আরো একটু (কিছু দৃশ্য সংযোজন সাপেক্ষে) বৃদ্ধি পাওয়ার পাশাপাশি আরো উৎকর্ষ সাধিত হবে।
‘মোধই’–এর মঞ্চায়নের বিষয়ে নির্দেশক আরাফাতুল আলমের অভিমত, “উইলিয়াম শেক্সপিয়রের কালজয়ী সৃষ্টি ‘দ্য টেমেপস্ট’ অবলম্বনে নির্মিত ‘মেধাই’ নাটকটি খাগড়াছড়ির পার্বত্য জনপদের অনন্য রূপায়ণ। মারমা ভাষায় ‘মোধই’ অর্থ ঘূর্ণিঝড় ; যা কেবল প্রাকৃতিক প্রলয় নয়, বরং এই অঞ্চলের জনজীবনে ঘটে যাওয়া সামাজিক, রাজনৈতিক ও সাংস্কৃতিক পরিবর্তনের প্রতীক। নাটকটিতে সচেতনভাবে প্রয়োগ করা হয়েছে আন্তঃসাংস্কৃতিক পরিবেশনার মেলবন্ধন–এর ধারণা। শেক্সপিয়রের মূল নাটকের বিষয়বস্তু অক্ষুন্ন রেখে খাগড়াছড়ির স্থানীয় সাংস্কৃতি, পরিবেশ ও প্রতিবেশের মিথষ্ক্রিয়ায় সৃজিত হয়েছে এই অনুপম নাট্য ভাষা। নাটকটি যেন এক বহুস্বরিক সমাজের প্রতিচ্ছবি, যা একই সাথে স্থানীয় ও বৈশ্বিক। চাকমা, মারমা, ত্রিপুরা, চাকসহ অন্যান্য জনগোষ্ঠীর স্বতঃস্ফূর্ত অংশগ্রহণে, পশ্চিমা নাট্য আঙ্গিকের সাথে তাদের নিজস্ব ঐতিহ্যবাহী সুর, তাল, নৃত্য ও অভিনয়শৈলীর মিশেলে ‘মোধই’ হয়তো লাভ করবে এক অনুপম নান্দনিক বিভা। ‘মোধই’ নিছক একটি নাটক নয়, এটি পার্বত্য জনগোষ্ঠীর প্রতি আমাদের বিনম্র শ্রদ্ধার্ঘ্য; তাদের সংগ্রাম, সাংস্কৃতিক ও জীবনবোধের এক শৈল্পিক আখ্যান।”
নাটকটির আলো, সাজসজ্জা, রূপসজ্জা ও প্রপসের প্রয়োগে নানা পরীক্ষা নিরীক্ষার প্রয়োগ ঘটানো হয়েছে। সাজসজ্জার ক্ষেত্রে স্থানীয় পোশাক ও অলংকার, পাখির পলক, লতাপাতা ফুল এসবের ব্যবহার করা হয়েছে বিভিন্ন নৃগোষ্ঠীর অনুসরণে। নাটকের থিমের অনুসরণে সেট নির্মিত হয়েছে। একটি দুই পতাকার পাল ও চাকার সমন্বয়ে বাহুল্যহীন সেট কখনও কখনও নাটকের চরিত্রের রূপ নিয়েছে।
দুই রঙের পতাকা নির্দেশ করেছে অতীত ও বর্তমানকে। তেমনি জাহাজটি কখনও শৌর্য বীর্যের ও ক্ষমতার প্রতীক, কখনও প্রতিশোধ–প্রতিহিংসা, আবার কখনও ক্ষমাও সম্প্রীতির প্রতীক হয়ে নাটকের একটি মুখ্য চরিত্রের রূপ নিয়েছে। বিশেষ কয়েকটি দৃশ্যে সংগীতের প্রয়োগও অর্থপূর্ণ এবং শ্রবণসুখকর।
‘মোধই’ নাটকের সংগঠন ও মঞ্চায়নে নির্দেশক তার কুশীলবদের উপযুক্ত সঙ্গত অর্জনে সমর্থ হয়েছেন। বিভিন্ন চরিত্রে অভিনয় করেছেন; অনিক বৈষ্ণব (রাজা তংগ্রি), নেনেছেন চাক তৃষা (লাব্রে), ম্রাসাচিং মারমা (রাজা অংজাই), ম্রাবাই মার্মা (এরিয়েল), সুরেশ ত্রিপুরা (রাজা ও মায়ুং), মনোতোষ ত্রিপুরা (তায়ুং), হলাপ্রুসাই মার্মা (গঞ্জালো), সুভাষ চাকমা (টিংকুলো), এলিয়ন চাকমা (কেফে), রুইউসেং মারমা (খালাসি), উদ্দীপন চাকমা (সারেং), চনিতা ত্রিপুরা (ডাইনি সিকোরাক্স), হৃদয় ত্রিপুরা (তংসিত্রা), মাহ্লাচিং মারমা (পরী–১) ও তুহিনা ত্রিপুরা (পরী–২)। সকলে স্বতঃস্ফূর্ত অভিনয় করেছেন যদিও সংলাপ উচ্চারণে নিজেদের ভাষার প্রভাব লক্ষ করা গেছে, কিন্তু এর একটি ইতিবাচক দিক হলো, দর্শকেরা নাট্যরিবেশনায় আদিবাসী আবহের স্বাদ উপভোগ করেছেন।
‘মোধই’–এর সহকারী নির্দেশক ইয়াকিন হায়দার সংগীত সঞ্চালনায় দক্ষতার পরিচয় রেখেছেন। একইভাবে দক্ষতার স্বাক্ষর রেখেছেন অর্পিতা ভট্টাচার্য প্রপস, পোশাক, সাজসজ্জা ও রূপসজ্জায়। আলোক প্রক্ষেপণে আসিফ ইবনে ইউসুফ ও সাগর দেবনাথ যথাযথ। নেপথ্য সহযোগী ছিলেন আবু বক্কর সিদ্দিক, হান্নান, মেহেদী হাসান ও দিলনাজ লাবন্য।
ব্যতিক্রমধর্মী এই উৎসবের উল্লেখযোগ্য নাটকগুলির মধ্যে কক্সবাজার প্রযোজনা ফাহমিদা সুলতানা তানজী নির্দেশিত ‘সত্যাগমন’ ফেনীর প্রযোজনা সায়েম সিরাজ নির্দেশিত ‘স্বর্ণবোয়াল’ নোয়াখালীর প্রযোজনা শাওন দাস নির্দেশিত ‘জাল’, চাঁদপুর প্রযোজনা মোস্তফা কামাল যাত্রা নির্দেশিত ‘লোহাগড় মঠ’ এবং বান্দরবান প্রযোজনা সুবীর মহাজন নির্দেশিত ‘চইং জাঃ খ্রাং’ অন্যতম। এই উৎসবের বড় প্রাপ্তি অগ্রজদের পাশাপাশি অনেক নবীন নাট্যকার, নাট্যনির্দেশক, কলাকুশলী ও অভিনয়শিল্পীর শুভাগমন; যাদের হাত ধরে বাংলাদেশের নাট্যজগতে একটি নতুন ধারা সূচিত ও প্রতিষ্ঠিত হবে।