দূরের দুরবিনে

গতিময় ইতিহাসের দেশ

অজয় দাশগুপ্ত | রবিবার , ৯ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ at ৮:২৪ পূর্বাহ্ণ

তারুণ্য ঝলমল এই বাংলাদেশ এখন এক নতুন পথের সন্ধানে। সে পথ ও মত কী বা কতটা তার প্রমাণ মিলবে সময়ে। আপাতত আমরা এটা দেখছি বাংলাদেশ ও তার ইতিহাস আর যাই মানুক একক কোনো কিছু মানে না। এককের নামে যে কোনো দানবই আমাদের দেশে পরাজিত হয়েছে। কারণ এই মাটি আর জাতির চারিত্রে একক দৈত্য বা দানবের জায়গা নাই। অতিকায় কিছু নয় সাধারণ মানুষের মনের কথা বুঝলেই বাংলাদেশকে জানা সম্ভব। বাংলাদেশ সবসময় একটি মায়াময় সমাজের দেশ। বাইরে থেকে যত ইন্ধন আর উসকানি থাক না কেন মানুষ ভুল করে না। এই মানুষ বা জাতির স্বপ্ন আর আশা বাস্তবায়ন করা গেলেই ঝলমল করে উঠবে বাংলাদেশ। একটা কথা বলা দরকার. বাংলাদেশ স্বাধীন ও আশাপ্রিয় জাতির দেশ। তার স্বপ্ন আর ভবিষ্যৎ সে দিক থেকে অসীম।

কেমন বাংলাদেশ চেয়েছিলাম আমরা? সে কথা বলার আগে বলি আমরা বলতে এখানে মুক্তিযুদ্ধ ও স্বাধীনতা দেখা প্রজন্মের কথা বলছি। আমাদের বালক বেলার শেষে বাংলাদেশ স্বাধীনতা লাভ করে। পুরা তারুণ্য আর যৌবন জুড়ে আমরা যে দেশ দেখেছি তার গায়ে অভাব আর অস্বচ্ছলতার চিহ্ন থাকলেও মায়া মমতার কমতি ছিল না কোথাও। আমরা জানতাম স্বাধীনতার ব্যপ্তি ও সীমাবদ্ধতা কতটা।

স্বাধীনতা মানে কি যার যা ইচ্ছে করতে পারা? তা হলে তো উগ্রতা সংকীর্ণতা বা দেশ বিরোধিতা করাও স্বাধীনতা। মূলত স্বাধীনতা একটি জাতির সুশৃঙ্খল জীবন ও মুক্ত থাকার অধিকার। এমন একটি বাংলাদেশ ই চেয়েছিলাম আমরা।

রবীন্দ্রনাথ লিখেছেন, তোমার পতাকা যারে দাও তারে বহিবারে দাও শকতি। এর মানে কি আসলে? সাধারণ দৃষ্টিতে মনে হতে পারে এ আর এমন কি? একটা পতাকাই তো। সে তো একজন শিশু ও বহন করতে পারে। কিন্তু এর গুরুত্ব রবীন্দ্রনাথ পরাধীন ভারতবর্ষেও টের পেয়েছিলেন। পতাকা একটি প্রতীক। প্রতীক মানচিত্রও। আসল কাহিনী থাকে বুকের ভেতর। আমাদের স্বাধীনতার কাহিনি অনেক জোরালো আর বেদনার। আমি জানি না কেন এবং কি কারণে আমরা জাতো হিসেবে বিভেদকামী। তবে এই বয়সে এসে এটুকু বুঝি আমাদের বিভেদের কারণ রাজনীতি আর নেতৃত্ব। এই কথাগুলো এখন স্পষ্ট করে বলাও বিপজ্জনক। মধ্য পঞাশে দাঁড়ানো একটি দেশ ও জাতির জন্য এটুকু জানা জরুরি যে তার ঐক্যহীনতার শিকড় কোথায়?

মজার ব্যাপার এই বাংলাদেশ এবং তার মুক্তিযুদ্ধ আগাগোড়াই রাজনীতির সুবর্ণ ফসল। রাজনীতিই তখন আমাদের পথ দেখাতো। আজ মানুষ যাদের ভয় পায় বা যাদের কথা বিশ্বাস করে না তারাই ছিলেন তখন মুক্তিদাতা। মানে রাজনৈতিক নেতাদের কথা বলছি। যারা তখন রাজনীতি করতেন তারা মেপে কথা বলতেন। কাজ করতেন অধিক।

পরবর্তীতে আমরা তা মানলাম না। আজকে আরেক সমস্যা। দুনিয়ার সবদেশ এখন এগুচ্ছে। আমরাও এগুচ্ছি। দেশের উন্নয়ন অগ্রগতি যখন ধাবমান তখন বাক স্বাধীনতা ও ইতিহাস বিষয়ে কথা বলা বন্ধ হবার পথে। এটা স্বাধীন কোন জাতির জন্য ভালো হতে পারে না। অন্যদিকে বিরোধিতার চেহারা ও ভয়াবহ। আমি আজকাল কোনো বিরোধিতা দেখি না যা দেখি তার নাম অপপ্রচার আর কুৎসা। এটাও আমাদের সমাজ বিকৃতির ফসল। খেয়াল করবেন কোন শুভ বিষয় বা ভালো কিছু আজকলা মানুষকে টানে না। সামাজিক মিডিয়া চালু হবার পর সবকিছু চলে গেছে অপপ্রচারের দখলে। যারা এখন মাথার ওপর আছেন তাদের দেখলে করুণা হয়। করুণা এই কারণে একটা সময় আমাদের সমাজ যখন অবরুদ্ধ মানুষ কথা বলতে ভয় পেতো বা সামাজিক জগৎ অন্ধকারে থাকতো তারা পথ দেখাতেন। এখন এরাই অন্ধ।

বাংলাদেশ আসলে কোন পথে যাবে বা কোনটি তার পথ? এই জিজ্ঞাসা স্বাভাবিক। তারচেয়েও জরুরি আমাদের অন্ধকারত্ব আর পরাধীনতার চিহ্ন গুলো মুছে দেয়া ।

আগামী দিনের বাংলাদেশ মূলত তারুণ্যের ওপর নির্ভরশীল। আমরা মানি বা না মানি বিজ্ঞান মানবিকতা আর বিশ্বাস এই তিন বিষয় হাত ধরাধরি করে না চললে আমরা এগুতে পারবো না। আমি মনে করি আমাদের এসব বিষয় মাথায় রাখা দরকার। অভ্যন্তরীণ ঝগড়া ফ্যাসাদ আর অনৈক্য দূরীভূত করার বিষয় এখন জরুরী। এতো বছর পরও যদি সবকিছু আইন করে কানুন বানিয়ে মানাতে হয় তাহলে সরকার পরিবর্তনের পর আবারো অন্ধকার গ্রাসী ইতিহাসের দু:স্বপ্ন থেকেই যাবে। কে নিশ্চিত করবে নতুন কোন জোট এসে আবার ইতিহাসের গায়ে আঁচড় কাটবে না? এবার তা হলে কি পরিমাণ ভয়াবহভাবে তা হতে পারে সেটাই বরং দুর্ভাবনার বিষয়।

শেষ কথাটা এই, আমাদের স্বাধীনতার জন্য শুধু দেশের মানুষজন লড়াই করেন নি। জর্জ হ্যারিসন রবিশংকর থেকে অষ্ট্রেলিয়ান মুক্তিযোদ্ধা ওডারল্যান্ডের মতো মানুষেরা লড়েছিলেন। লড়েছিলেন ফ্রান্সের এক তরুণ বিমান হাইজ্যাককারী। নিজের জীবন বাজী রেখে এরা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে বেগবান করেছিলেন। যে সব বাঙালি জান হাতে যুদ্ধ করেছিলেন যাঁরা বীরাঙ্গনা হয়েছিলেন তাঁদের ত্যাগ আর বীরত্ব শুধু ইতিহাসে থাকলে আমরা টবে রাখা গাছের মতো শুকিয়ে মরবো। আমাদের স্বাধীনতাও ধুঁকবে। আজ বাংলাদেশের ঝলমলে উন্নয়ন আর অগ্রযাত্রার পাশাপাশি রবীন্দ্রনাথের সেই কথাটি ফের মনে রাখতে হবে। দেশ মানে ভূখন্ড আমাদের। পতাকা আমাদের। সঙ্গীত আমাদের হয়েছে। এখন তা বহন করার শক্তি দরকার। মানুষই পারে তা করতে তা করে দেখাতে। ইতিহাস মুক্তিযুদ্ধ আর চব্বিশের আত্মত্যাগ এর প্রতি সম্মান ও আত্মবিশ্বাস থাকলে দেশ ও প্রবাসের বাংলাদেশীরাই পারে স্বাধীনতাকে আরো অর্থবহ ও চমৎকার করে তুলতে। এই পারাটাই হোক আমাদের সবার প্রতিজ্ঞা।

লেখক : কবি, সাহিত্যিক, কলামিস্ট।

পূর্ববর্তী নিবন্ধসমকালের দর্পণ
পরবর্তী নিবন্ধরোহিঙ্গা সঙ্কটের প্রতি সমর্থন পুনর্ব্যক্ত করেছেন জাতিসংঘ প্রধান