সব আয়োজন সম্পন্ন হলেও যান্ত্রিক সমস্যার কারণে গতকাল শুরু করা যায়নি চট্টগ্রাম থেকে ঢাকা অঞ্চলে পাইপ লাইনে জ্বালানি তেল সরবরাহের বহুল প্রত্যাশিত কার্যক্রম। তবে আজকের মধ্যে যান্ত্রিক ত্রুটি সারিয়ে জ্বালানি তেল সরবরাহ শুরু করার চেষ্টা চালানো হচ্ছে। বহু কাঠখড় পোড়ানো এবং নানা প্রতিকূলতা মোকাবেলার পর বাস্তবায়িত প্রকল্পটির মাধ্যমে চট্টগ্রাম থেকে আড়াইশ’ কিলোমিটার পাইপ লাইনে বছরে ৫০ লাখ টন জ্বালানি তেল সরবরাহের সক্ষমতা নিয়ে নির্মিত এই পাইপ লাইন কার্যকর হলে দেশের জ্বালানি তেল চুরি, অপচয় রোধের পাশাপাশি বছরে অন্তত আড়াইশ’ কোটি টাকা সাশ্রয়সহ জ্বালানি নিরাপত্তা সুরক্ষিত হবে। প্রকল্পটির আওতায় দেশে প্রথম সর্বাধুনিক অটোমেটেড ডিপো পরিচালিত হবে।
সূত্র জানিয়েছে, বছরে ৫০ লাখ টন জ্বালানি তেল সরবরাহের সক্ষমতাসহ জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণ, জ্বালানি পরিবহনের সিস্টেম লস কমানো, নৌপথে তেল পরিবহনের বিপুল খরচ সাশ্রয়সহ দ্রুততম সময়ে তেল পৌঁছানোর লক্ষ্যে চট্টগ্রাম থেকে নারায়নগঞ্জ এবং ঢাকার ফতুল্লা পর্যন্ত আড়াইশ’ কিলোমিটার পাইপ লাইন নির্মাণ কাজ সম্পন্ন হয়েছে। ‘চট্টগ্রাম হতে ঢাকা পর্যন্ত পাইপলাইনে জ্বালানি তেল পরিবহন’ শীর্ষক প্রকল্পটি ২০১৬ সালের অক্টোবরে একনেকের অনুমোদন লাভ করে। কথা ছিল ২০২০ সালের ৩০ জুন প্রকল্পের কাজ শেষ হবে। কিন্ত নানামুখী প্রতিবন্ধকতা এবং প্রতিকূলতার মাঝে পড়তে হয় গুরুত্বপূর্ণ এই প্রকল্পটিকে। পরবর্তীতে সরকার বাংলাদেশ সেনাবাহিনীর মাধ্যমে প্রকল্পটি বাস্তবায়নের উদ্যোগ নেয়। এর ফলে পদ্মা অয়েল কোম্পানির তত্ত্বাবধানে বাংলাদেশ সেনাবাহিনী প্রকল্পটির কাজ সম্পন্ন করছে।
প্রকল্পের আওতায় চট্টগ্রাম থেকে নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল পর্যন্ত ৭টি স্টেশনসহ ২৪১.২৮ কিলোমিটার ১৬ ইঞ্চি ব্যাসের ভূগর্ভস্থ পাইপলাইন নির্মাণ, গোদনাইল থেকে ফতুল্লা পর্যন্ত দুটি স্টেশনসহ ৮.২৯ কিলোমিটার ১০ ইঞ্চি ব্যাসের পাইপলাইন নির্মাণ করা হয়েছে। এরমধ্যে বিভিন্ন নদীর তলদেশ দিয়ে অন্তত ৯ কিলোমিটার পাইপ লাইন স্থাপন করা হয়েছে। প্রকল্পটির আওতায় কুমিল্লার বরুড়ায় সর্বাধুনিক প্রযুক্তি সমৃদ্ধ একটি অটোমেটেড ডিপো স্থাপন করা হয়েছে। যে ডিপোতে জ্বালানি তেল গ্রহণ এবং সরবরাহ সবকিছু নিয়ন্ত্রিত হবে সর্বাধুনিক প্রযুক্তিতে। এই ডিপোতে ম্যানুয়েলি কোন কাজ করা হবে না। জ্বালানি তেলের ওজন, তাপমাত্রা, সরবরাহ সবই পরিচালিত হবে কম্পিউটারাইজড প্রযুক্তিতে। এই ডিপো থেকে চাঁদপুরসহ সন্নিহিত অঞ্চলে জ্বালানি তেল সরবরাহ করা হবে।
চট্টগ্রামের ডেসপ্যাচ টার্মিনালের স্ক্যাডা মাস্টার কন্ট্রোল স্টেশন থেকেই ২৫০ কিলোমিটার দীর্ঘ পাইপলাইনের কার্যক্রম নিয়ন্ত্রণ এবং পরিচালনা করা হবে। স্ক্যাডা, টেলিকমিউনিকেশন এবং লিক ডিটেকশন করতে এই পাইপ লাইনের সাথে অপটিক্যাল ফাইবার ক্যাবল লাইন সংযুক্ত রয়েছে।
সূত্র জানায়, পাইপ লাইনে জ্বালানি তেল সরবরাহের অপারেশন্স সম্পন্ন করার জন্য ইতোমধ্যে পদ্মা অয়েল কোম্পানি থেকে তিন কোটি লিটার ডিজেল কেনা হয়েছে। প্রতি লিটার ১০০ টাকা ২৫ পয়সা করে সর্বমোট ৩শ’ কোটি ৭৫ লাখ টাকা পদ্মা অয়েল কোম্পানিকে প্রকল্প থেকে পরিশোধ করা হয়েছে। এই ৩ কোটি লিটার ডিজেল দিয়ে পাইপ লাইন এবং ডিপোর কার্যক্রম সম্পন্ন করে পাইপ লাইনটি বিপিসিকে বুঝিয়ে দেয়ার কথা। বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, উক্ত তিন কোটি লিটার তেল পাইপ লাইনেই থেকে যাবে। পরবর্তীতে যে কোম্পানির যা প্রয়োজন তা পাইপ লাইনে দিয়ে ডিপোগুলো থেকে গ্রহণ করবে। অর্থাৎ নতুন তেল পাইপ লাইনে গেলে আগের তেল ডিপোতে যাবে। ১৬ ইঞ্চি ব্যাসের আড়াইশ’ কিলোমিটার পাইপ লাইনে সবসময়ই তিন কোটি লিটার ডিজেল জমা থাকবে। কুমিল্লার বরুড়ার সর্বাধুনিক ডিপো থেকে পদ্মা অয়েল কোম্পানি, মেঘনা পেট্রোলিয়াম এবং যমুনা অয়েল কোম্পানিকে জ্বালানি তেল সরবরাহ দেয়া হবে। এখানে পৃথক পৃথক ডেলিভারি পয়েন্টের মাধ্যমে তিন বিপণন কোম্পানির হিসেব পরিচালিত হওয়ার কথা।
বাংলাদেশ সেনাবাহিনী এবং পদ্মা অয়েল কোম্পানির তত্ত্ববধানে প্রায় আড়াই হাজার কোটি টাকা ব্যয়ে বাস্তবায়িত প্রকল্পটির নির্মাণকাজ পুরোপুরি সম্পন্ন হয়েছে। গতকাল প্রকল্পটির কমিশনিংয়ের সিডিউল ছিল। কথা ছিল গতকাল সকাল ১১টার সময় পদ্মা অয়েল কোম্পানির ২০১ নম্বর ট্যাংক থেকে ৮৭ লাখ লিটার ডিজেল পাইপ লাইনে সরবরাহ দেয়ার মাধ্যমে পাইপ লাইনে প্রথমবারের মতো জ্বালানি তেল সরবরাহ দেয়া হবে। পরবর্তীতে অন্যান্য ট্যাংক থেকে প্রকল্পের জন্য কেনা ৩ কোটি লিটার জ্বালানি তেল যোগান দেয়া হবে। সব আয়োজনই গোছানো ছিল। পদ্মা অয়েল কোম্পানি পুরো ট্যাংকটি প্রকল্প পরিচালককে বুঝিয়ে দেন। সংশ্লিষ্ট লোকবলও কাজে যোগ দেন। কিন্তু সকাল ১১টা থেকে পুরোদিন নানাভাবে চেষ্টা করেও পাইপ লাইনে তেল গ্রহণ করতে পারেনি। জ্বালানি তেল রিসিভিং পয়েন্টের পাইপ লাইনের বাল্বে সমস্যা দেখা দেয়ায় তেল নেয়া সম্ভব হয়নি।
সূত্র বলেছে, প্রকল্প সংশ্লিষ্ট প্রকৌশলীরা নানাভাবে চেষ্টা করছেন। তারা সারাদিনই কাজ করেছেন। কাজ চলছে রাতেও। তবে আজ এই তেল প্রবাহ শুরু হতে পারে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করা হয়েছে।
সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা বলেন, পাইপ লাইনে জ্বালানি তেল সরবরাহ আজ শুরু হতে পারে। প্রথম ধাপে একটি ট্যাংক থেকে ৮৭ লিটার তেল দেয়া হলেও ক্রমান্বয়ে পাইপে তিন কোটি লিটার তেল সরবরাহ দেয়া হবে। কমিশনিংয়ের পর বিপণন কোম্পানিগুলো নিজেদের চাহিদা অনুযায়ী তেলের যোগান দিয়ে তা কুমিল্লা কিংবা নারায়নগঞ্জে গ্রহণ করে সরবরাহ করবে।
উল্লেখ্য, দেশে বর্তমানে বছরে গড়ে ৭০ লাখ টন জ্বালানি তেলের চাহিদা রয়েছে। এর মধ্যে প্রায় ৩০ লাখ টন জ্বালানি ব্যবহৃত হয় ঢাকা বিভাগে। এই তেলের প্রায় পুরোটাই পতেঙ্গার গুপ্তাখালস্থ প্রধান ডিপো থেকে নৌপথে নারায়ণগঞ্জের গোদনাইল, ফতুল্লা ও চাঁদপুর ডিপোতে নেওয়া হয়। এরপর সেখান থেকে সড়কপথে পরিবহন করা হয়। রেলওয়ে ওয়াগনের মাধ্যমেও দেশে কিছু জ্বালানি তেল পরিবাহিত হয়।
দেশের জ্বালানি তেলের ৯০ শতাংশ পরিবাহিত হয় নৌপথে। তেল বিপণন কোম্পানিগুলোর নিয়ন্ত্রণে থাকা প্রায় ২০০টি বেসরকারি অয়েল ট্যাঙ্কার এসব জ্বালানি তেল পরিবহন করে। নৌপথে জ্বালানি তেল পরিবহনে বিপুল পরিমান চুরিসহ বড় ধরণের সিস্টেম লসের ঘটনা ঘটে। এছাড়া শুষ্ক মৌসুমে নাব্যতা কমে যাওয়ায় জ্বালানি তেল পরিবহনে সংকট তৈরি হয়। পাইপ লাইনে জ্বালানি তেল সরবরাহ শুরু হলে এসব সংকট কেটে যাবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করে সূত্র বলেছে যে, এতে বছরে অন্তত আড়াইশ’ কোটি টাকা সাশ্রয় হবে।