গৈ+অন=গান। যে কবিতা, যে গীতিকবিতা, যে গাথা কবিতা, যে সুরেলা ধ্বনি, যে সুমধুর ধ্বনি, যে গীত, যে গীতধর্মী মন্ময় কবিতা বা আত্মনিষ্ঠ কবিতা বা যে গীতবাক্য বা যে কণ্ঠগীত, গীত হবার যোগ্য তাই গান। গান আর সংগীত এক নয়। আবার যে কোন গানই সংগীত নয়। আবার যে গান সুর তাল লয়ের সাথে সম্যক বা বিশুদ্ধ ভাবে গাওয়া হয় সে গানই সংগীত। সংগীত সুকুমার শিল্প বা চৌষট্টি কলার শ্রেষ্ঠ কলা বা বিদ্যা। গান, বাদ্যযন্ত্র ও নৃত্যের সংমিশ্রণে সংগীতের সৃষ্টি। তবে গান হল উক্ত তিন বিষয়ের মধ্যে প্রধান শিল্প। আমরা গভীর নিরীক্ষায় লক্ষ করি শিল্প আমাদের দু‘ধরনের আনন্দ যোগায়। এক: জীবনের ক্লেশতাপ অপনোদন করে অসাড় স্নায়ুগুলোর জন্য একটা সুখাশ্রয় রচনা করে। দ্বিতীয়টা: স্নায়ুর ভেতর দিয়ে মানুষের মনকে এক জাগরণের দিকে উসকে দেয়, বাস্তব জগত আর মানুষের জীবন ও ভাবনার একটা অজ্ঞাত ও রহস্যময় দিক কে উদ্ঘাটিত করে। গান হল শিল্পের সেই শাখা যা শ্রেষ্ঠ শব্দ ও ছন্দের সাহায্যে সংগঠিত এক মহাশিল্প। কেননা গান মূলগতভাবেই মানুষের আবেগজাত ক্রিয়াকলাপ, মানুষের আবেগরাশিকে বহিরাশ্রয় দেয়ার একটা পন্থা। এখানে থাকে সৌন্দর্যের অনুভূতি। এই অনুভূতি হল আনন্দ, আনন্দের সংগে থাকে জ্ঞান, মানুষে মানুষে এক সাধারণ বন্ধনের স্বীকৃতি, আছে মানবিক রূপকল্প, বিশেষত্বসূচক মানবিক ক্রিয়া আর অনুবন্ধ। এই সকল মানবিক রূপকল্পের উপস্থিতিই আবেগের জন্ম দিতে গানকে সহায়তা করে। গান আবার বিনোদনকে আত্মসাত করে। গান ভাবনারও পরিবাহক। আর ভাবনা হল বস্তু ও মানবিক সম্পর্কের উপলব্ধি, অগণ্য মানবিক কৃতি ও আবিষ্কৃতির সামান্যায়ন, প্রকৃতি সমাজ ও মানুষের গভীর গতীয় সূত্রাবলীর প্রতি অন্তর্দৃষ্টি। ভাবনা ও অনুভূতি মানুষের বাস্তব জীবনকে পরিবর্তিত করে, পালটে দেয় তার আবেগবান জীবনও।
আবার যেহেতু একজন কবি, গীতিকার বা গীতিকবি, গান, গীতিকবিতা প্রভৃতি শিল্প–সাহিত্যেরই অংশ তাই গানে রোমান্টিসিজম থাকবেই। সে জন্য Watts Dunton এর মতে রোমান্টিসিজম হল ভাব কল্পনার বিশেষত্ব, বিস্ময় রসের পুনজীবন যা সুন্দরের সাথে অদ্ভুতের পরিণয় ঘটায়, Victor Hugo একে সাহিত্যে উদার– প্রাণতা, Brunetiere একে সাহিত্য আত্মমুক্তি, আবার কেউ কেউ একে প্রকৃতির রূপমাধুর্য আস্বাদন বলেছেন। একজন সমালোচক বলেন ‘One poet is Romantic because he falls in love: another Romantic because he sees a ghost: another Romantic because he hears a cuckoo: another Romantic because he is reconciled to the church.
এমতাবস্থায় আবার Herford এর ‘An extraordinary’ development of imaginative sensibility’ কে সর্বাপেক্ষা উপযোগী সংজ্ঞা বলে গ্রহণ করতে পারি।
তার মতে, কল্পনাপ্রবণতার অসাধারণ বিকাশই রোমান্টিসিজম বা রোমান্টিকতার লক্ষণ। কল্পনা–প্রবণতা, বিস্ময়, মুগ্ধতা, উপলব্ধি, সৌন্দর্য অবলোকন, উপভোগ, পূর্ণ সন্তুষ্টি ছাড়া একজন কবি কখনো আত্ম মুক্তির প্রয়োজন অনুবভ করে না বা বিশ্বের যাবতীয় বস্তুসত্তাকে উদার অনুভূতি দ্বারা গ্রহণ করতে পারে না। এ কারণেই একজন কবি, গীতিকার, গীতিকবি বর্তমানের বন্ধন মুক্ত হয়ে কখনো অতীতের স্মৃতি গুঞ্জরণে মুগ্ধ হতে পারেন না বা প্রকৃতির রূপ আস্বাদন করতে পারেন না। কবির আত্মমুক্তি কখনো বা দুর্নীবার কামনায়, অশান্ত আর্তনাদে, কখনো বা বেদনাবিধুর নৈরাশ্যের সুরে বা সর্বজয়ী হৃদয়াবেগ প্রতিষ্ঠা কল্পনায় রোমান্টিক সাহিত্যে রূপ লাভ করে।
উপরে বর্ণিত বিষয়াবলীর আলোকে আমরা দেখি কবি, গীতিকার খুরশীদ আনোয়ারের সামপ্রতিক প্রকাশিত সংগীত গ্রন্থ ‘গানের সিন্দুক’ এ সকল উপাদানের বাস্তব, নান্দনিক ও অসাধারণ উপস্থিতি।
সুপ্রাচীন কাল থেকে রাজারাজারা, বণিকগণ, ব্যবসায়ী, স্বর্ণকার, মণিকাররা তাদের মহামূল্যবান ধনরত্ন, অর্থ কড়ি, মণিমাণিক্য, মহামূল্যবান দুষ্প্রাপ্য দলিলদস্তাবেজ নিরাপদ ও সুরক্ষিত করার কাজে ব্যবহৃত করত সিন্দুক অতি যতনে।
তেমনি কবি, গীতিকার খুরশীদ আনোয়ার মহামূল্যবান ধনরত্ন সম কবিতাবলী তার প্রকাশিত বই ‘গানের সিন্দুক’ এ সন্নিবেশন পূর্বক সংরক্ষণ করে আমাদের সামনে উপস্থাপন করেছেন।
কঠিন জীবনবোধ, ভালোবাসা, প্রেম, ভাবাবেগ, অনুভূতি, আবেগ, আশা, হতাশা, বিরহ, দুঃখ বেদনা, বিচ্ছেদ, অনুরাগ, মানবতা, বিষন্নতা, নস্টালজিয়া, রাধা শ্যামের কালজয়ী প্রণয়লীলার কথা ইত্যাদি উঠে এসেছে বিবিধ কবিতার চরণে চরণে গভীর আন্তরিকতা ও সযত্নে, লিখেছেন অমলিন রোমান্টিকতায়। যেমন তাঁর নবম পৃষ্ঠার প্রথম গানে গভীর আবেগে লিখেছেন,
‘চলে যদি যাও বলবো না কিছু
পাছে ব্যথা তুমি পাবে
প্রদীপ নিভাব নিজের হাতে
যখন তুমি চলে যাবে’।
বা দশম পৃষ্ঠায় দ্বিতীয় গানে চমৎকার ও নান্দনিকতায় উপস্থাপন করেছেন এমনিভাবে,
‘তোমার চোখের ভাষার বিষয়
না কবিতা, না চারুকলা
আমাকে এড়িয়ে কেবলি তুমি
বাড়াও নিজের জ্বালা’ ।
অথবা
তৃতীয় গানের চরণে চরণে ব্যক্ত হয়েছে হৃদয়ের প্রেমময় অভিব্যক্তি, প্রেমের আবেগ,
‘তোমার জীবনে ফুটুক কিম্বা
নাইবা ফুটুক ফুল
তুমি চির চেনা অরূপ বসন্ত
চিনতে করিনি ভুল’।
আবার চরম হতাশার প্রকাশ এ গানে পৃষ্ঠা ১২,
‘তোমার ভালবাসা তো সোনার হরিণ
কোনদিন সে ধরা দেবে না
সূর্যমুখী সূর্যের দিকে শুধুই চেয়ে থাকে
কখনও সে কাছে যেতে পারে না‘।।
বা
পঞ্চম গানে, পৃষ্ঠা ১৩ তে লিখেছেন,
‘তোমার রূপের তুমিই প্রতীক নিজে
রজনীগন্ধা শেফালীর রং না মেখে’ ।
বা পৃষ্ঠা ১৪ তে আধ্যাত্মিকতার ছোঁয়ায় লিখেছেন,
‘তোমার সমুদ্রে এত জল থাকতে
বিধি আমাকে কাঁদালে
দু‘ফোটা চোখের জলে সাজানো
বাগান ভেঙে দিলে’।
বা
২০ পৃষ্ঠায়, ভালোবাসার অমিয় প্রকাশ ঘটিয়েছেন এভাবে,
‘তোমাকে আমি অনেক দিয়েছি কষ্ট
আমি কি কম পেয়েছি দুঃখ বল
এত ভালোবাসা দুহাতে দিয়েছ
এখন আঁখি যে ছলছল।’
বা
অভিমান বিরহ ব্যক্ত করেছেন এ গানে এভাবে,
‘তুমি যখন চলে যাবে
অনেক কথা পড়বে মনে
না বলা সব কথা আমার
রইবে মনের গহনে‘।
বা
বেদনার ব্যক্ত কথন এভাবে করেছেন,
‘তুমি কি কথার কথাই বলেছিলে ‘ভালোবাসি ‘
আমি যে তারে বুকে বেঁধে কাঁদি হাসি‘।
এরূপ অসাধারণ, অতুলনীয়, অপূর্ব সুন্দর আটচল্লিশটি গান মহামাণিক্যরূপে বন্দী করেছেন গীতিকার কবি লেখক খুরশীদ আনোয়ার তাঁর প্রকাশিত গানের সংকলন‘গানের সিন্দুক‘ এ।
এত সফল একটি বইয়ের কোথাও কোথাও দৃষ্ট হয় শ্রেষ্ঠ শব্দের বুননে কিছু কিছু অসতর্কতা, ক্ষেত্রে ক্ষেত্রে ছন্দের পতন, বিস্তৃতভাবে স্থানে স্থানে অন্ত্যমিলের ব্যত্যয়, কখনো পদ নির্মাণে দুর্বলতা বা অসাবধানতা, কখনো কবিতার শরীর বা কাঠামো বা নির্মাণ শৈলীর ক্ষীণ ঘাটতি ইত্যাদি। দৃষ্টি নন্দন প্রচ্ছদ করেছেন উত্তম সেন। প্রকাশকাল শ্রাবণ ১৪১৩, অক্টোবর ২০২৪, মুদ্রণে চেম্বার প্রেস, মোমিন রোড চট্টগ্রাম, প্রকাশক : চন্দ্রবিন্দু। মূল্য রাখা হয়েছে ২০০ টাকা ।
লেখক : সংগীতশিল্পী, প্রাবন্ধিক