পাইপলাইনে ঢাকায় জ্বালানি তেল সরবরাহ অবশেষে শুরু

সিস্টেম লস কমবে, বছরে বাঁচবে কয়েক হাজার কোটি টাকা গত রাত ৯টা পর্যন্ত ৪৮ লাখ লিটার তেল সরবরাহ

হাসান আকবর | বুধবার , ১২ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ at ৭:৫৬ পূর্বাহ্ণ

অবশেষে চট্টগ্রাম থেকে ঢাকায় পাইপলাইনে জ্বালানি তেল সরবরাহ শুরু হয়েছে। যান্ত্রিক সমস্যার কারণে নির্ধারিত সময়ের কয়েক ঘণ্টা পর সোমবার রাত থেকে শুরু হয় জ্বালানি তেল সরবরাহ। পাইপলাইনে জ্বালানি তেল সরবরাহের এই কার্যক্রম দেশের জ্বালানি খাতের ইতিহাসে বৈপ্লবিক পরিবর্তন সাধনের পাশাপাশি বছরে কয়েক হাজার কোটি টাকা রক্ষা করবে। এছাড়া সিস্টেম লস কমবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করে সূত্র বলেছে, একইসাথে দেশের প্রথম সর্বাধুনিক অটোমেটেড ডিপোর কার্যক্রমও অচিরে শুরু হবে। চট্টগ্রাম থেকে নারায়ণগঞ্জের গুদনাইল পর্যন্ত বিস্তৃত আড়াইশ কিলোমিটারের এই পাইপলাইনে গত রাত ৯টা পর্যন্ত ৪৮ লাখ লিটার জ্বালানি তেল সরবরাহ দেওয়া হয়েছে।

সূত্রে জানা যায়, প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে চট্টগ্রাম থেকে কুমিল্লা, চাঁদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়া, নায়ারণগঞ্জ, ঢাকাসহ সন্নিহিত অঞ্চলে পাইপলাইনে জ্বালানি তেল সরবরাহ দেওয়ার জন্য একটি প্রকল্প বাস্তবায়ন করা হয়। এই প্রকল্পের আওতায় ১৬ ইঞ্চি ব্যাসের আড়াইশ কিলোমিটার দীর্ঘ পাইপলাইন স্থাপন করা হয়েছে। বছরে পঞ্চাশ লাখ টন জ্বালানি তেল সরবরাহের সক্ষমতাসম্পন্ন এই পাইপলাইনের মাধ্যমে চট্টগ্রাম থেকে কুমিল্লার বারুড়া হয়ে জ্বালানি তেল যাবে নারায়ণগঞ্জের গোদনাইলে। পাইপলাইনে বিভিন্ন এলাকায় স্থাপন করা হয়েছে ৭টি স্টেশন। কুমিল্লার বরুড়ায় স্থাপন করা হয়েছে সর্বাধুনিক প্রযুক্তিসমৃদ্ধ অটোমেটেড ডিপো। এই ডিপোতে জ্বালানি তেল গ্রহণ এবং সরবরাহ নিয়ন্ত্রিত হবে সর্বাধুনিক প্রযুক্তিতে। তেলের ওজন, তাপমাত্রা, সরবরাহ সবই পরিচালিত হবে কম্পিউটারাইজড প্রযুক্তিতে। এখানে ম্যানুয়ালি কোনো কাজ হবে না। ফলে সিস্টেম লস শূন্যের কোটায় নামিয়ে আনা সম্ভব হবে। সর্বাধুনিক এই ডিপো থেকে চাঁদপুর, ব্রাহ্মণবাড়িয়াসহ সন্নিহিত অঞ্চলের প্রয়োজনীয় জ্বালানি তেল সরবরাহ করা হবে; যা বর্তমানে নৌপথে চাঁদপুরে পাঠানো হয়ে থাকে।

বছরে ৫০ লাখ টন জ্বালানি তেল সরবরাহের সক্ষমতাসহ জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করা, জ্বালানি পরিবহনের সিস্টেম লস কমানো, নৌপথে তেল পরিবহনের বিপুল খরচ সাশ্রয়সহ দ্রুততম সময়ে তেল পৌঁছানোর লক্ষ্যে চট্টগ্রাম থেকে নারায়ণগঞ্জ এবং ঢাকার ফতুল্লা পর্যন্ত আড়াইশ কিলোমিটার পাইপলাইন নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। ‘চট্টগ্রাম হতে ঢাকা পর্যন্ত পাইপলাইনে জ্বালানি তেল পরিবহন’ শীর্ষক প্রকল্পটি ২০১৬ সালের অক্টোবরে একনেকের অনুমোদন পায়। কথা ছিল ২০২০ সালের ৩০ জুন প্রকল্পের কাজ শেষ হবে। কিন্ত নানা প্রতিবন্ধকতা এবং প্রতিকূলতার মাঝে পড়তে হয় গুরুত্বপূর্ণ এই প্রকল্পটিকে। পরে সরকার সেনাবাহিনীর মাধ্যমে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়। পদ্মা অয়েল কোম্পানির তত্ত্বাবধানে সেনাবাহিনী প্রকল্পটির কাজ সম্পন্ন করেছে।

চট্টগ্রামের ডেসপ্যাচ টার্মিনালের স্ক্যাডা মাস্টার কন্ট্রোল স্টেশন থেকে ২৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ পাইপলাইনের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ এবং পরিচালনা করা হবে। স্ক্যাডা, টেলিকমিউনিকেশন এবং লিক ডিটেকশন করতে এই পাইপলাইনের সাথে অপটিক্যাল ফাইবার ক্যাবল লাইন সংযুক্ত রয়েছে।

সূত্র জানিয়েছে, দেশের ৭০ লাখ টন জ্বালানির মধ্যে প্রায় ৩০ লাখ টন ব্যবহৃত হয় ঢাকা ও কুমিল্লা অঞ্চলে। এসব জ্বালানির বেশিরভাগই বেসরকারি অয়েল ট্যাংকারের মাধ্যমে নৌপথে পরিবাহিত হয়। ওখানে কোটি কোটি টাকার তেল চুরিসহ নানা ধরনের অপকর্ম ঘটে। পাইপলাইনে জ্বালানি তেল সরবরাহ শুরু হওয়ায় অন্তত দেড়শটি বেসরকারি অয়েল ট্যাংকারের পরিবাহিত তেল এই পাইপলাইনের মাধ্যমে পরিবাহিত হবে। ৫০ লাখ টন ধারণক্ষমতার পাইপলাইনে এখন ৩০ লাখ টন জ্বালানি তেল সরবরাহ করা হবে।

পাইপলাইনে গত সোমবার সকাল ১১টা থেকে জ্বালানি তেল সরবরাহ করার কথা ছিল। এজন্য পদ্মা অয়েল কোম্পানির ২০১ নম্বর ট্যাংক থেকে ৮৭ লাখ লিটার ডিজেল প্রকল্প পরিচালককে বুঝিয়ে দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু যান্ত্রিক সমস্যার কারণে সোমবার সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত চেষ্টা করেও তেল সরবরাহ করা হয়নি। একটি বাল্ব গোলমাল করায় পাইপলাইন কার্যকর করা সম্ভব হয়নি জানিয়ে সূত্র বলেছে, প্রকল্পের প্রকৌশলীরা নিরন্তর চেষ্টা করে রাতে সংকটের সুরাহা করেন এবং জ্বালানি তেল সরবরাহ শুরু হয়।

সোমবার রাত থেকে শুরু হওয়া কার্যক্রম গতকাল দিনভর চলেছে। প্রাথমিকভাবে এই পাইপলাইনে ৩ কোটি লিটার জ্বালানি তেল দেওয়া হবে। যা ঢাকা পর্যন্ত পৌঁছাতে চারদিন লাগবে। এই ৩ কোটি লিটার জ্বালানি তেল সবসময় পাইপলাইনে থাকবে। এর বাড়তি তেল চট্টগ্রামে পাইপে প্রবেশ করালে তা কুমিল্লা কিংবা গুদনাইলে রিসিভ করা যাবে। আগামী কয়েকদিনের মধ্যে তিনটি বিপণন কোম্পানি পদ্মা অয়েল, মেঘনা পেট্রোলিয়াম এবং যমুনা অয়েল কোম্পানি চাহিদা অনুযায়ী জ্বালানি তেল পাইপলাইনের মাধ্যমে চট্টগ্রাম থেকে কুমিল্লা এবং নারায়ণগঞ্জে পাঠানো শুরু করবে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা জানান। গত রাত ৯টা পর্যন্ত পাইপলাইনে ৪৮ লাখ লিটার জ্বালানি তেল দেওয়া হয়েছে। পদ্মা অয়েল কোম্পানির ২০১ নং ট্যাংক ফুরিয়ে গেলে পরবর্তী ট্যাংক থেকে জ্বালানি তেল সরবরাহ শুরু করা হবে।

সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেছেন, দেশের অভ্যন্তরে পাইপলাইনে জ্বালানি তেল সরবরাহের এই কার্যক্রমের মাধ্যমে বছরে শুধু তেল পরিবহন খাতের আড়াইশ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে। সময় বাঁচবে অনেক, যা পরোক্ষভাবে বিপণন কোম্পানিগুলোর আয়ে ইতিবাচক প্রভাব ফেলবে। একইসাথে সিস্টেম লসের মাধ্যমে কোটি কোটি টাকার জ্বালানি তেল চুরিসহ নানা অপকর্ম ঠেকানো সম্ভব হবে। পাইপলাইনে তেল সরবরাহে সিস্টেম লস একেবারে কমে আসবে বলে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন। পাইপলাইনের সর্বোচ্চ নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে বলে জানান তারা।

পূর্ববর্তী নিবন্ধবাজেট অধিবেশনেও ভাষার প্রশ্নে আলোচনা থেকে দূরে থাকে সরকারপক্ষ
পরবর্তী নিবন্ধচান্দগাঁওয়ে ১৯৬ বোতল ফেন্সিডিল ও প্রাইভেট কারসহ দুইজন আটক