বহির্নোঙরে স্থবিরতা কাটাতে বিশেষ উদ্যোগ

সাগর পাড়ি দেওয়ার অনুমোদন না থাকা ৩৫ জাহাজকে বিশেষ অনুমোদন রোজার পণ্য সরবরাহ ঠিক রাখতে এই উদ্যোগ

হাসান আকবর | সোমবার , ১৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ at ৮:০২ পূর্বাহ্ণ

চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে পণ্য হ্যান্ডলিংয়ে স্থবিরতা কাটাতে সাগর পাড়ি দেওয়ার অনুমোদন ছিল না এমন ৩৫টি লাইটারেজ জাহাজকে গতকাল বিশেষ অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এমন উদ্যোগ ইতোপূর্বে দেখা না গেলেও রোজাকে সামনে রেখে অভ্যন্তরীণ নৌ রুটে পণ্য সরবরাহ নেটওয়ার্ক টিকিয়ে রাখার স্বার্থে বিশেষ এই উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। বিদেশ থেকে হাজার হাজার টন পণ্য নিয়ে আসা মাদার ভ্যাসেলগুলো থেকে পণ্য খালাসে গতি আনতে নেওয়া এই পদক্ষেপে অনুমোদন পাওয়া ৩৫টি জাহাজকে সাময়িকভাবে দেওয়া অনুমোদনে হালনাগাদ সার্ভে থাকার শর্ত দেওয়া হয়েছে। নৌপরিবহন অধিদপ্তরের এই উদ্যোগে দেশের আমদানি বাণিজ্যের পণ্য পরিবহনে গতি আনার পাশাপাশি চট্টগ্রামে বিদেশি মাদার ভ্যাসেলের অবস্থানকাল কমে আসবে। এতে দেশের কোটি কোটি টাকা সাশ্রয় হবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে। বিশ্বের নানা দেশ থেকে আমদানিকৃত কোটি কোটি টন পণ্য বহির্নোঙরে খালাস করা হয় লাইটারেজ জাহাজের মাধ্যমে। প্রায় ১৮শ লাইটারেজ জাহাজ এই বিপুল পরিমাণ পণ্য খালাস করে। মাদার ভ্যাসেল থেকে নামানো পণ্য কর্ণফুলী নদীর ষোলটি ঘাটের পাশাপাশি দেশের নানা অঞ্চলের অন্তত ৬০টি গন্তব্যে প্রেরণ করা হয়। এর মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ পণ্য সরবরাহ নেটওয়ার্ক গড়ে উঠেছে।

চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্য পরিবহনে নিয়োজিত লাইটারেজ জাহাজগুলোর সিংহভাগই বাংলাদেশ ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট কোঅর্ডিনেশন সেল (বিডব্লিউটিসিসি) নিয়ন্ত্রণ করে। প্রতিদিন বার্থিং সভা করে বিডব্লিউটিসিসি মাদার ভ্যাসেলের বিপরীতে চাহিদা অনুযায়ী লাইটারেজ জাহাজ বরাদ্দ দেয়। যেগুলো বহির্নোঙরে গিয়ে মাদার ভ্যাসেল থেকে পণ্য খালাস করে। অপরদিকে বিভিন্ন শিল্প প্রতিষ্ঠানের মালিকানাধীন জাহাজগুলো ডিব্লিউটিসিসির সিরিয়ালভুক্ত না হয়ে নিজেদের পণ্য নিজেরাই পরিবহন করে।

বহির্নোঙরের পাশাপাশি বন্দরের ভিতরেও জাহাজের ওভারসাইড থেকে পণ্য পরিবহন করে লাইটারেজ জাহাজগুলো। আবার বহির্নোঙরে ড্রাফট কমানোর জন্যও কিছু পণ্য লাইটারেজ জাহাজে খালাস করা হয়। পরবর্তীতে ড্রাফট কমানোর পর ওই জাহাজটি বাকি পণ্য বন্দরের জেটিতে এসে পণ্য খালাস করে।

সবকিছু মিলে দেশের অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন রুটে পণ্য পরিবহন এবং দেশব্যাপী সাপ্লাই চেইন ঠিক রাখার জন্য লাইটারেজ জাহাজ সেক্টর গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখে আসছে বহু বছর ধরে। ঠিকভাবে লাইটারেজ জাহাজ পাওয়া না গেলে বহির্নোঙরে বিদেশ থেকে আসা মাদার ভ্যাসেলের অবস্থানকাল বেড়ে যায়। একেকটি মাদার ভ্যাসেল একদিন অলস বসে থাকলে অন্তত ১৫ হাজার ডলার ফিঙড অপারেটিং কস্ট বা এফওসি গচ্ছা দিতে হয়। এর যোগান দিতে হয় আমদানিকারককে। ঘুরপথে তা সাধারণ ভোক্তাদের ওপর পড়ে। তাছাড়া জাহাজজটে বিশ্বের শিপিং সেক্টরে বন্দরের ইমেজ সংকটে পড়ে।

গত কয়েকদিন ধরে বহির্নোঙরে মাদার ভ্যাসেলগুলোতে চাহিদা অনুযায়ী লাইটারেজ জাহাজ বরাদ্দ পাওয়া যাচ্ছে না। পণ্যের এজেন্ট জানিয়েছেন, তাদের মাদার ভ্যাসেলগুলো মার খাচ্ছে। জাহাজের অবস্থানকাল বেড়ে যাচ্ছে। একটি মাদার ভ্যাসেলের বিপরীতে ৩/৪টি করে জাহাজ বরাদ্দ চাওয়া হলেও দেওয়া হচ্ছে একটি বা দুটি করে। এতে করে পণ্য হ্যান্ডলিং কার্যক্রম অর্ধেকে নেমে আসার শঙ্কা ব্যক্ত করেন তারা। তারা বলেন, বিদ্যমান পরিস্থিতি লাগাতার হলে বন্দরে জাহাজের অবস্থানকাল বেড়ে জটের সৃষ্টি হবে। বহির্নোঙরে অবস্থানকারী জাহাজগুলোর বিপরীতে লাখ লাখ ডলার গচ্ছা হিসেবে দেশ থেকে চলে যাবে।

অপরদিকে বিডব্লিউটিসিসির পক্ষ থেকে শুরু থেকে অভিযোগ করা হচ্ছে, দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে শত শত লাইটারেজ জাহাজকে ভাসমান গুদাম বানিয়ে আটকে রাখা হয়েছে। জাহাজ থেকে পণ্য খালাস করা হলেও তা ঘাটে না নামানোর ফলে জাহাজগুলো আটকা পড়েছে। রমজানকে সামনে রেখে এক শ্রেণির অসাধু ব্যবসায়ী জাহাজেই পণ্য মজুদ করে রাখছেন। এর ফলে নতুন করে পণ্য খালাসের জন্য জাহাজ পাওয়া যাচ্ছে না। বিষয়টি নিয়ে অভিযোগ এবং পাল্টা অভিযোগের মধ্যে নৌ পরিবহন অধিদপ্তরের শীর্ষ কর্মকর্তারা জরুরি বৈঠকে বসেন। জাহাজ মালিক এবং আমদানিকারকদের প্রতিনিধিদের নিয়ে অনুষ্ঠিত উক্ত বৈঠকে ভাসমান গুদামের বিরুদ্ধে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনাসহ বেশ কিছু সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হয়। ইতোমধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে কয়েকটি জাহাজকে জরিমানা এবং দ্রুততম সময়ের মধ্যে পণ্য খালাসের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।

উক্ত বৈঠকে সাগর পাড়ি দেওয়ার অনুমোদন নেই এমন কিছু জাহাজকে বে ক্রসিংয়ের অনুমতি দেওয়ারও সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়। বর্তমানে ৪৫ মিটারের বেশি দৈর্ঘ্যের জাহাজকে কেবল সাগর পাড়ি দিয়ে বহির্নোঙরে গিয়ে পণ্য খালাস এবং তা আবার সাগর পাড়ি দিয়ে দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে নিয়ে যাওয়ার অনুমোদন দেওয়া হয়। এর থেকে ছোট জাহাজকে সাগর পাড়ি দেওয়ার অনুমোদন দেওয়া হয় না। এসব ছোট জাহাজ স্থানীয়ভাবে পণ্য পরিবহন করে এবং নদীপথে চলাচল করে। বে ক্রসিং পারমিশন নেই এমন জাহাজ বহির্নোঙরে মাদার ভ্যাসেল থেকে পণ্য খালাস করতে যেতে পারে না।

বহির্নোঙরে জাহাজের বাড়তি চাহিদা মোকাবেলা করতে নৌ পরিবহন অধিদপ্তর কিছু জাহাজকে বে ক্রসিং পারমিশন দেওয়ার সিদ্ধান্ত নেয়। উক্ত সিদ্ধান্তের আলোকে প্রাথমিকভাবে ৩৫টি জাহাজকে অনুমোদন দেওয়া হয়েছে। এই ৩৫টি জাহাজের সার্ভে রিপোর্ট হালনাগাদ থাকলে তারা আগামী ৩১ মার্চ পর্যন্ত সাগর পাড়ি দিয়ে বহির্নোঙরে গিয়ে মাদার ভ্যাসেল থেকে পণ্য খালাস করে দেশের বিভিন্ন গন্তব্যে পরিবহন করতে পারবে। ‘এম’ সিরিয়ালের উক্ত ৩৫টি জাহাজকে গতকাল এই অনুমোদন দেওয়া হয়।

বিডব্লিউটিসিসির প্রধান নির্বাহী মেজর (অব.) জিএম খান বলেন, মাননীয় ডিজি মহোদয় বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছেন। আগামী এক সপ্তাহের মধ্যেই এর সুফল দেখা যাবে। তিনি বলেন, ডিজি মহোদয় ৩৫টি জাহাজকে বিশেষ বিবেচনায় সাময়িকভাবে বে ক্রসিং পারমিশন দিয়েছেন। এর ফলে লাইটারেজ জাহাজের সংকট কিছুটা হলেও কমে আসবে। রমজান সামনে রেখে অভ্যন্তরীণ পণ্য সরবরাহ নেটওয়ার্ক যাতে ব্যাহত না হয় সেদিকে সজাগ থাকার জন্য তিনি সবার প্রতি আহ্বান জানান।

এদিকে গতকাল বহির্নোঙরে পণ্য বোঝাই ৩৪টি মাদার ভ্যাসেল অবস্থান করছিল। এসব জাহাজে মোট ৬১টি লাইটারেজ জাহাজ বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধঘাতক দালাল নেত্রীকে পুলিশে দিল শিক্ষার্থীরা
পরবর্তী নিবন্ধসাবেক এমপিদের ১৪ ল্যান্ডক্রুজার নিলামে কিনতে চায় ৩২ ব্যক্তি-প্রতিষ্ঠান