আজ অমর একুশে ফেব্রুয়ারি। বাঙালির মননে অনন্য মহিমায় ভাস্বর চিরস্মরণীয় একটি দিন। ইতিহাসের পাতায় রক্ত পলাশ হয়ে ফোটা সালাম, বরকত, রফিক, জব্বার, সফিউরের রক্তে রাঙানো অমর একুশে ফেব্রুয়ারি। রক্তস্নাত ভাষা আন্দোলনের স্মৃতিবহ মহান শহীদ দিবস। একই সঙ্গে আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবস আজ।
বাঙালির জাতীয় জীবনে একুশে ফেব্রুয়ারি এমনই একটি দিন, বাংলা ভাষার মর্যাদা রক্ষার স্মৃতি–চিহ্নিত যে–দিন সংগ্রামের জ্বলন্ত অগ্নিশিখায় উজ্জ্বল এবং রক্তাক্ত আত্মত্যাগের মহিমায় ভাস্বর। এ দিনটি কেবল ইতিহাসের একটি বিবর্ণ তারিখ নয়, তা এমন একটি দিন যা আমাদের জাতীয় ইতিহাসের ধারায় নিরন্তর গতিময়, প্রাণবন্ত ও তাৎপর্যপূর্ণ। এই দিনটিকে কেন্দ্র করে ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলনের রক্তাক্ত সংগ্রামের ভেতর দিয়ে বাঙালির জাতিসত্তায় যে চেতনার জন্ম হয়েছিল, তা ছিল এক অবিনাশী চেতনা।
একুশ মানে মাথা নত না করা। আজ বিশ্বের কোটি কণ্ঠে ধ্বনিত হবে একুশের অমর শোকসংগীত ‘আমার ভাইয়ের রক্তে রাঙানো একুশে ফেব্রুয়ারি, আমি কি ভুলিতে পারি।’ ভাষা শহীদদের রক্তে শৃঙ্খলমুক্ত হয়েছিল দুঃখিনী বর্ণমালা, মায়ের ভাষা। বাঙালি জাতিসত্তা বিকাশের যে সংগ্রামের সূচনা সেদিন ঘটেছিল, মুক্তিযুদ্ধের গৌরবময় পথ বেয়ে স্বাধীন বাংলাদেশের অভ্যুদয়ের মধ্য দিয়ে তা চূড়ান্ত পরিণতি লাভ করে। একুশে ফেব্রুয়ারি তাই বাঙালির কাছে চির প্রেরণার প্রতীকে পরিণত হয়েছে। প্রতিবছর একুশে ফেব্রুয়ারি আসে। আমরা পালন করি। কিন্তু সর্বস্তরে বাংলা ভাষার কি প্রচলন হয়েছে আজো? আমরা জানি, আমাদের দেশের সর্বস্তরে বাংলা ভাষার প্রয়োগ নিশ্চিত করতে শেষ পর্যন্ত উচ্চ আদালত থেকে নির্দেশ পাওয়া গিয়েছিল ২০১৪ সালে। সেই আদেশে বলা হয়েছিল: ইংরেজিতে থাকা ইলেকট্রনিক মিডিয়ার বিজ্ঞাপন, গাড়ির নামফলক, সব ধরনের সাইনবোর্ড ও নামফলক বাংলায় লিখতে হবে। একই সঙ্গে বাংলা ভাষা প্রচলন আইনানুসারে সব ক্ষেত্রে অবিলম্বে বাংলা ভাষা ব্যবহারে কার্যকর পদক্ষেপ নিতে কেন নির্দেশ দেওয়া হবে না, তা জানতে চেয়ে রুলও দিয়েছিল আদালত। আগেও আমরা এমন নির্দেশনা দেখেছিলাম। কিন্তু এখনো তা বাস্তবায়ন হলো না। তা ভাবনার বিষয়। আমাদের প্রাণের বাংলা ভাষা বাংলাদেশের সংবিধান স্বীকৃত রাষ্ট্রভাষা। এ ভাষার রয়েছে নিজস্ব বর্ণমালা। বাংলা সাহিত্যসম্ভার নিঃসন্দেহে বিশ্বমানের। এ সবকিছুই বাংলা ভাষার জন্য ইতিবাচক উপাদান। এ ছাড়া সারা বিশ্বে বর্তমানে বাংলাভাষী মানুষের সংখ্যা প্রায় ৩০ কোটি। এর মধ্যে বাংলাদেশে ১৬ কোটিরও বেশি; ভারতের পশ্চিমবঙ্গ, আসাম ও ত্রিপুরা মিলিয়ে ১২ কোটি এবং পৃথিবীময় ছড়িয়ে থাকা বাঙালির সংখ্যা কম–বেশি এক থেকে দেড় কোটি। এই বিপুলসংখ্যক ভাষী নিয়ে একটি ভাষার টিকে থাকা অত্যন্ত সঙ্গত ও ইতিবাচক। যেখানে শত শত ভাষা নিজস্ব ভাষী হারিয়ে বিপন্নতার মুখোমুখি, সেখানে বাংলা ভাষা ও সাহিত্যের জয়জয়কার সর্বত্র। এত অর্জনের পরও আমাদের ভালোবাসার বাংলা ভাষা তার স্বকীয়তা হারাচ্ছে দিন দিন। এর জন্য দায়ী কারা, তা নিয়ে ভাবনার সময় এসেছে। বাংলা ভাষাকে আজ জাতিসংঘের মতো আন্তর্জাতিক প্রতিষ্ঠানের দাপ্তরিক ভাষা করার দাবি উত্থাপিত হয়েছে। এমনকি দেশের সরকারপ্রধানও বাংলায় জাতিসংঘে বক্তৃতা দিচ্ছেন। কিন্তু আমাদের এই সাধের ও প্রাণের ভাষা নিজ ভূমিতেই কতটা যে অবহেলার শিকার, তার নজির ছড়িয়ে আছে সর্বত্র।
আনিসুজ্জামানের লেখা থেকে পাই, একুশে ফেব্রুয়ারি আমাদের জাতীয় জীবনে অপরিসীম শ্রদ্ধা ও আবেগের সঙ্গে প্রতিষ্ঠিত। বীরের রক্ত আর মায়ের অশ্রু, দেশবাসীর ভালোবাসা আর চৈতন্য, সংগ্রামশীলতা আর কষ্টস্বীকার এ দিনকে গড়ে তুলেছে। বিনিময়ে এ দিনের কাছ থেকে আমরা পেয়েছি ভবিষ্যতে চলার পথের ইঙ্গিত আর একত্রিত হবার স্থান। যে সমস্ত স্বপ্ন ও আকাঙ্ক্ষা নিয়ে দেশের কোটি কোটি মানুষ পাকিস্তান আন্দোলনে ঝাঁপিয়ে পড়েছিল, দেশ স্বাধীন হবার চার পাঁচ বছর পরও যে আকাঙ্ক্ষা রূপ পেল না বলে জনসাধারণের মনে বিক্ষোভ সৃষ্টি হয়েছিল সহজেই। একুশে ফেব্রুয়ারি জনসাধারণের এই সর্বতোমুখী বিক্ষোভকে রূপ দিয়েছে। বাংলাকে রাষ্ট্রভাষার মর্যাদায় প্রতিষ্ঠিত করার দাবিই এ দিনের প্রধান আওয়াজ হলেও এর পেছনে রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক ও সাংস্কৃতিক অধিকারের প্রশ্ন এবং ওইসব ক্ষেত্রে আশাহত হবার পরিচয় জড়িত ছিল। ১৯৪৮–এর মার্চ মাসে ভাষা আন্দোলনের যে অবস্থা, তার সঙ্গে ১৯৫২ সালের ফেব্রুয়ারির তুলনা করলে এ কথা সহজেই বোঝা যাবে।
একুশের চেতনার একটি বিশেষ দিক ছিল জাতীয় জীবনের সর্বস্তরে বাংলা ভাষার বিস্তার। এর অর্থ শিশু–কিশোর থেকে শুরু করে সব বয়সী নারী–পুরুষ বাংলা ভাষায় পারদর্শিতা অর্জন করবে; প্রাথমিক থেকে শুরু করে উচ্চশিক্ষায় বাংলা ব্যবহৃত হবে। উচ্চ আদালতেও বাংলা ভাষার প্রচলন হবে। বাংলাদেশের সংবিধানে স্পষ্টভাবে বলা হয়েছে, প্রজাতন্ত্রের রাষ্ট্রভাষা বাংলা। কিন্তু সর্বস্তরে বাংলা প্রচলনের এই আকাঙ্ক্ষা এখনও বাস্তবায়িত হয়নি। এ ব্যাপারে সরকারি উদ্যোগ প্রত্যাশা করে জনসাধারণ।