বর্তমান ছাত্র সমাজ একটি অস্থির সময় অতিবাহিত করছে। এই অস্থিরতার মূল কারণ হচ্ছে রাজনৈতিক পরিস্থিতির পটভূমি পরিবর্তন। আমাদের দেশে সরকার আসে ও সরকার যায়। কিন্তু প্রতিটি পরিবর্তনের প্রভাব গিয়ে পড়ে সম্পূর্ণরূপে ছাত্র সমাজের ওপর। ৫ আগস্টের আন্দোলন সংগ্রামের পরবর্তী সময়টিতে বিভিন্ন শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলোতে শিক্ষকদের নানাভাবে নাজেহাল করা হচ্ছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে শিক্ষকদেরকে নাজেহাল করার দৃশ্যটি খুবই লজ্জার। আমরা দেখেছি; কয়েকটি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে কয়েকজন শিক্ষককে ছাত্রছাত্রী দ্বারা অপমান করা হয়েছে। বিশেষ করে স্কুলগুলোতে বিষয়টি আরো বেশি লক্ষ্যণীয়। ছোট ছোট কোমলমতি শিক্ষার্থী দ্বারা তাদের শিক্ষকদের নাজেহালের দৃশ্যটি আসলেই ভাববার বিষয়। একজন শিক্ষক রাজনীতি করতে পারেন। রাজনীতি করা সকলের নাগরিক অধিকার। কিন্তু আমাদের মাঝে কিছু শিক্ষক যারা রাজনীতি করতে গিয়ে শিক্ষা প্রতিষ্ঠান ও ছাত্রছাত্রীদের উপর বিভিন্ন ধরনের প্রভাব বিস্তার করতে থাকে। প্রতিটি শিক্ষক শিক্ষার্থীদেরকে কিছু না কিছু পাঠদান করেছে। বর্তমানে কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে কতিপয় শিক্ষকের প্রতি ছাত্রছাত্রীদের ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ ঘটেছে। কিছু কিছু শিক্ষক নিজেদের স্বার্থে শিক্ষার্থীদের ব্যবহার করেছে।
অভিভাবকদের অনেক ধরনের অভিযোগ থাকে। সন্তানরা নিয়মিত কিছুই সম্পাদন করছেন না। আগে যেমন সন্তানদের প্রতি মা–বাবার একটি শাসন ছিল এখন সেই শাসন প্রয়োগ করতে অভিভাবক ভয় পান। সবকিছুতেই না বলার যেন আজকাল সন্তানদের অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে সেই একই অবস্থা। শিক্ষকরা শিক্ষার্থীদেরকে শাসন করতে কয়েক বার চিন্তা করে। এক সময় শিক্ষক নিয়মিত শাসন করতেন। অভিভাবকবৃন্দ শিক্ষকদের উপর আস্থা রাখতেন। শিক্ষকরা যাই বলতেন তাতে অভিভাবকরা সন্তুষ্ট থাকতেন। এখন কেন জানি অভিভাবক–শিক্ষক–শিক্ষার্থী সকলের মধ্যে একটি বিভেদ চলছে। সময় মত কোনো কিছু না করা যেন তাদের একটা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে। সবকিছুই নিজের মতো করে পেতে চায়। কারো মতামতকে সম্মান ও সহজভাবে গ্রহণ করতে চায় না। বন্ধুবান্ধব নির্বাচনেও তারা অনেক ধরনের ভুল করে বসে। অপসংস্কৃতির কবলে পড়ে শিক্ষার্থীদের মন–মানসিকতায় যেন একটা উড়ো উড়ো ভাব চলে এসেছে। নিজের শিকড়ের প্রতি কোনো ধরনের টান নাই। নিজস্ব সংস্কৃতির প্রতি কেন যেন একটা অনীহা। জাতীয় কোনো প্রোগ্রাম তাদের আকর্ষণ করে না। তাদের পোশাক চালচলন ও অঙ্গভঙ্গিতে অনেক পরিবর্তন এসেছে। এমনকি খাওয়া দাওয়া নির্বাচনেও তারা কেমন যেন উদাস। মায়ের হাতে রান্নার প্রতি তেমন তাদের আগ্রহ থাকে না। দোকান ও রেস্টুরেন্টের খাবারের প্রতি তাদের খুব আগ্রহ। নিজের ভালো–মন্দ বোঝার ক্ষমতাগুলো যেন দিন দিন হারিয়ে যাচ্ছে। মেধাবী শিক্ষার্থীরাও অনেক ধরনের অপরাধমূলক কাজে লিপ্ত হচ্ছে। রাজনৈতিকভাবে তারা ব্যবহৃত হচ্ছে। রাজনীতিবিদরা নিজের স্বার্থে তাদেরকে ব্যবহার করছে। এই মেধাবী শিক্ষার্থীরা তাদের নিজেদের অবস্থান সম্বন্ধে খুবই উদাসীন। ছাত্র সমাজের অস্থিরতার পেছনে নীতি নির্ধারকরা দায়ী। একেক সময় একেক ধরনের সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। নিজেদের প্রয়োজনে অন্যায়ভাবে অনেক সিদ্ধান্ত নেয়।
এই অস্থির ছাত্র সমাজ নতুন কোনো কিছুতেই আগ্রহী নয়। যখন যেটা মন চায় সেটাই করতে চেষ্টা করে। তারা নিজের মতো করে সবকিছু পাওয়ার চেষ্টা করে। তাই অন্যের প্রতি শ্রদ্ধা সম্মান জানানোর বিষয়টাকে তারা তেমন পাত্তা দেয় না। এমনকি বন্ধু–বান্ধবদের মধ্যেও তেমন স্বচ্ছতা দেখা যায় না। সবকিছুই হচ্ছে রঙিন দুনিয়ার মত মনে করে। একজন ভালো বন্ধু তৈরি করা যেমন সৌভাগ্যের বিষয় ঠিক সেভাবে একজন ভালো সমালোচক থাকা উচিৎ। বর্তমান প্রজন্মের সময়জ্ঞানটা অনেকটা বিশৃংখল। তারা সঠিক সময়ে সঠিক কাজ করতে চায় না। আমরা সবাই জানি — সময়ের এক ফোঁড় অসময়ের দশ ফোঁড়ের সমান। তারা রুটিন মাফিক কোনো কিছু করে না। পরীক্ষার আগে উঠেপরে লাগে। রাত দিন পড়তে থাকে। পরীক্ষার হলেও তাদের মধ্যে কোনো ধরনের সুশৃঙ্খলা দেখা যায় না। বিভিন্ন ধরনের ছলচাতুরীর মাধ্যমে একজন আরেক জনের সাহায্য নিয়ে পরীক্ষা দিতে চেষ্টা করে। তাছাড়া পরীক্ষার আগের এক দুই দিন থেকে প্রশ্নপত্র ফাঁসের বিষয়টি নিয়ে ব্যস্ত থাকে। পাঠ্য পুস্তকের সাথে শিক্ষার্থীদের একটা ব্যাপক ব্যবধান থেকে যায়। আধুনিক প্রজন্মের শিক্ষার্থীরা প্রায় সময় বিভিন্ন ধরনের অনুষ্ঠান আয়োজন করে। দল বেঁধে কোথাও ঘুরতে চলে। দল বেঁধে কোথাও খেতে যায়। ফলে অভিভাবকের উপরে অনেক বেশি চাপ পড়ে। টাকা–পয়সার পাশাপাশি নতুন জামা কাপড়ের প্রতিও তারা আসক্ত থাকে। নিজেকে সুন্দর করে উপস্থাপনা করতে গিয়ে অভিভাবকদের সামর্থ্যের বিষয়টিকে চিন্তা করে না। অনেক শিক্ষার্থী অকারণে অর্থ ব্যয় করে। আবার অনেক শিক্ষার্থী বইপত্র না কিনে অন্য কিছুতে ব্যয় করে। পরবর্তীতে তারা অভিভাবকের কাছে হাত পাতে। এতগুলো টাকার যোগান দিতে গিয়ে অভিভাবকদের হিমসিম খেতে হয়।
বর্তমান প্রজন্মের আরেকটা বড় দোষ হচ্ছে তারা রাত জেগে সময় কাটায়। অনেকেই রাত জেগে লেখাপড়া করে কিন্তু এই রাত জেগে লেখাপড়ার ফাঁকে ফাঁকে তারা মোবাইলে বন্ধু বান্ধবীদের সাথে সময় কাটায়। গেম খেলে। মুভি দেখে। নাটক দেখে। অথচ এ রাত জাগার ফলে দিনের যে একটা বরকত আছে ওইটা থেকে বঞ্চিত হয়। এ রাত জাগার ফলে আবার পরিবারের সদস্যদের খুবই ডিস্টার্ব হয়। অভিভাবকবৃন্দ হয়তো মনে করেন তার সন্তান রাত জেগে লেখাপড়া করছে। কিন্ত অভিভাবকদেরকে অন্যায়ভাবে হতাশ করছে। পরীক্ষার আগে এবং পরীক্ষার পরে শিক্ষার্থীদের মধ্যে একটা হতাশা দেখা যায়। আজকালকার ছেলেমেয়েদেরকে প্রায় বলতে শোনা যায় তারা হতাশাগ্রস্ত। তারা বিভিন্ন ধরনের বিষণ্নতায় ভুগছে। ধরনের হতাশা ও বিষণ্নতার তাদের জীবন চলার পথের বাধা হিসেবে চিহ্নিত করে। কিন্তু তারা যদি প্রথম থেকে রুটিন মাফিক লেখাপড়া ও শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে প্রতিনিয়ত ক্লাস করেতো, শিক্ষকদের উপদেশ মনোযোগ সহকারে অনুসরণ করতো তাহলে হয়তো হতাশার সম্মুখীন হতে হতো না। বর্তমান ছাত্র সমাজ আমাদের ঐতিহ্যবাহী পুরনো যে গান নাটক সিনেমা গল্পগুলো আছে সেগুলোর প্রতি কোনো আগ্রহ প্রকাশ করে না। পাঠ্য বইগুলো তারা গভীর মনোযোগ সহকারে পড়ে না। শুধুমাত্র গুরুত্বপূর্ণ একটা প্রশ্ন পড়ে পরীক্ষা দিতে যায়। পাঠ্য বইয়ের গল্প উপন্যাসগুলো প্রথম থেকে শেষ পর্যন্ত পড়ার চেষ্টা করে না। এর ফলে তাদের জ্ঞানের পরিধি দিন দিন সীমাবদ্ধ হতে থাকে। অপসংস্কৃতির প্রভাবে তারা উচ্চস্বৈরে গান শুনতে চায়। উচ্চস্বরে কথা বলে। কোনো কথা শুনলে ধীর স্থিরভাবে চিন্তা ভাবনা করে না। তাৎক্ষণিক উত্তর দিতে থাকে। শিক্ষক এবং ছাত্রের মধ্যে একটা বন্ধুত্বপূর্ণ সম্পর্ক থাকে। শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার মাঝে শাসন মেনে নিতে চায় না। শিক্ষক কোন কিছু বললেই শিক্ষার্থী অনেক অপ্রাসঙ্গিক কথা বলে। অনেক শিক্ষক অপ্রস্তুত হয়ে যায়। পিতা–মাতার আদেশ উপদেশগুলো গুরুত্ব সহকারে অনুসরণ অনুকরণ করে না। পরিবারের অন্যান্য মুরুব্বিদের তেমন শ্রদ্ধা করে না। পাড়া–প্রতিবেশী ও মুরুব্বীদের এড়িয়ে চলতে চায়। হঠাৎ সামনাসামনি চোখে চোখ পড়লে সালাম দেয়। কিন্তু অধিকাংশ না দেখার ভান করে অন্য দিকে চলে যায়। বিষয়গুলো খুবই দৃষ্টিকটু। শ্রদ্ধা ভালোবাসা ও সম্মানের বিষয়গুলোকে প্রায় হাসি দিয়ে উড়িয়ে দিতে চায়। এই অস্থিরতার পেছনে আমাদের সমাজ ব্যবস্থায় দায়ী। দিনের পর দিন তারা অসংস্কৃতির প্রভাবে আধুনিকতার নামে নিজের শিকড় থেকে অনেক দূরে সরে গেছে। এই প্রজন্ম সবকিছুকেই হালকা করে দেখে। পারিবারিক সামাজিক ও রাষ্ট্রীয় যে অস্থিরতা বিরাজ করছে তাতে আমাদের বর্তমান ছাত্রসমাজ দিন দিন আরো বেশি অস্থির হয়ে উঠছে। বৈষিক উষ্ণতা ও পরিবেশের ভারসাম্যহীনতার ফলে শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত হচ্ছে। পরিবার সমাজ ও শাসন ব্যবস্থায় যদি একটা সুন্দর সুশৃঙ্খল বিন্যাস থাকে তাহলে সামগ্রিকভাবে এই অস্থিরতা কমতে পারে। নিজেদের দায়বদ্ধতা যদি নিজেরাই স্বীকার করে নিতে পারি তখনই একটা সুশৃংখল পরিবেশ সৃষ্টি হবে।
লেখক: কলামিস্ট ও অধ্যাপক, ইংরেজি বিভাগ, ডা. ফজলুল–হাজেরা ডিগ্রী কলেজ, হালিশহর, চট্টগ্রাম।