শিক্ষার হাল চাল

ছন্দা চক্রবর্ত্তী | বৃহস্পতিবার , ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ at ৯:৩৬ পূর্বাহ্ণ

জুলাই বিপ্লবের পর সৃষ্ট নতুন বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকার এর অগ্রযাত্রায় বাংলাদেশের ‘শিক্ষা ব্যবস্থার হালচাল বা বর্তমান অবস্থা’ সবচেয়ে জলন্ত প্রশ্ন হয়ে দেখা দিয়েছে। ছাত্র জনতার এক অভ্যুত্থানে শাসক দলকে বিদায় নিতে হয়েছে। অন্তর্র্বর্তী সরকারের হাতে বাংলাদেশ। সাধারণ মানুষ তথা আমজনতা আশায় বুক বাঁধলো। শিক্ষক, শিক্ষার্থী, অভিভাবক, শিক্ষা সংশ্লিষ্ট সকলের আশা এবার আইনের শাসন, মানবাধিকার, সঠিক শিক্ষা ব্যবস্থা সহ সর্বোপরি নিরাপদ বাংলাদেশ তৈরিতে আর কোনো বাধা নেই। বাংলাদেশের শিক্ষা ব্যবস্থার এক আমূল পরিবর্তন আসবেই।

শিক্ষা অর্জনের সর্ব্বোচ্চ ডিগ্রিধারী, বিশ্বের পরিচিত মুখ, অর্থনীতিবিদ, শিক্ষাবিদ, শান্তিতে নোবেল বিজয়ী ড. মুহম্মদ ইউনূস এখন প্রধান উপদেষ্টা। চট্টগ্রাম বিভাগের মানুষজন খুশিতে আরোও এক ধাপ এগিয়ে, কারণ তিনি চট্টগ্রামেরই লোক। উপদেষ্টাদের মধ্যেও সংখ্যা গরিষ্ঠতায় এগিয়ে চট্টগ্রাম। আশার যেন কমতি নেই।

শিক্ষার উদ্দ্যেশ্যই হল নিজেকে সভ্য করা, আলোকিত করা, আত্মবিশ্বাসী হওয়া এবং ইতিবাচক মনোভাবাপন্ন হওয়া। প্রযুক্তির যুগে, ইন্টারনেট ব্যবহারের এই সময়ে প্রযুক্তিগত দক্ষতা নিয়ে বিশ্ব নাগরিক হয়ে গড়ে তুলবে নিজেকে এটাই বর্তমান সময়ের শিক্ষার উদ্দ্যেশ্য। দিন যায়, মাস যায় বছর গড়াই, অতীতে ফিরে কেউ যায় না, সবাই সামনের দিকেই এগোতে থাকে। সবাই চায়, সেই সভ্য সমাজ, আর সভ্য সমাজ, পেতে হলে পরিবর্তনের প্রয়োজন, প্রয়োজন রুচিবোধের, প্রয়োজন চিন্তার, প্রয়োজন প্রযুক্তিগত দক্ষতার সর্বাধিক প্রয়োজন গবেষণার। ভবিষ্যৎ প্রজন্মকে কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে পৌঁছাতে হলে শিক্ষাব্যবস্থাকে ঢেলে সাজানো প্রয়োজন।

অন্তর্র্বর্তী সরকার ক্ষমতা গ্রহণের পর পর অভিভাবক সহ শিক্ষা সম্পর্কিত ব্যক্তিগণ নতুন শিক্ষাক্রমের প্রভাবে যারা বিরক্ত তারা স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন। হলোও তাই; বাংলাদেশের প্রাথমিক ও মাধ্যমিক শাখায় নতুন শিক্ষাক্রম বাতিল বলে ঘোষিত হলো। সিদ্ধান্ত হলো ২০১২ সালের হাসিনা সরকারের আমলের আলোচিত ব্যর্থ’ সৃজনশীল শিক্ষাক্রম’কেই বর্তমান শিক্ষাক্রম হিসেবে প্রচলন করা। চালু হোল ২০১২ সালের সৃজনশীল শিক্ষা কার্যক্রম। জুলাই আগস্ট বা সেপ্টেম্বর পর্যন্ত শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান সমূহে কোনো শিক্ষা কার্যক্রম চালু করা যায় নি, একটা নৈরাজ্য চলছিল প্রায় সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে। সে নৈরাজ্যের কথা আর বলছি না, পূর্বের লেখাতে বর্ণনা করা হয়েছে।

এখন ছয়মাস পার হয়ে গেল, যে আশায় সাধারণ মানুষ উদ্গ্রীব ছিল, সে আশার ছিটে ফোঁটাও খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না। শিক্ষা পরিচালনার ক্ষেত্রে আকাঙ্ক্ষিত বিষয়সমূহ যেমন অসাম্প্রদায়িক, ন্যায়নিষ্ঠা সম্পন্ন, সুস্থিত শিক্ষা ব্যবস্থার কাঠামো নিয়ে সমাজ গঠনের লক্ষ্যে যে মানসিকতা, মূল্যবোধ ইত্যাদিতে সরকারের যে দৃঢ় মনন ও মানসিকতার পরিবর্তন আনা, কিন্তু না, তা দেখা গেল, নাযে তিমিরে ছিল, সে তিমিরেই রয়ে গেল।

শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের দুরবস্থার দৃশ্য যখন পত্র পত্রিকায় এবং সামাজিক মাধ্যমে ফলাও করে প্রচারিত হচ্ছিল তখন আমাদের শিক্ষা ও পরিকল্পনা উপদেষ্টা বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ ওয়াহিদ উদ্দিন মাহমুদ প্রায় নীরব থাকার পর বিষয়গুলি নিয়ে সরব হলেন। তাঁর একটা বক্তব্যে পুরো শিক্ষা সমাজ আশ্বস্ত হলেন। তিনি মূলত শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে পদত্যাগের জন্য বল প্রয়োগ না করার উপর গুরুত্ব আরোপ করলেন। তিনি বললেন, ‘শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের বিভিন্ন পদে যাঁরা দায়িত্ব পালন করছেন, তাঁদের কারো বিরুদ্ধে ন্যায় সংগত কোনো অভিযোগ থাকলে ব্যবস্থা নেওয়া হবে। নতুন করে পদায়ন ও নিয়োগের কার্যক্রম চলছে, জোর করে পদত্যাগে বাধ্য করে অস্থিরতা সৃষ্টি করলে প্রশাসন ভেঙে পড়তে পারে। শিক্ষক কর্মকর্তা, কর্মচারীদের বেতনভাতা পেতে অসুবিধা হবে’। শিক্ষা উপদেষ্টা আরোও বলেন, ‘সরকারি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের শিক্ষক, কর্মকর্তা, কর্মচারীদের নিয়মবিধি অনুযায়ী পদায়ন ও বদলি করা হয়, তাঁদের বলপূর্বক পদত্যাগের সুযোগ নেই। একটি সফল অভ্যুত্থানের পর সুশৃঙ্খল সমাজে ফিরে যেতে চান উল্লেখ করে বলেন, শিক্ষাঙ্গনে শিক্ষকশিক্ষার্থীদের যে ধরনের সম্পর্ক আশা করা হয়, সেটি ফিরিয়ে আনতে হবে এবং কাউকে অপমানিত করা যাবে না’। তিনি শিক্ষাঙ্গনে ভদ্রতা রক্ষার উপর গুরুত্ব আরোপ করেন। এই নির্দেশনা যদি অন্তর্র্বর্তী সরকারের উপদেষ্টা মহোদয় এর পক্ষ থেকে প্রথম থেকেই আসতো, তবে শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের কলঙ্ক দাগসমূহ এড়ানো যেত এবং অপমানে যে সম্মানিত শিক্ষকগণ স্ট্রোক করেছেন তাদের প্রাণ এভাবে দিতে হত না এবং শিক্ষার্থীদের এহেন ন্যক্কারজনক ঘটনা ইতিহাসের পাতায় ঘৃণিত অক্ষরে লেখা হতো না। যাক দেরীতে হলেও শিক্ষা প্রতিষ্ঠান সমূহ এখন কিছুটা আয়ত্বে বলা যায়। তবে ঘাটতি এখনো প্রচুর।

১ জানুয়ারী ২০২৫ সাল থেকে নতুন বাংলাদেশে ২০১২ সালের পুরানো শিক্ষাক্রম নিয়ে নতুন শিক্ষা বর্ষ শুরু হয়েছে। শুরু হয়েছে সাধারণ মানুষের ইচ্ছার বহিঃপ্রকাশ সংস্কার। সরকারও জনগণের ইচ্ছার প্রতিফলন ঘটাতে প্রথম দৃশ্যমান সংস্কার শুরু করলেন পাঠ্যবই সংস্কার দিয়ে। ফ্যাসিস্ট হাসিনা সরকারের নতুন শিক্ষাক্রম সম্পূর্ণ ভাবে বাতিল আবার এই সরকারেরই ২০১২ সালের শিক্ষাক্রম অনুযায়ী পাঠ্যবই ছাপানোর কাজ দ্রুততার সাথে নতুন বাংলাদেশ তৈরিতে যোগ হল পাঠ্যসূচী সংস্কার কাজ। প্রথম আলো পত্রিকার তথ্য মতে, এনসিটিবি ৪১ জন বিশেষজ্ঞ নিযুক্ত করলেন পাঠ্যবই পরিমার্জন কার্যক্রমে। এই ৪১ জন বিশেষজ্ঞ গবেষণা করে ৪৪১টি বই পরিমার্জন করেছেন এতে অনেক বিষয়বস্তু সংযোজন ও বিয়োজন করা হয়েছে। বেশ কিছু গদ্য, প্রবন্ধ, উপন্যাস ও কবিতা বা বিষয়বস্তু বাদ দেওয়া হয়েছে, পাশাপাশি নতুন করে স্থান পেয়েছে জুলাই অভ্যূত্থানের বিষয়বস্তু, গল্প, কবিতা সংকলন, ছবি ও গ্রাফিতির মাধ্যমে ছাত্রজনতার অভ্যূত্থানকে তুলে ধরা হয়েছে।

এনসিটিবির সূত্র মতে এই নূতন করে পুরানো শিক্ষাক্রমকে আঁকড়ে ধরে পরিমার্জিত পাঠ্যবই সমূহ ২০২৫ সালের পঠনপাঠনের জন্য প্রাথমিক ও মাধ্যমিক স্তরের ৪০ কোটিরও বেশি বই ছাপানো হচ্ছে। তবে শিক্ষাবর্ষের প্রথম মাস জানুয়ারি শেষ হয়ে গেলেও এখনো দেশের সব শিক্ষার্থীদের কাছে সব বই পৌঁছানো সম্ভব হয়নি। পরিমার্জন কার্যক্রম ও অন্তর্র্বর্তী সরকারের স্বল্প সময়ের স্থায়ীত্বের কারণে এই বছর বই উৎসবও হয় নি এবং যথাসময়ে বই প্রস্তুতও হয় নি। অবশ্য ফ্যাসিস্ট সরকারের বই উৎসবকে এই সরকার নিরুৎসাহিত করতেও পারে, এটাই স্বাভাবিক। তবে এই বই উৎসব শিক্ষার্থী, অভিভাবকদের একটা অনুপ্রেরণা ও আনন্দের বিষয় ছিল। হয়তো আগামীতে সরকার এই বিষয়ে ভাববেন। এবার অবশ্য অন্তর্র্বর্তী সরকার ‘নাই মামার চেয়ে কানা মামা ভালো’ হিসেবে এনসিটিবির ওয়েবসাইটে সব পাঠ্য বই এর পিডিএফ দিয়ে দিয়েছেন। ধনীর সন্তানেরা এটি সংগ্রহ করার সুযোগ পাচ্ছে, দরিদ্র এবং গ্রামের শিক্ষার্থীরা সরকার থেকে বিনামুল্যে পাওয়ার পথ চেয়েই বসে আছে।

অন্তর্র্বর্তী সরকারের পাঠ্যবই পরিমার্জনে শুধু শেখ হাসিনা ও বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান বিষয়ক বিষয়বস্তু বাদ দিয়েই পরিমার্জনের আধিক্য পরিলক্ষিত হয়েছে। এটাই স্বাভাবিক। ‘বাংলা’ ও ‘ইংরেজি’ সাহিত্যে এবং ‘বাংলাদেশ ও বিশ্ব পরিচয়’ বিষয়ে জুলাই অভ্যূত্থান এর প্রেক্ষাপট সংযোজন হয়েছে। সপ্তম শ্রেণির ‘ইংলিশ ফর টু ডে’ বইয়ে ‘স্পোর্টস পারসোনালিটি’ নামক একটি লেসনে বাংলাদেশের দাবার কিংবদন্তী খেলোয়াড় রানি হামিদের ছবি ও বাংলাদেশের নারী ক্রিকেট দলের অধিনায়ক ‘নিগার সুলতানা জ্যোতি’র ছবি স্থান পাওয়াকে পজেটিভ চিন্তার উদাহরণ হিসেবে দেখা যাচ্ছে। গণিত, উচ্চতর গণিত, বিজ্ঞান এবং ধর্মীয় বই সমূহে হাসিনা সরকারের ২০১২ সালের ব্যর্থ সৃজনশীল শিক্ষাক্রমের পাঠ্যসূচী মোতাবেক ছাপানো হয়েছে। এতে আমরা পিছনের অবস্থায় ফিরে গেলাম মনে করা হচ্ছে।

২০১২ সালের সৃজনশীল শিক্ষাক্রমের ব্যর্থ হওয়ার অনেকগুলো কারণের মধ্যে একটি কারণ ছিল, শিক্ষক সমাজের সৃজনশীল জ্ঞানের সীমাবদ্ধতা। শিক্ষকগণ শিক্ষার্থীদের জন্য প্রয়োজনীয় দক্ষতা নিয়ে পাঠ দানের প্রশিক্ষণ গ্রহণে যথাযথ সক্ষমতা লাভ করায় অসমর্থ হয়েছিলেন। পাঠদান প্রক্রিয়াও সংগৃহীত স্লাইড নির্ভর হয়ে পড়েছিল, যার ফলে শিক্ষার মানের ক্রমশ ক্রমাবনতি হয়েছিল। শিক্ষার্থীদের উপযুক্ত ও মানসম্মত শিক্ষায় শিক্ষিত করার মূল একক হল শিক্ষক। তাই শিক্ষকদের জন্য প্রয়োজনীয় প্রশিক্ষণ অপরিহার্য। শিক্ষকদেরকে প্রস্তুত করা না গেলে, প্রয়োজনীয় পরিবেশ ও সুযোগ নিশ্চিত না হলে, শিক্ষকদের বেতন ও মর্যাদা বাড়ানোর বিষয়ে চিন্তাভাবনা করা না গেলে শিক্ষার মান ফিরিয়ে আনা সম্ভব হবে না। যদি ২০১২ সালের সৃজনশীল শিক্ষাক্রমকে নিয়ে শিক্ষা কার্যক্রম এগিয়ে নিতে হয়, তবে সরকারকে এসব বিষয় নিয়ে গবেষণা করে এগোনো প্রয়োজন, অন্যথা বাংলাদেশে মান সম্মত শিক্ষার স্থান অধরাই থেকে যাবে।

লেখক: প্রাবন্ধিক; প্রাক্তন অধ্যক্ষ, হুলাইন ছালেহনূর ডিগ্রি কলেজ।

পূর্ববর্তী নিবন্ধপটিয়ায় আলো ছড়াচ্ছে ‘শহিদ ছবুর’ শিশুতোষ পাঠাগার
পরবর্তী নিবন্ধনিজ নিজ দেশের পরিচয়ে পরিচিত হতে কোনো সমস্যা থাকার কথা নয়