জীবনানন্দ দাশ বাংলা সাহিত্যের এক অমর কবি, যিনি প্রকৃতির প্রতি অসীম প্রেম ও গভীর অনুভূতি দিয়ে বাংলা কবিতায় এক অনন্য সৌন্দর্যের সৃষ্টি করেছেন। রবীন্দ্র–উত্তর যুগের অন্যতম শ্রেষ্ঠ কবি বলা হয় জীবনানন্দকে। বিংশ শতাব্দীর অন্যতম প্রধান আধুনিক বাংলা কবি তিনি।
বাংলা কাব্যে আধুনিকতার পথিকৃতদের মধ্যে অগ্রগণ্য জীবনানন্দ দাশ। তাঁর কবিতায় বাংলার প্রকৃতি, জনজীবন ও সংস্কৃতি এক অনন্য রূপে ফুটে ওঠে। বাংলার নদী, মাঠ, বন, গ্রাম, পাখি, ফুল, ঋতুবৈচিত্র্য সবকিছু তাঁর কবিতায় এক স্বপ্নিল মোহময়তার আবরণে বর্ণিত হয়েছে।
বাংলার প্রকৃতি ও ঋতুবৈচিত্র্য নিয়ে জীবনানন্দ দাশ তার কবিতায় সুনিপুনভাবে তুলে ধরেছেন। বাংলার প্রকৃতি যেন জীবন্ত হয়ে ওঠে জীবনানন্দ দাশের কবিতায়। কবির চোখে দেখা বাংলার প্রকৃতি এক স্বপ্নিল ও রহস্যময় রূপ নিয়ে ধরা দেয়। তাই কবি লিখেছেন, “বাংলার মুখ আমি দেখিয়াছি, তাই আমি পৃথিবীর রূপ খুঁজিতে যাই না আর।” এই লাইনটি পড়লেই বোঝা যায়, বাংলা প্রকৃতির প্রতি কবির গভীর মমত্ববোধ। বাংলার চিরচেনা প্রকৃতি, যেখানে সন্ধ্যার আকাশে ভেসে বেড়ায় সোনালি আলো, যেখানে গ্রামের পথ বেয়ে চলে গরুর গাড়ি, সেইসব দৃশ্যাবলী তাঁর কবিতায় মূর্ত হয়ে ওঠে।
পদ্মা, মেঘনা, যমুনা, ধলেশ্বরী, গঙ্গা–এগুলো শুধু নদীর নাম নয়, বরং বাঙালির জীবনের এক অবিচ্ছেদ্য অংশ। জীবনানন্দের কবিতায় নদী এক রূপক, যা সময়ের প্রবাহকেও নির্দেশ করে। তাঁর বিখ্যাত কবিতা “আবার আসিব ফিরে”– তে তিনি লিখেছেন, আবার আসিব আমি বাংলার নদী মাঠ ক্ষেত ভালোবেসে / জলঙ্গীর ঢেউ এ ভেজা বাংলারি সবুজ করুণ ডাঙ্গায়। এই লেখার মাধ্যমে কবি বুঝিয়েছেন, নদী যেন বয়ে চলা সময়ের মতো, যা জীবনের শাশ্বত প্রবাহকে প্রতিফলিত করে। বাংলার নদী ও তার পাশের প্রকৃতি কবির কল্পনায় এক স্বপ্নময় জগতের সৃষ্টি করেছে।
শুধু তা–ই নয়, কবি তার কবিতায় গ্রামবাংলার সৌন্দর্যও দারুণভাবে ফুটিয়ে তুলেছেন। জীবনানন্দ দাশ শহরের কোলাহল থেকে দূরে বাংলার গ্রাম্য প্রকৃতিকে ভালোবেসেছেন। লিখেছেন গ্রামীণ জীবনের কথা। তাঁর কবিতায় ফুটে ওঠা গ্রামের চিত্র আমাদের কাছে এক আত্মিক অনুভূতির জন্ম দেয়। কবির কবিতায় অনুপ্রাণিত হয়ে বলতে ইচ্ছে করে, “শিশিরভেজা ঘাসে পা ফেলে হেঁটে যাই,
নরম কুয়াশায় মিশে যায় গোধূলির আলো।”
গ্রামের মেঠোপথ, বটগাছের ছায়া, মধুমতী নদীর ঢেউ, ধানের খেত–এইসব উপাদান জীবনানন্দ দাশের কবিতাকে এক অনন্য রূপ দিয়েছে। তিনি শুধু প্রকৃতি বা নদী নয়, বাংলার জীবজগতেরও এক গভীর রূপকার। তিনি বাংলার পাখি, হরিণ, বনবিড়াল এমনকি বিলুপ্তপ্রায় প্রাণীকেও তাঁর কবিতায় স্থান দিয়েছেন। সাপের মতো হিস–হিস শব্দে ডাকলেও লক্ষ্মী–প্যাঁচার গান তার কাছে প্রেমের, সান্নিধ্যের আর স্বপ্নের দ্যোতনা নিয়ে আসত। ‘সেইদিন এই মাঠ’ কবিতায় তিনি লিখেছেন, লক্ষ্মীপেঁচা গান গাবে নাকি তার লক্ষ্মীটির তরে? / সোনার স্বপ্নের সাধ পৃথিবীতে কবে আর ঝরে!
জীবনানন্দ দাশের সময়কালে মানুষের জানাশোনার মধ্যে ছিল একমাত্র নিমপ্যাঁচা। গ্রামে–গঞ্জে এর নাম নিমপাখি। লোকের চোখে অলক্ষুনে জীব, দুর্যোগ আর দুঃসংবাদের অগ্রদূত। এখনও গ্রামে–গঞ্জে এই ধারা অব্যাহত আছে। তবে জীবনানন্দ দাশ সে–সময়েই নিমপাখি যে একটি প্যাঁচা তা জানতেন। তাই ‘গোলপাতা ছাউনির’ শিরোনামে এক কবিতায় তিনি লিখেছেন, শজিনার ডালে পেঁচা কাঁদে / নিম–নিম–নিম কার্তিকের চাঁদে।
একজন কবি কতটা প্রখর চিন্তা–ভাবনার মাধ্যমে এমন কাব্য সৃষ্টি করতে পারেন সেটা জীবনানন্দের এসব কবিতা না পড়লে বুঝা মুশকিল। তাঁর কবিতার লাইনগুলি বাংলার প্রকৃতির সাথে জীবজগতের এক মিশ্রিত চিত্র। পাখির ডাক, হরিণের চলাফেরা, গ্রামবাংলার অরণ্য–সবকিছু যেন কবির লেখনীর মাধ্যমে চিত্রকল্প হয়ে ধরা পড়ে।
জীবনানন্দের কবিতায় বাংলার রাত্রি এক বিশেষ মাত্রা পায়। তাঁর কবিতায় রাত শুধু অন্ধকার নয়, বরং এক রহস্যময় জগত, যেখানে নক্ষত্রের আলো পড়ে বাংলার নিস্তব্ধ প্রকৃতিতে। বাংলার রাতের নিস্তব্ধতা ও সৌন্দর্য তাঁর কবিতায় এক বিমূর্ত রূপ লাভ করেছে। তাঁর কবিতায় রাতের বাংলাকে এক নতুন দৃষ্টিকোণ থেকে দেখা যায়। তিনি ‘অনেক আকাশ’ কবিতায় লিখেছেন, “সবাই এসেছে পথে, আসে নাই তবু সেই পাখি! / নদীর কিনারে দূরে ডানা মেলে উড়েছে একাকী,।”
জীবনানন্দ দাশের কবিতা নিয়ে আলোচনা করতে গেলে সেই আলোচনা শেষ করার মতো নয়। শব্দরা ফুরাতে চাইবে না। তবুও আলোচনা স্বল্প রাখতে হলো। পরিশেষে বলতে চাই, জীবনানন্দ দাশের কবিতা শুধুমাত্র প্রকৃতি বর্ণনার জন্য নয়, বরং বাংলার প্রতি তাঁর প্রেম ও মমত্ববোধের জন্য অনন্য। তিনি তাঁর কবিতার মাধ্যমে বাংলার নদী, গ্রাম, প্রকৃতি, জীবজগৎ ও ঋতুবৈচিত্র্যকে এক নতুন রূপে ফুটিয়ে তুলেছেন। তাঁর কবিতা পাঠ করলে মনে হয়, যেন আমরা বাংলার প্রকৃতির মাঝে হারিয়ে যাচ্ছি। প্রকৃতির সৌন্দর্য ও গভীর জীবনদর্শন মিলিয়ে তাঁর কবিতা আজও পাঠকের মনে এক স্বপ্নিল আবেশ সৃষ্টি করে।