যারা বিশ্ব পরিবর্তনের কথা বলে তাদের সর্বপ্রথম নিজেকে পরিবর্তন করা উচিত বলে মন্তব্য করেছেন স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম সংবাদপত্র দৈনিক আজাদী সম্পাদক এম এ মালেক। তিনি বলেন, আমরা বিশ্ব পরিবর্তনের কথা বলি, কিন্তু নিজেকে পরিবর্তন করতে চাই না। সকলে চায় অন্যরা পরিবর্তন হোক, নিজে পরিবর্তন হতে চায় না। আসলে পরিবর্তনটা নিজেকে দিয়ে শুরু করতে হবে। যদি নিজেকে দিয়ে শুরু না করি তাহলে আরেকজনকে পরিবর্তন হতে বলবো কি করে। নিজেকে পরিবর্তন না করে অন্যকে পরিবর্তন করলে সেই পরিবর্তনে কোনো কাজ হবে না। সুতরাং প্রথমে নিজেকে পরিবর্তন করতে হবে। এরপর যদি নিজের পরিবারকে সুস্থ–সুন্দরভাবে গড়ে তুলতে পারি তাহলে পাড়া–পড়শি যারা আছে তাদের বলতে পারবো। পাড়া–পড়শি থেকে সেটা ক্রমান্বয়ে শহরে এবং এক পর্যায়ে পুরো বাংলাদেশে তা ছড়িয়ে পড়বে।
তিনি গতকাল সোমবার রাতে নগরের ইঞ্জিনিয়ার্স ইনস্টিটিউটে কুমিল্লা জেলা সমিতি–চট্টগ্রামের অভিষেক অনুষ্ঠান ও মেজবানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এসব কথা বলেন। কুমিল্লা জেলা সমিতি চট্টগ্রামের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা গোলাম মহিউদ্দিন বাবুলের সভাপতিত্বে বিশেষ অতিথি ছিলেন কর কমিশনার (আপীল) শামিনা ইসলাম, চবি অধ্যাপক ড. এ কে এম রেজাউর রহমান, অধ্যাপক আবদুল আলীম, অধ্যাপক মোশাররফ হোসেন, চট্টগ্রামের অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ ড. মোশাররফ হোসেন, চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের শিশু স্বাস্থ্য বিভাগের সহকারী অধ্যাপক ডা. বেলায়েত হোসেন ঢালী। তিন পর্বের অনুষ্ঠানের প্রথম পর্বে সভাপতিত্ব করেন সমিতির উপদেষ্টা মোহাম্মদ কবির উদ্দিন ভূঁইয়া। সঞ্চালনা করেন সমিতির সাধারণ সম্পাদক কাজী জহিরুল ইসলাম।
একুশে পদকপ্রাপ্ত ব্যক্তিত্ব এম এ মালেক বলেন, মানুষ এই পৃথিবীতে আসবে–যাবে। কিন্তু পৃথিবী থাকবে। আমরা কেউ থাকব না। এটাই ভবিতব্য। এই পৃথিবীতে আমাদের পদচিহ্ন যদি একটু গাঢ় করে রেখে যেতে পারি তাহলে লোকজন বলবে, এই লোকটা খুব ভাল ছিল। আমাদের সেই চেষ্টা করা উচিত। এম এ মালেক বলেন, কুমিল্লাবাসী চট্টগ্রামে এসে চট্টগ্রামকে সমৃদ্ধ করেছেন। কারণ একজনকে নিয়ে বা শুধু চট্টগ্রামবাসীকে নিয়ে চট্টগ্রাম হয় না। চট্টগ্রামে অবস্থানরত কুমিল্লা জেলার জনগণ তাদের নিজ নিজ কর্মক্ষেত্রে এবং ব্যবসা বাণিজ্যে অবদান রাখছে পাশাপাশি কুমিল্লাবাসীদের মধ্যে যোগাযোগের মাধ্যম হিসেবে কুমিল্লা জেলা সমিতি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করছে। তিনি ‘মানুষ মানুষের জন্যে, জীবন জীবনের জন্যে, একটু সহানুভূতি মানুষ কি পেতে পারে না?’ উদ্ধৃতি করে বলেন, আসলে সহানুভূতি না। আল্লাহ আমাদের এই পৃথিবীতে পাঠিয়েছেন তার শোকরিয়া আদায় করার জন্য আমাদের চেয়ে যারা কম সৌভাগ্যবান তাদের দিতে হাতটা প্রসারিত করা আমাদের কর্তব্য। কুমিল্লা জেলা সমিতি দরিদ্র ও মেধাবী শিক্ষার্থীদের সাহায্য ও আর্তমানবতার সেবায় বিভিন্ন কর্মকাণ্ড পরিচালনা করছে যা অত্যন্ত প্রশংসনীয়।
এম এ মালেক বলেন, সকলে মিলে মিশে কাজ করলে অনেক কিছুই করতে পারি। আমরা অনেক সময় বলি ‘ইম্পসিবল’ (অসম্ভব)। বর্তমান বিশ্বে ইম্পসিবল বলে কোনো শব্দ নাই। সবকিছুই ‘পসিবল’ (সম্ভব)। যদি সেটাকে আমরা ঠিকভাবে চিন্তা করতে পারি, সল্ভ করতে পারি। ইম্পসিবল শব্দকে যদি ভাগ করে পড়ি তাহলে হবে ‘আই অ্যাম পসিবল’।
তিনি বলেন, আজ আমরা ভাষার মাসে দাঁড়িয়ে আছি। বাঙালি একমাত্র জাতি যাদের নিজের মাতৃভাষার জন্য বুকের রক্ত দিতে হয়েছে। বুকের রক্ত দিয়ে আমরা আমাদের মাতৃভাষাকে অর্জন করেছি। এটা কিন্তু আমাদের জন্য অনেক বড় গৌরবের। যারা বুকের রক্ত দিয়ে আমাদের ভাষাকে রক্ষা করেছে তাদের প্রতি কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করছি, আল্লাহ তাদের বেহেশত নসীব করুক।
এম এ মালেক বলেন, একুশ আমার অহংকার, একুশ মানে মাথা নত না করা। একুশ আমাকে শিখিয়েছে মাথা নত না করার। সে সাহসটা আমি পেয়েছি আমার বাবার কাছ থেকে। ১৯৫২ সালে মাহবুব উল আলম চৌধুরীর রচিত ভাষা আন্দোলনের প্রথম কবিতা ‘কাঁদতে আসিনি, ফাঁসির দাবি নিয়ে এসেছি’ ছাপিয়ে দিয়েছিলেন। বাব জানতেন ওই সময়ে এ কবিতা ছাপানো মানে রাষ্ট্রদ্রোহিতার অপরাধ। কিন্তু মাতৃভাষা নিয়ে বাবা কোনো সমাঝোতা করেন নি, মাথা নত করেন নি। বাবা জানতেন মাতৃভাষাকে রক্ষা করতে হবে। তাই কবিতাটি ছাপিয়েছেন। মানে বাবা মাথা নত করেন নি। অবশ্য এ কবিতাটি ছাপানোর কারণে আমাদের ম্যানেজার দবির উদ্দিন চৌধুরীকে আটক করা হয় এবং তার জেল হয়। ছয় মাস জেল কাটার পর যুক্তফ্রন্ট ক্ষমতায় এলে মুক্ত হন তিনি।
তিনি বলেন, বাবা আমাকে একটা কাগজ (দৈনিক আজাদী) দিয়ে গেছেন। তখন আমার বয়স ২৪ বছর। আমার স্বপ্ন ছিল সেই কাগজ বাঁচিয়ে রাখার, চালিয়ে যাওয়ার। আমার সেই স্বপ্ন আমি ছুঁয়ে ফেলেছি। এসময় তিনি বলেন, স্বপ্ন দেখার পর সেটা বাস্তবায়িত হলে আমরা আরেকটা স্বপ্ন দেখি, সেরকম যেন না হয়। যে স্বপ্ন দেখবেন সেটা বাস্তবায়িত হলে সেটা নিয়েই সুখে থাকবেন। সুখে থাকারও একটা সংজ্ঞা আছে। আপনার সাধ্যের মধ্যে যদি আপনার চাওয়াটা ধরে রাখতে পারেন তাহলে অসুখী হওয়ার কোনো কারণ নেই। আজাদী সম্পাদক এ পি জে আবদুল কালাম এর ‘স্বপ্ন সেটা নয় যেটা তুমি ঘুমিয়ে ঘুমিয়ে দেখো। স্বপ্ন হলো সেটাই যা পূরণের অদম্য ইচ্ছা তোমায় ঘুমোতে দেবে না’ উদ্ধৃতি দিয়ে বলেন, আমরা কোথায় গিয়ে পৌঁছুব, কোথায় যেতে হবে সেই স্বপ্ন দেখতে হবে। জীবনকে কীভাবে সাজাব তার স্বপ্ন দেখতে হবে এবং সেটা ঘুমের মধ্যে না দেখে দিনের মধ্যে দেখতে হবে। অর্থাৎ এটা হবে দিবাস্বপ্ন। তবেই সে স্বপ্ন পূরণ হবে।
আজাদী সম্পাদক ফুলের পরিবর্তে বই উপহার দেয়ার আহ্বান জানিয়ে বলেন, ফুল শুভ্রতার প্রতীক। ফুল ভালোবাসার প্রতীক। ফুল খুব সুন্দর জিনিস। ফুল জীবনের প্রতীক। সৌন্দর্যের প্রতীক। নির্মলতার প্রতীক। কিন্তু বইয়ের গুরুত্ব অনেক। তাই ফুলের পরিবর্তে বই দেয়া হোক। বই দিলে সেটা আমাদের সঙ্গে থাকবে। আপনাদের নামটা সেই বই বহন করবে।
সামিনা ইসলাম বলেন, অনেক মেধাবী ও গুণীজন কুমিল্লা জেলাকে সমৃদ্ধ করেছে।
গোলাম মহিউদ্দিন বাবুল বলেন, চট্টগ্রামে বসবাসরত কুমিল্লা জেলার ১৭টি উপজেলার মানুষের মাঝে সমপ্রীতি, সৌহার্দ্য এবং ঐক্যের একটি স্রোত ইতোমধ্যে প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। সেই ধারাকে আরও উন্নত এবং সমৃদ্ধ করতে কাজ করবে কুমিল্লা সমিতি। অনুষ্ঠানে বক্তব্য দেন, সমিতির সাংগঠনিক সম্পাদক সাইফুল ইসলাম মজুমদার, সাংবাদিক ফারুক ইকবাল, সমিতির সহ–সভাপতি মো. শাহ আলম।