হাসিনার নির্দেশে গুরুতর মানবাধিকার লঙ্ঘন

জেনেভায় জাতিসংঘের তদন্ত প্রতিবেদন প্রকাশ । অভ্যুত্থানে প্রাণ হারান প্রায় ১৪০০, তাদের ১২-১৩ শতাংশ শিশু । র‌্যাব-এনটিএমসি বিলুপ্তির পরামর্শ

| বৃহস্পতিবার , ১৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ at ৬:১৮ পূর্বাহ্ণ

বাংলাদেশে গত জুলাইআগস্টে প্রায় ১৪০০ জনের মতো নিহত হয়েছেন। তাদের বেশিরভাগের মৃত্যু হয়েছে রাইফেল ও শটগানের গুলিতে। ওই সময় নিরাপত্তা বাহিনী ও গোয়েন্দা সংস্থাগুলোর সমন্বয়কাজে নেতৃত্ব দিয়েছেন তখনকার প্রধানমন্ত্রী ও স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী। তাদের নির্দেশেই বিক্ষোভ দমনে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ করেছে নিরাপত্তা সংস্থাগুলো। জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনারের কার্যালয়ের (ওএইচসিএইচআর) তদন্ত প্রতিবেদনে এসব তথ্যের উল্লেখ করা হয়েছে।

প্রতিবেদনে বলা হয়, অভ্যুত্থানে আরও হাজার হাজার মানুষ গুরুতর আহত হয়েছে। এছাড়া পুলিশ ও র‌্যাবের তথ্য অনুযায়ী ১১ হাজার ৭০০ জনকে তখন আটক করা হয়েছিল। যারা নিহত হয়েছে তাদের মধ্যে ১২১৩ শতাংশ শিশু। পুলিশ ও অন্য নিরাপত্তা বাহিনীর দ্বারা শিশুরা টার্গেট কিলিংয়ের শিকার হয়েছে ও পঙ্গু হয়েছে, সরকারিবেসরকারি বিভিন্ন সূত্রের সাথে অন্যান্য সূত্র থেকে পাওয়া প্রমাণগুলোর সমন্বয় করে ওএইচসিএইচআরএর ওই প্রতিবেদনে এসব বলা হয়েছে। খবর বিবিসি বাংলা ও বিডিনিউজের।

এতে আরও বলা হয়, বাংলাদেশের গোয়েন্দা সংস্থাগুলো তখন পদ্ধতিগত ও সংগঠিতভাবে মারাত্মক মানবাধিকার লঙ্ঘনের অংশ হয়ে ওঠেছিল। মানবাধিকার লঙ্ঘনের ঘটনাগুলোর আরও স্বাধীন ও নিরপেক্ষ তদন্তের পরামর্শ দিয়েছে ওএইচসিএইচআর। একই সঙ্গে সংস্থাটি রাজনৈতিক দলকে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া থেকে বিরত থাকার আহ্বান জানিয়েছে। এতে র‌্যাবএনটিএমসি বিলুপ্ত করা এবং সামরিক বাহিনীর কর্মপরিধি সুনির্দিষ্ট করার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে।

জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাইকমিশনার ভলকার টুর্ক জেনেভায় জাতিসংঘ মানবাধিকার কার্যালয়ে এক সংবাদ সম্মেলনে গতকাল বুধবার বাংলাদেশ সময় দুপুরে এ রিপোর্ট প্রকাশ করেন। বর্তমান অন্তর্বর্তী সরকারের আমন্ত্রণে ওএইচসিএইচআর বাংলাদেশে এসে ওই তদন্ত করেছিলো। সংস্থাটি বলেছে, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ও অন্যান্য ক্ষেত্রের কর্মকর্তারা কীভাবে একাধিক বৃহৎ আকারের অভিযানের নির্দেশনা দেন ও তদারকি করেন, তার বর্ণনা দিয়েছেন বিক্ষোভ দমনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত সাবেক ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা এবং অন্যান্য অভ্যন্তরীণ সূত্র; যেখানে নিরাপত্তা ও গোয়েন্দা বাহিনী বিক্ষোভকারীদের গুলি করে হত্যা করেছিল বা নির্বিচারে গ্রেপ্তার ও নির্যাতন করেছিল। প্রতিবেদনে বলা হয়, নিরাপত্তা বাহিনী পরিকল্পিতভাবে এবং অবৈধভাবে বিক্ষোভকারীদের হত্যা বা পঙ্গু করার সঙ্গে জড়িত ছিল, এর মধ্যে এমন ঘটনাও ছিল যেখানে একদম সামনে থেকে গুলি করা হয়েছিল।

জাতিসংঘ মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশন বলছে, বিক্ষোভে প্রথম দিকের অগ্রভাগে থাকার কারণে নারী ও মেয়েরাও নিরাপত্তা বাহিনী এবং আওয়ামী লীগ সমর্থকদের হামলার শিকার হন। তারা বিশেষভাবে যৌন ও লিঙ্গভিত্তিক সহিংসতার শিকার হন। যার মধ্যে রয়েছে শারীরিক সহিংসতা ও ধর্ষণের হুমকি। কিছু নথিভুক্ত ঘটনার ক্ষেত্রে আওয়ামী লীগ সমর্থকদের হাতে যৌন নির্যাতনের তথ্যও এসেছে। প্রতিবেদনে বলা হয়, সাবেক আওয়ামী লীগ সরকার শান্তিপূর্ণ নাগরিক ও রাজনৈতিক ভিন্নমত দমন করার জন্য ব্যাপকভিত্তিক আইনি ও প্রাতিষ্ঠানিক কাঠামোর উপর নির্ভর করেছিল। এমন নিপীড়নমূলক পরিস্থিতির কারণে বিরোধীরাও সরকারের প্রতি বিক্ষুব্ধ হয়ে উঠে প্রতিবাদ সহিংসতার দিকে ধাবিত হয়।

আওয়ামী লীগ সরকার সে সময় বিভিন্ন বাহিনী ও প্রশাসন যন্ত্রকে কীভাবে ব্যবহার করেছে, সেই বিবরণও এসেছে প্রতিবেদনে। ডিজিএফআই, এনএসআই, এনটিএমসি এবং পুলিশের বিশেষ শাখা, গোয়েন্দা শাখা, সিটিটিটিসি প্রতিবাদকারীদের দমনের নামে সরাসরি মানবাধিকার লঙ্ঘনের সঙ্গে সরাসরি জড়িত ছিল। তারা গোপনীয়তার অধিকার লঙ্ঘন করে নজরদারির মাধ্যমে প্রাপ্ত তথ্য এক সংস্থা থেকে আরেক সংস্থার সঙ্গে শেয়ার করে এবং জুলাইয়ের শেষের দিকে ব্যাপকহারে নির্বিচারে গ্রেপ্তারের পক্ষে প্রচার চালায়। গোয়েন্দা শাখা বন্দিদের কাছ থেকে তথ্য ও স্বীকারোক্তি আদায়ের জন্য নিয়মিত ও নির্বিচারে আটক ও নির্যাতনের আশ্রয় নেয়। সিটিটিসির সদর দপ্তর বন্দিশালা হিসেবে ব্যবহৃত হয়। গোয়েন্দা পুলিশ এবং ডিজিএফআই যৌথভাবে ছাত্রনেতাদের সেখানে আটকে রেখে আন্দোলন থেকে সরে আসতে চাপ দেয়। প্রতিবেদনে বলা হয়, ডিজিএফআই, এনএসআই ও গোয়েন্দা পুলিশ আহতদের জীবনরক্ষাকারী চিকিৎসা সেবা বাধাগ্রস্ত করে, হাসপাতালে রোগীদের জিজ্ঞাসাবাদ, আহত ব্যক্তিদের গ্রেপ্তার এবং চিকিৎসাকর্মীদের ভয়ভীতি দেখায়। এ পরিস্থিতি আইন সহায়তাকারী কর্তৃপক্ষ বা বিচার বিভাগ এমন কোনো কার্যকর পদক্ষেপ নেয়নি, যাতে নির্বিচারে আটক ও নির্যাতনের ঘটনা বন্ধ করা যায়। এ ধরনের কাজের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট কোনো কর্মকর্তার জবাবদিহিতাও নিশ্চিত করা হয়নি।

প্রতিবেদন প্রকাশ অনুষ্ঠানে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনার ফলকার টুর্ক বলেন, এই নৃশংস প্রতিক্রিয়া ছিল সাবেক সরকারের একটি পরিকল্পিত এবং সমন্বিত কৌশল, যারা জনতার বিরোধিতার মুখে ক্ষমতা আঁকড়ে রাখতে চেয়েছিল। বিক্ষোভ দমন করার কৌশলের অংশ হিসেবে রাজনৈতিক নেতৃত্ব এবং ঊর্ধ্বতন নিরাপত্তা কর্মকর্তাদের জ্ঞাতসারে, তাদের সমন্বয় ও নির্দেশনায় শত শত বিচার বহির্ভূত হত্যাকাণ্ড, ব্যাপক নির্বিচারে গ্রেপ্তার ও আটক এবং নির্যাতন চালানো হয়েছে বলে বিশ্বাস করার যুক্তিসঙ্গত কারণ রয়েছে। তিনি বলেন, আমরা যে সাক্ষ্য এবং প্রমাণ সংগ্রহ করেছি, তা ব্যাপক রাষ্ট্রীয় সহিংসতা এবং টার্গেট করে হত্যার এক উদ্বেগজনক চিত্র তুলে ধরে, যা মানবাধিকার লঙ্ঘনের মধ্যে সবচেয়ে গুরুতর এবং যা আন্তর্জাতিক অপরাধের পর্যায়েও পড়তে পারে। জাতীয় ক্ষত উপশম এবং বাংলাদেশের ভবিষ্যতের জন্য এসব ঘটনার দায়বদ্ধতা ও ন্যায়বিচার অপরিহার্য।

জাতিসংঘের মানবাধিকারবিষয়ক হাইকমিশনারের এই রিপোর্টকে স্বাগত জানিয়েছেন অন্তর্বর্তী সরকারের প্রধান উপদেষ্টা অধ্যাপক মুহাম্মদ ইউনূস। যারা আইন ভঙ্গ করেছেন এবং মানুষের মানবিক ও নাগরিক অধিকার লঙ্ঘন করেছেন, তাদেরকে জবাবদিহির আওতায় নিয়ে আসতে সংশ্লিষ্টদের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধজাতিসংঘের রিপোর্টকে স্বাগত জানিয়েছে সরকার
পরবর্তী নিবন্ধ‘মেয়ে চুরি করেছে’ অভিযোগে মারধরে মায়ের মৃত্যু