২০২৩ সালের ১ ডিসেম্বর ঢাকা–কক্সবাজার ট্রেন যোগাযোগ উদ্বোধনের পর চালু করা হয়। যতদিন পর্যন্ত ফৌজদারহাট–ষোলশহর কটলাইন চালু হবে না ততদিন এ ট্রেন চট্টগ্রাম স্টেশনে থেমে ইঞ্জিন পাল্টাতে হবে। অর্থাৎ চট্টগ্রাম ট্রেন স্টেশনে যাত্রাবিরতি নিশ্চিত বলা যাবে। সুবর্ণ ও সোনার বাংলা অনেকটা একই মানের একই আদলের দৈনিক দু’টি করে ট্রেন ঢাকা থেকে চট্টগ্রাম স্টেশন হয়ে কক্সবাজার যাচ্ছে, কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রাম হয়ে ঢাকা যাচ্ছে।
এখন প্রশ্ন আসে চট্টগ্রাম–কক্সবাজার ট্রেনের কী খবর! কিছুদিন আগে পুরাতন কিছু কোচকে একটি ট্রেনের নাম কক্সবাজার এক্সপ্রেস দিয়ে চট্টগ্রাম থেকে সকাল ৭ টায় ছেড়ে কক্সবাজার যেত, ঐ ট্রেনটি সন্ধ্যায় কক্সবাজার ছেড়ে চট্টগ্রাম পৌঁছত। এই ট্রেনগুলো এত পুরাতন যে কোন মতে ব্যবহারের উপযোগী করে চালিয়ে দেয়া। মনে হয় ঐ একই ট্রেনটিকে সৈকত এক্সপ্রেস ও প্রবাল এক্সপ্রেস নাম দিয়ে চট্টগ্রাম থেকে দৈনিক দু’বার কক্সবাজার যাওয়া হচ্ছে এবং কক্সবাজার থেকে দৈনিক দু’বার চট্টগ্রামে আসা হচ্ছে। ট্রেনটি দোহাজারী পর্যন্ত পুরাতন লাইনে ২/৩টি স্টেশন এবং দোহাজারী থেকে কক্সবাজার নতুন লাইনে ৩/৪টি স্টেশনে থেমে কক্সবাজার যাওয়া হচ্ছে।
ঢাকা–কক্সবাজার ট্রেন অতীব জনপ্রিয় তেমনি চট্টগ্রাম–কক্সবাজার ট্রেন কোন অংশে কম নয়। কিন্তু চট্টগ্রাম–কক্সবাজার ট্রেন যোগাযোগে তেমন গুরুত্ব পাচ্ছে বলে মনে হয় না। পুরাতন কোচের এই লক্কড় ঝক্কড় মার্কা ট্রেনটির চট্টগ্রাম–কক্সবাজার যাতায়াতে একমাত্র সম্বল বলা চলে। ট্রেন কর্তৃপক্ষের একটাই পরিষ্কার জবাব, তাদের কোচের সংকট ইঞ্জিনের সংকটে যাত্রী চাহিদা থাকা সত্ত্বেও ট্রেন দিতে পারছে না।
গত জানুয়ারি থেকে টিভিতে, সংবাদপত্রে ট্রেন কর্তৃপক্ষ বারে বারে জানান দিচ্ছিল, চট্টগ্রাম থেকে দৈনিক দু’টি ট্রেন কক্সবাজার যাবে এবং কক্সবাজার থেকে দৈনিক দু’টি ট্রেন চট্টগ্রামে আসবে। ট্রেনের নামও দেয়া হয় সৈকত এক্সপ্রেস ও প্রবাল এক্সপ্রেস। কিন্তু ট্রেন কর্তৃপক্ষ সত্য প্রকাশ করেনি। বাস্তবতায় জানান দিচ্ছে আর তা হল–কয় মাস থেকে চালু থাকা অতি পুরাতন কোচের ট্রেনটিকে ঢাকঢোল পিটিয়ে দৈনিক দু’বার করে চালু করছে।
২০১৮ সালে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকার এই প্রকল্প হাতে নেয় দোহাজারী থেকে প্রায় কক্সবাজার ১০০ কি.মি ট্রেন লাইন করার জন্য। এক লাইন হিসেবে নির্মিত করা এই ট্রেন লাইনটি ডুয়েল গেজ। মনে হয় নতুন ৯টি স্টেশন নিয়ে এ দোহাজারী ট্রেনলাইন। যেখানে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকার বাজেটে ট্রেন লাইন হয় সেখানে অতীব যাত্রী চাহিদা থাকা সত্ত্বেও কোচ ইঞ্জিন সংকট দেখিয়ে অজুহাত গ্রহণযোগ্য নয়। চট্টগ্রাম–কক্সবাজার ট্রেন যোগাযোগ বা গুরুত্ব ঢাকার চেয়ে কোন অংশে কম নয়। চট্টগ্রামবাসীর পক্ষ থেকে আন্দোলন প্রতিক্রিয়া প্রতিবাদ বারে বারে হয়েছে চট্টগ্রাম–কক্সবাজার ট্রেনের সংখ্যা বাড়ানোর জন্য। বাড়ানো হয়েছে ট্রেন কর্তৃপক্ষের সুক্ষ্ম কৌশলের মাধ্যমে। আর তা হল অতি পুরাতন লক্কড় ঝক্কড় মার্কা কোচগুলো দিয়ে চট্টগ্রাম–কক্সবাজার দৈনিক একবার যাওয়া–আসার ক্ষেত্রে দৈনিক দু’বার যাওয়া–আসা করাচ্ছে।
বাসে তথা সড়কপথে চট্টগ্রাম–কক্সবাজার যেতে বা আসতে ন্যূনতম ৪ ঘণ্টা সময় নেয়। অধিকাংশ ক্ষেত্রে ৫/৬ ঘণ্টাও লাগে। যেহেতু চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়কে জায়গায় জায়গায় যানজট লেগেই থাকে। চট্টগ্রাম–ঢাকার মত চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মহাসড়কটি ডিভাইডেড হাইওয়ের মত উন্নীত না হওয়ায় এই মহাসড়ক দিয়ে যাতায়াত ঝঁকিপূর্ণ। সময়ও লাগে ৪/৬ ঘণ্টা। অতএব চট্টগ্রাম–কক্সবাজার ট্রেনের যাতায়াত আরামদায়ক নিরাপদ এবং সময়ও ৩ ঘণ্টা বা কম বেশি। এখন প্রশ্ন আসে ২০১৮ সালে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি টাকা ব্যয়ে বিশাল প্রকল্পের কাজ শুরু হয়ে যায়। উদ্বোধন হয় ২০২৩ সালের ১১ নভেম্বর। অর্থাৎ দোহাজারী–কক্সবাজার ট্রেন পথ সম্পন্ন হতে প্রায় ৫ বছর সময় যায়। কিন্তু ট্রেন কর্তৃপক্ষ এই পথের জন্য কোচ ও ইঞ্জিন আমদানী করল না কেন। এই বিশাল প্রকল্পের কাজটি ব্যবহারে রাখতে যথাযথভাবে জনগণের চাহিদা অনুপাতে ট্রেনের কোচ ও ইঞ্জিন আমদানী করা কোন ব্যাপার ছিল না।
যেখানে দেশ ঋণে জর্জিত সেখানে কক্সবাজার আইকনিক ট্রেন স্টেশন নির্মাণে বিশাল ব্যয় কোন প্রয়োজন ছিল বলে মনে করি না। যেখানে রয়েছে তারকামানের হোটেল, শপিংমল, কনভেনশন হল, এসব না হলেও ত চলে।
সড়ক মহাসড়ক পথে যাতায়াত মানে আমদানিকৃত বাস, কার ইত্যাদি ব্যবহারও তেল পুড়ানো। যা বৈদেশিক মুদ্রা ব্যয়ে হয়। অতএব ট্রেনই দেশের জন্য উত্তম।
১৯৩০/৩১ সালে চট্টগ্রাম–দোহাজারী ও চট্টগ্রাম–নাজিরহাট ট্রেন সার্ভিস চালু করে ব্রিটিশ সরকার। সেই লক্ষে কালুরঘাট ব্রীজ নির্মিত হয়। এই দুই লাইনের ট্রেনগুলো খুবই জনপ্রিয় ছিল। জনপ্রিয় ছিল ব্রিটিশ আমল পেরিয়ে পাকিস্তান আমল পর্যন্ত।
১৯৫০ এর দশকে বাবার সাথে একাধিক বার চট্টগ্রাম থেকে ট্রেনে কাঞ্চননগর যাওয়া–আসা হয়। ওখান থেকে প্রায় এক দেড় কিলোমিটার দূরত্বে পটিয়া টি এস্টেট। পাহাড়ের উপর টি এস্টেটের বাংলোতে ২/৩ দিন থাকা হয়। ঐ সময় মিয়াখান নগর শহরের বাড়ি থেকে ঘোড়ার গাড়ি করে বটতলী ট্রেন স্টেশনে আসা হয়। তখন চট্টগ্রাম ট্রেন স্টেশনটি বটতলী ট্রেন স্টেশন হিসেবে প্রসিদ্ধ। এখানে একটি বড় আকৃতির বটগাছ ছিল বিধায় এই স্টেশনের নাম হয়ে যায় বটতলী স্টেশন।
সর্বশেষ ১৯৬৩ সালের দিকে দোহাজারী থেকে ট্রেনে চট্টগ্রাম আসা হয়। ১৯৫০ এর দশকের শেষে ১৯৬০ এর দশকের শুরুর দিকে পাকিস্তান সরকার কালুরঘাট ব্রীজের উপর প্লেট বসিয়ে ঢালাই করে সড়কপথের যানবাহন চলাচলের ব্যবস্থা করে। সাথে ট্রেনও চলাচল করে। ঐ সময় সন্ধ্যার পর ব্রীজের উপর বাস, কার ইত্যাদি চলাচল বন্ধ রাখা হয়।
দক্ষিণ চট্টগ্রামের বাঁশখালীর বাসিন্দা, বৃহত্তর চকরিয়ায় রয়েছে পারিবারিক এস্টেট, যার সদর দপ্তর কক্সবাজারে যাওয়া আসা হয়ে আসছিল নিয়মিত।
চট্টগ্রাম–কক্সবাজার ট্রেন সার্ভিস চালু হয়েছে, মন চাচ্ছে প্রায় ৬২ বছর পর এ লাইনে ট্রেন যাত্রা উপভোগ করতে। সাথে সঙ্গী হয় পটিয়ার এডভোকেট নুরুল আলম চৌধুরী এবং সাতকানিয়ার এডভোকেট মুহাম্মদ ইলিয়াস ও এডভোকেট আবুল কাশেম। তাদের বাড়ি সংলগ্ন বিঠার উপর দিয়ে ট্রেন যাবে।
চট্টগ্রাম–কক্সবাজার ২ ফেব্রুয়ারি রবিবার ভোর ৬ টা ১৫ মিনিটের ট্রেনের টিকেট কাটা হয়। এই ট্রেনটি ৬/৭ টি স্টেশন থেমে কক্সবাজার পৌঁছবে। ৩ রাত কক্সবাজার অবস্থানের পর ৫ ফেব্রুয়ারি বুধবার দুপুর সাড়ে ১২ টায় ঢাকার ট্রেনে কক্সবাজার থেকে চট্টগ্রাম আসার টিকেট কাটা হয়। ভোরে আমরা ৪ জন চট্টগ্রাম ট্রেন স্টেশনে ফজরের নামাজ পড়লাম অব্যবস্থাপনায়। দেয়ালে এবাদতখানা লিখা থাকলেও বাস্তবে কোন এবাদতখানা নেই। অসংখ্য যাত্রী, আমাদের পনের মিনিট আগে চট্টলা এক্সপ্রেস ঢাকার উদ্দেশ্যে ছেড়ে যাবে। সূর্য উদয় প্রায় ৬ টা ৩৫ মিনিটে।
আমাদের ট্রেনে ৩/৪ মানের ক্লাস রয়েছে। প্রত্যেকটা কোচ জরাজীর্ণ। ট্রেনের কোচগুলোতে নাম লেখা হয়েছে চক দিয়ে। ঘোষণা গত ২/৩ সপ্তাহ আগে থেকেই চলছে। ট্রেনের এমন কোন বিভাগ উপবিভাগ নেই যেখানে লোকবল নেই। কিন্তু দুঃখের বিষয়, ২/৩ সপ্তাহ যাবৎ ঢাকঢোল পিটিয়ে বারে বারে প্রচার চালালেও এই কোচগুলো চালুর শতভাগ প্রস্তুত নয় মনে করি।
আমাদের যেহেতু এই যাত্রাটা উপভোগ করার অতি আগ্রহ, কাজেই অব্যবস্থাপনা আমাদেরকে দাহ করছে না। প্রায় ২০/২৫ মিনিট বিলম্বে আমরা কক্সবাজার পৌঁছি সম্ভবত ১০ টার দিকে।
৩ রাত পর আমরা সরাসরি কক্সবাজার ট্রেন স্টেশনে চলে আসি ন্যূনতম ৩০ মিনিট আগে। আমাদের কক্সবাজার ভ্রমণটা মুখ্য নয়, ট্রেন যাত্রা উপভোগ করাটাই মুখ্য। সোনার বাংলা, সুবর্ণ এক্সপ্রেসের একই আদলের ট্রেন মনে হল এটি। জানতে পারলাম ২৬ টি কোচ রয়েছে, যা বিশাল ব্যাপার। তৎমধ্যে মধ্যখানে দু’টি কোচ চট্টগ্রামের জন্য বরাদ্দ। ট্রেনটি নন স্টপ কক্সবাজার থেকে সরাসরি এসে চট্টগ্রাম থামবে, অতঃপর ঢাকা চলে যাবে।
বস্তুতঃ ঢাকা–কক্সবাজার ট্রেন সার্ভিস জনপ্রিয় যাত্রীর কমতি নেই, চট্টগ্রাম–কক্সবাজার ট্রেন সার্ভিসের গুরুত্বও কম নয়। ঢাকা–কক্সবাজার ট্রেনটি চট্টগ্রাম দিয়ে যাবে, কাজেই চট্টগ্রামবাসীর গুরুত্বকে উপেক্ষা করার সুযোগ নেই। বর্তমান অর্ন্তবর্তীকালীন সরকার ৫/৭ টি ইঞ্জিন ও শ’খানেক কোচ আমদানি করলে চট্টগ্রাম–কক্সবাজার মানসম্পন্ন ট্রেন সার্ভিস দেয়ার সাথে সাথে ঢাকা– কক্সবাজার ট্রেনের সার্ভিস আরও বাড়ানো যাবে।
ট্রেন কর্তৃপক্ষ ইচ্ছা করলে চট্টগ্রাম–কক্সবাজার এবং চট্টগ্রাম হয়ে ঢাকা–কক্সবাজার বিলাসবহুল আরামদায়ক ট্যুরিস্ট ট্রেনও চালু করতে পারে, যা বিশ্বের বিভিন্ন দেশে রয়েছে।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট।