টেকনাফ জালিয়া পাড়ার বাসিন্দা আবদু সমাদ। বংশ পরম্পরায় জেলে পরিবারের মানুষ। তার কয়েক পূর্ব পুরুষের জীবন কেটেছে নাফ নদীতে মাছ ধরে। আবদু সমাদ ৭০ বছর বয়সে নাফ নদীতে একদিনও মাছ ধরা বন্ধ থাকতে দেখেননি; শুধুমাত্র বিগত আট বছর ছাড়া! তিনি বলেন, ‘মাছ ধরতে না পেরে গত আটটি বছর কত মানসিক আর আর্থিক কষ্টে গেছে, তা ভাষায় বর্ণনা করতে পারবো না।’
নাফ নদীর মূল অংশে মাছধরায় নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার হওয়ায় আট বছরের অসহনীয় কষ্ট ভুলে হাসির ঝিলিক ফুটেছে পেশাদার আবদু সমাদসহ সব জেলের মুখে। অনুমতি পাওয়ার পর গত ১৪ ফেব্রুয়ারি থেকে নাফ নদীতে মাছ ধরার ধুম পড়েছে। প্রথম দিনে মুসলিম জেলেরা নদীর পাড়ে কোরআন পাঠ, দোয়া মাহফিল, ফাতেহা আয়োজন ও হিন্দু জেলো পূজা–অর্চনা দিয়ে মাছ ধরা শুরু করেন। এই যেন উৎসব চলছে নদীর তীরজুড়ে। জেলেদের পদভারে মুখরিত হয়ে উঠেছে নাফ নদীর কোল। এতে চিরাচরিত রূপে ফিরেছে নাফনদীর চিত্র।
সরেজমিন দেখা গেছে, প্রশাসনের নির্ধারিত সময় সকাল ৮টার পর থেকে নাফ নদীর বুকে জেলেদের মিছিল নামে। কিশোর থেকে বৃদ্ধ; বিভিন্ন বয়সের জেলেরা জোট বেঁধে নৌকা–জাল নিয়ে নেমে পড়েন। এতে নদীর বুকে দৃশ্যায়িত হয় এক ভিন্ন চিত্র। সকাল থেকে টানা বিকাল ৪টা পর্যন্ত মাছ শিকার করছেন তারা। এতে টুনা, রিটা, কেচকি, চিংড়ি, মাইট্টাসহ নানা প্রজাতির সাগরের মাছ ধরা পড়ছে জেলেদের জালে। তারপর আহরিত মাছ নিয়ে আড়ৎ ও বাজারে ছুটে যান। সেখানে চলে বেচা–বিক্রি। আবার পাইকারি ব্যবসায়ীরাও নদীর চরে ভীড় করেন মাছ কিনতে। শাহপরীর দ্বীপের বাসিন্দা জেলে জামাল হোসেন বলেন, ‘এখনো আমরা জাল–নৌকা পুরোদমে প্রস্তুত করতে পারিনি। পুরোনো যা আছে তা দিয়ে মাছ শিকার করছি। এতে মোটামুটি মাছ ধরা পড়ছে; তাতে আমাদের খুশির সীমা নেই।’ সাবরাং এলাকার জেলে বদর মিয়া বলেন, ‘মাছ ধরা ছাড়া আমাদের আর কোনো কাজ নেই। তাই গত আটটি বছর কত কষ্টে গেছে বলে বুঝাতে পারবো না। বহুদিন উপোস থেকেছি; পরিবারের প্রয়োজন মিটাতে পারিনি। সন্তানেরা কত কষ্ট পেয়েছে। আল্লাহ আমাদের ওপর রহম করেছেন; আমরা খুব খুশি।’
তবে রাতের বেলায় মাছ ধরতে না পারায় কিছুটা হতাশ জেলেরা। কারণ দিনের বেলায় ভাটার কারণে দুপুর ১২টার আগ পর্যন্ত ঠিক মতো মাছ ধরা যাচ্ছে না।
শাহপরীর দ্বীপ–জালিয়াপাড়া নৌঘাটের সভাপতি আবদুল গণি জানান, নদীর শাহপরীর দ্বীপ থেকে টেকনাফ জেটিঘাট পর্যন্ত এলাকায় মাছ ধরার অনুমতি দিয়েছে। এই অংশের জালিয়াপাড়া, সাবরাং, শাহপরীর দ্বীপ ও নতুন পাড়া ঘাট দিয়ে আপাতত দিনে ৫০ থেকে ৬০টি নৌকা নিয়ে মাছ ধরছেন জেলেরা। প্রতি নৌকায় ৫ হাজার থেকে ১০ টাকার পর্যন্ত মাছ আহরণ হচ্ছে।
এই জেলে নেতা জানান, নাফ নদীতে মাছ শিকারে জড়িত অন্তত পাঁচ হাজার পরিবার। এখন প্রায় পাঁচশ জেলে প্রতিদিন মাছ ধরছেন। নতুন করে আরো নৌকা তৈরি ও জাল বোনা চলছে। সেগুলো প্রস্তুত হলে পুরোদমে মাছ আহরণ করা যাবে।
নাফ নদী মাছ শিকার শুরু হওয়ায় টেকনাফে মৎস্য সম্পদ বেড়েছে। এসব মাছ স্থানীয়দের চাহিদা পূরণ করে কক্সবাজার শহরসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহ করা হচ্ছে।
টেকনাফের খুচরা ও পাইকারি মাছ ব্যবসায়ী আবদুর শুক্কুর বলেন, ‘তরতাজা মাছে টেকনাফের মৎস্য আড়ৎ ও বাজারগুলো গমগম করছে। দামও ভালো পাচ্ছেন জেলেরা। এসব মাছ দেশের বিভিন্ন স্থানে সরবরাহও করা হচ্ছে।’
টেকনাফ উপজেলা সিনিয়র মৎস্য কর্মকর্তা দেলোয়ার হোসেন বলেন, ‘দীর্ঘদিন পর মাছধরা শুরু হয়েছে। এখন প্রতিদিন পাঁচশ জেলে মাছ শিকার করছেন। তারা প্রথম দুই দিনে অন্তত ছয় টন মাছ আহরণ করেছেন।’
এদিকে শাহপরীর দ্বীপ থেকে টেকনাফ জেটিঘাট পর্যন্ত অনুমতি দেয়া হলেও সেখান থেকে হ্নীলা পর্যন্ত অনুমতি দেয়া হয়নি। ফলে হোয়াইক্যং, হ্নীলা এলাকায় অন্তত ১০ হাজার জেলে মাছ আহরণ থেকে বঞ্চিত রয়েছেন। এই নিয়ে ক্ষুব্ধ হয়ে উঠেছেন তারা। এর অংশ হিসেবে ইতিমধ্যে তারা মানববন্ধন ও প্রতিবাদ সমাবেশসহ নানা কর্মসূচি পালন করেছেন।
হ্নীলার ভারপ্রাপ্ত ইউপি চেয়ারম্যান মো. আলী বলেন, ‘একই নদীর এক অংশে অনুমতি দিলেও অন্য অংশে অনুমতি না দেয়া বৈষম্য। অথচ বৈষম্যের প্রতিবাদে দেশের পট পরিবর্তন হয়েছে। এমন বৈষম্য মেনে নেয়া যায় না। নদীর এই অংশেও নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করার জন্য আমরা প্রশাসনের কাছে আবেদন জানিয়েছি।’
এ ব্যাপারে জানতে চাইলে টেকনাফ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা শেখ এহসান উদ্দীন বলেন, ‘হোয়াইক্যং–হ্নীলা অংশটি সরু। এতে মাছ ধরার আড়ালে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ, মাদক ও চোরাচালানের আশঙ্কা রয়েছে। তাই এই অংশে আপাতত অনুমতি দেয়া হয়নি।’
তিনি বলেন, খুলে দেয়া অংশেও নিয়মিত নজরদারি রাখা হয়েছে। মাছ ধরার জন্য যদি সীমান্ত অনিরাপদ হয় তাহলে আবার মাছ ধরা বন্ধ করা হতে পারে। পক্ষান্তরে ফলাফল ইতিবাচক হলে হ্নীলা পর্যন্ত অবশিষ্ট অংশের নিষেধাজ্ঞাও তুলে নেয়া হবে।’
উল্লেখ্য, রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ এবং মাদকসহ নানা ধরনের চোরাচালান রোধে আট বছর আগে টেকনাফের নাফ নদীতে মাছ ধরা সম্পূর্ণ বন্ধ করে দেয় তৎকালীন সরকার। সমপ্রতি উচ্চ আদালতের একটি রিট পিটিশনের প্রেক্ষিতে জেলা প্রশাসন শর্তসাপেক্ষে নাফ নদীর এক অংশে মাছ ধরার অনুমতি দিয়েছে।