শিক্ষা, সংস্কৃতি, খেলাধূলা, চিকিৎসা, যোগাযোগ এবং কৃষিতে গ্রামের মানুষের অগ্রগতি হলে দেশ অনেক ক্ষেত্রেই এগিয়ে যাবে। প্রায় ৮৭১৯১ গ্রাম নিয়েই আমাদের প্রিয় বাংলাদেশ। নদী মাতৃক বাংলাদেশের চারদিকে সবুজের সমারোহ। কালের বিবর্তনে কৃষকের গোলা ভরা ধান না থাকলেও আমাদের যেসব জমি এখনো আছে সেগুলোর সঠিক ব্যবহার করা গেলে কৃষিজ সম্পদ বৃদ্ধি পাবে। বিভিন্ন গ্রাম ঘুরলে আপনি দেখবেন গ্রামের বেশিরভাগ বাড়িতে পরিবারের সদস্য নাই। কেউ শহরে চলে গেছে অথবা কেউ বিদেশ চলে গেছে। গ্রামের অনেক জমিতে চাষাবাদ চলে না, পুকুরে মাছ চাষ হয় না, ঔষধি এবং ফলজ গাছ রোপণ করার মানুষ কমে যাচ্ছে। গ্রাম্য নদীগুলোতে মাছের পরিমাণও কমে গেছে। অনেক নদী এখন খাল হয়ে যাচ্ছে। মাদক দ্রব্যের বিস্তার গ্রামের হাইস্কুল পড়ুয়া ছাত্রদের মাঝেও ঢুকে গেছে। মোবাইলে অনেকে জুয়ায় আসক্ত হয়ে যাচ্ছে।
গ্রামের যোগাযোগ ব্যবস্থা আগের চাইতে অনেক ভালো হয়েছে তারপরও বেশ কিছু গ্রাম আছে যেখানে অবকাঠামোগত উন্নয়ন খুব কম হয়েছে। গ্রামে রাস্তাঘাট, সেতু, হাটবাজার, পুকুর খনন, ইউনিয়ন পরিষদ ও উপজেলা কমপ্লেক্স নির্মাণসহ বিভিন্ন শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানের ভবন নির্মাণের উদ্যোগ গ্রহণ এবং কার্যকর করার মাধ্যমে গ্রামের জীবনযাত্রার মান উন্নত হবে। গ্রামীণ রাস্তাঘাট মেরামত কাজের দুরবস্থা এবং এলাকার মানুষের দুর্ভোগের করুণ চিত্র বিভিন্ন সময় আমাদের চোখে পড়ে। সংবাদ মাধ্যম থেকে জানা গেছে সারা দেশে পাকা সড়কের দৈর্ঘ্য ১ লাখ ৪০ হাজার ৬৯৯ কিলোমিটার এবং কাঁচা সড়কের দৈর্ঘ্য ২ লাখ ১২ হাজার ৬৫৩ কিলোমিটার প্রায়। কৃষক, জেলে, ক্ষুদ্র খামারি, মৎস্যচাষী তাদের কষ্টার্জিত উৎপাদন স্বল্প সময়ের মধ্যে বাজারজাত করার ক্ষেত্রে সড়কপথ গুরুত্বপূর্ণ। স্বল্প খরচে এক স্থান থেকে আরেক স্থানে যেতে হলেও সড়কপথের গুরুত্ব অপরিসীম। অনেক সময় দেখা যায়, তাড়াহুড়ো করে সড়কের কাজ করতে গিয়ে মান ঠিক রাখা যায় না। গ্রামাঞ্চলের সড়ক পাকা করার সময় অবশ্যই মানসম্মত হচ্ছে কিনা তার প্রতি খেয়াল রাখতে হবে।
গ্রামের বেশিরভাগ মানুষ চাষাবাদ করে জীবনযাপন করেন। এক সময়ের কৃষি নির্ভর বাংলাদেশ তার গৌরব হারিয়েছে। কৃষি উপকরণের দাম বৃদ্ধির কারণে গ্রামের অনেক কৃষক চাষ থেকে মুখ ফিরিয়ে নিচ্ছে। একটা সময় ছিল যখন ধান কাটার মৌসুমে অনেক বাড়িতে আনন্দ লেগেই থাকত। এখন গ্রামে যখন যায় সেই ছোট বেলার ধানের গন্ধ পাওয়া যায় না। বরং চাউল বাইরে থেকে আমদানি করতে হয়। সার, কীট নাশক, সেচ খরচ, শ্রমিক যে হারে বেড়েছে সেই হারে বাড়েনি ফসলের দাম। জনসংখ্যা বৃদ্ধির কারণে দিন দিন কমছে আমাদের ফসলি জমি ও ফসল। অথচ একসময় আমাদের মাতৃভূমি সোনার বাংলার ক্ষেত–খামার সোনালি ফসলে পরিপূর্ণ থাকত। বর্তমান আবাদী জমি ভাগ হয়, অনেকে জমির উপর বাড়ি ঘর তুলছেন। কৃষিজমি কমা মানেই কৃষি উৎপাদন কমে যাওয়া। আর সেক্ষেত্রে উৎপাদন কমে গেলে দেশে খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করার ব্যপারটি সরকারের জন্য কঠিন হয়ে যেতে পারে বলে মনে করেন। কৃষি জমি কমছে, ফলে স্বাভাবিকভাবেই উৎপাদন কমবে। বিভিন্ন উপায়ে উৎপাদন যদি বাড়ানো যায় তাহলে কম জমিতে, কম সময়ে বেশি ফসল ফলানো যাবে।
যারা একসময় পুকুর, খাল–বিল, ডোবা, নালায় মাছ ধরে পরিবারের চাহিদা পূরণ করতো তাদের অনেকেই এখন বাজার থেকে মাছ কিনতে বাধ্য। গ্রামের এই সুস্বাদু মাছগুলো এখন প্রায় সোনার হরিণ হয়ে গেছে। মাছের বিচরণ এলাকা নদী, হাওর বাওড় ও বিল দূষিত হয়ে যাচ্ছে। রাজধানীর চারপাশের নদী বুড়িগঙ্গা, ধলেশ্বরী, বালু, শীতলক্ষ্যা, তুরাগ এবং চট্টগ্রামের কর্ণফুলীতে মাছের সংখ্যা অনেক কমে গেছে। জানা গেছে দেশে এ পর্যন্ত প্রায় ৩০টি আগ্রাসী প্রজাতির বিদেশি মাছ ঢুকে পড়েছে, যা দেশি ছোট মাছগুলো খেয়ে সংখ্যা কমিয়ে দিচ্ছে। দেশের কৃষিকাজে প্রতিবছর প্রায় এক লাখ টন রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহৃত হয়, যা মাটি চুইয়ে জলাভূমিতে যায়। গ্রামে এক সময় পৌষ–মাঘ মাসে পুকুর, খাল, ডোবা, ঘের থেকে দেশি মাছ ধরার ধুম পড়তো। এখন অনেক অনেক গ্রামে দেশীয় মাছ নেই বললেই চলে। শীতকাল ছাড়া বর্ষাকালে ধানি জমিতে কইয়া জাল, বড়শি ও চাই পেতে মাছ ধরার রীতিও হারিয়ে গেছে অনেক এলাকা থেকে। জানা যায়, ভিটামিন–এ’র অভাবে গড়ে প্রতিবছর ৩০ হাজার শিশু অন্ধত্ববরণ করে। গ্রামীণ মাছগুলোকে কীভাবে রক্ষা করা যায় তা নিয়েও গবেষণার প্রয়োজন। এই মাছগুলোর প্রজননের জন্য পরিবেশ সৃষ্টি করা দরকার যাতে মানুষের মধ্যে ভিটামিনের ঘাটতি হয় না। সব মিলিয়ে গ্রামীণ অবকাঠামোর উন্নয়নের মাধ্যমে মানুষকে গ্রামমূখী করা যাবে। গ্রাম উন্নয়ন হলে শহরের উপরও চাপ অনেক কম পড়বে।
লেখক: প্রাবন্ধিক