তমদ্দুন মজলিস ও ভাষাসৈনিক বদিউল আলম চৌধুরী

ড. নাজনীন কাউসার চৌধুরী | শনিবার , ৮ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ at ৯:১৭ পূর্বাহ্ণ

(পূর্ব প্রকাশিতের পর)

() বাংলা ভাষার দাবীতে নিয়মিত সভাসমাবেশ, স্মারকলিপি পেশ ও বিতরণ, তমুদ্দুনের মুখপাত্র ‘সাপ্তাহিক সৈনিকবিতরণ, বিক্ষোভ মিছিল, বিভিন্ন ধরনের পিকেটিং, বইপত্র প্রকাশনা ও বিতরণে সক্রিয় অংশগ্রহণ: ভাষাসৈনিক বদিউল আলম চৌধুরী তাঁর এক সাক্ষাৎকারে বলেন– “……বাংলাকে অন্যতম রাষ্ট্রভাষার দাবিতে তমুদ্দুন মজলিসের একজন নিষ্ঠাবান কর্মী ছিলাম। ডাঃ মোহসীন, ইঞ্জিনিয়ার আজিজুর রহমান ও এ কে এম রফিকুল্লাহ চৌধুরীর নেতৃত্বে বাংলা ভাষার দাবিতে নিয়মিত সভাসমাবেশ, স্মারকলিপি পেশ ও বিতরণ, তমদ্দুনের মুখপাত্র ‘সাপ্তাহিক সৈনিকবিতরণ, বিক্ষোভ মিছিল, বিভিন্ন ধরনের পিকেটিং, বইপত্র প্রকাশনা ও বিতরণ আমাদের অন্যতম কর্মসূচী ছিল। লিয়াকত আলী খানের ‘বেসিক প্রিন্সিপালএর বিরুদ্ধে দেশব্যাপী প্রতিবাদের অংশ হিসেবে চট্টগ্রামে সভাসমাবেশ করেছিলাম। আবুল কাশেম, আবুল মনসুর, কাজী মোতাহের হোসেন চৌধুরী লিখিত ‘বাংলানা উর্দুবইটি আমরা বুদ্ধিজীবি মহলে বিলি করেছি। আন্দরকিল্লা মুসলিম এডুকেশন সোসাইটি সংলগ্ন মেডিকেল স্কুল ছাত্রাবাস, রথের পুকুর পাড়ে তওহিদুল আনোয়ারের বাসায় সভা করতাম। ১৯৫১ সালের জানুয়ারিতে লিয়াকত আলী খানের বক্তব্যের প্রতিবাদে বিক্ষোভ সভা করেছি” [সূত্র : () ভাষাসৈনিক বদিউল আলম চৌধুরীর সাক্ষাৎকার– ‘স্মৃতিচারণ (একুশের সৈনিক), মাসিক চাটগাঁ ডাইজেস্ট, ৬ষ্ঠ বর্ষ, ২য় সংখ্যা, ২০০০ এবং () এম আর মাহবুব সম্পাদিত ‘ভাষা সংগ্রামের স্মৃতি, ভাষা আন্দোলনের গবেষণা কেন্দ্র ও জাদুঘর, ২০১৬]

() পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিয়ে ‘সাইকেল বাহিনীর নেতা হিসেবে গোপন মিশনে অংশগ্রহণ: ভাষাসৈনিক বদিউল আলম চৌধুরী পুলিশের চোখকে ফাঁকি দিয়ে গোপন মিশনে নেমেছিলেন। তাঁর এ গোপন মিশনের বাহন ছিল সাইকেল এবং তিনি এ ‘সাইকেল বাহিনীর নেতা ছিলেন [সূত্র : দৈনিক আজাদী, ২১ ফেব্রুয়ারি, ২০২১ খ্রিস্টাব্দ তারিখের একুশের বিশেষ সংখ্যা (পৃষ্ঠা)]। ভাষা আন্দোলনে ‘সাইকেল বাহিনীর এ অবদানের উল্লেখযোগ্য তথ্য জানা যায় বিশিষ্ট মুক্তিযোদ্ধা, গবেষক ও কলামিস্ট সাখাওয়াত হোসেন মজনুর এক প্রবন্ধে, “একটি স্মৃতিচারণের গল্প বলি। সময়টা ১৯৯০ এর। তখন নুর আহমদ সড়কের মেট্রোপোল চেম্বারে গুণিজনদের একটা আড্ডা হতো। সে আড্ডায় যারা থাকতেন চট্টগ্রামের শিক্ষক, সাংবাদিক, ডাক্তার, ইঞ্জিনিয়ার, লেখক, কবি, রাজনীতিক, রাষ্ট্রদূত সহ অনেক শ্রেণি পেশার মানুষ। এমন একটি বৈঠকী আড্ডায় প্রফেসর খালেদ সাহেবকে সামনে রেখে অধ্যক্ষ মোহাম্মদ হোসেন খান অতীত স্মৃতি রোমন্থন করে বলতে শুরু করেন ভাষা আন্দোলনের চট্টগ্রামের সাইকেল বাহিনীর কথা। তখন অধ্যক্ষ স্যার আমাদের বললেন, এখানে তোমাদের পরিচয় করে দেবো একজন সাইকেল নায়কের কথা। তিনি আমার বদি ভাই। আমরাতো বদিউল আলমকে চিনি এবং ভাষা সংগ্রামী তাও জানি। তারপর তিনি মজা করে ভাষা আন্দোলনের প্রচার সেলে সাইকেল নিয়ে বদিউল আলম চৌধুরীর ত্যাগ ও সাহসের কথা বললেন। ধনী ঘরের ছেলেতো তাই তিনি ২টি রেলি সাইকেল কিনে নিজে একটি চালাতেন এবং আর একটি দিলেন আমাকে। এই সিদ্ধান্ত প্রথমে বদি ভাইয়ের, পরে অবশ্য তমদ্দুন মজলিশ জানলেন” [সূত্র: ‘সাম্প্রতিক চট্টগ্রাম ও দৈনন্দিন টুকিটাকি, সাখাওয়াত হোসেন মজনু, দৈনিক আজাদী, ১২ অক্টোবর, ২০২০ খ্রিস্টাব্দ]

() গেরিলা যোদ্ধার ভুমিকা, গোপন প্রচার তৎপরতা ও বাংলা ভাষা সংগ্রামের পক্ষে জোয়ার সৃষ্টি: সাইকেল বাহিনী গেরিলা যোদ্ধাদের মতো গোপন প্রচার তৎপরতা চালিয়ে জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসনকে বিভ্রান্তির মধ্যে ফেলে দেন এবং সকল অঞ্চলে বাংলা ভাষা সংগ্রামের পক্ষে জোয়ার সৃষ্টি হয়-“বলা প্রয়োজন যে সাইকেল বাহিনী এতোটাই তৎপর ছিলো প্রশাসন কোন ভাবেই ভাষা সংগ্রামীদের দমন করতে পারছিলো না। বাধ্য হয়ে পুলিশ প্রশাসন বাড়ি বাড়ি গিয়ে হামলা শুরু করে। পুলিশী হামলা যতোই বাড়ছিলো প্রচারের তেজ আরো বেড়ে গেলো। একটা সময় এলো যখন ‘কাঁদতে আসিনি ফাঁসীর দাবি নিয়ে এসেছিপুস্তিকার সংকট সৃষ্টি হয়েছিলো। কপি পাওয়া যাচ্ছিলো না তখন কবিতাটির সাথে বক্তব্য সংযোগ করে সাইক্লোস্টাইল করে মুদ্রনের ব্যবস্থা করেন। ভাষা সংগ্রামের সাথে তখন চট্টগ্রামের পেশাজীবী সমাজ শক্তির সুধিজন এতোটাই জড়িত হয়ে পড়েন। জেলা প্রশাসন ও পুলিশ প্রশাসন বিভ্রান্ত হয়ে পড়ে। তখন প্রতিটি মহকুমা, থানা অঞ্চলে বাংলা ভাষাসংগ্রামের পক্ষে জোয়ার সৃষ্টি হয়। সাইকেল বাহিনীর গোপন প্রচার তৎপরতা ছিলো অনেকটা গেরিলা যোদ্ধাদের মতোই। বদিউল আলম চৌধুরী নিজ এলাকায় নৌকার মাঝিদের এই প্রচার কাজে ব্যবহার করেছিলেন। সাগর দিয়ে নৌকায় করে প্রচার পত্র বিশেষ বিশেষ মাঝিদের হাতে দিয়ে বলতেন সন্দ্বীপ ও সীতাকুন্ড অঞ্চলে পৌঁছে দিতে। তমদ্দুন মজলিসের কর্মীরা সাইকেল, নৌকায় করে গ্রামে গ্রামে পত্র পাঠিয়ে পাকিস্তানী প্রশাসনকে নাস্তানাবুদ করে দিয়েছিলেন। এই প্রচার কৌশলের বিষয়টি পুলিশ প্রশাসন বুঝতে পারেনি। তখন উত্তর কাট্টলী থেকে দক্ষিণ পতেঙ্গায় যাওয়ার অনেকগুলো মেঠোপথ ছিলো। এমন অবস্থা ছিলো বাকলিয়া, চান্দগাঁও অঞ্চলের মধ্যেও। তাদের প্রচার শুরু হতো সন্ধ্যার পর এবং চলতো গভীর রাত পর্যন্ত। স্থানে স্থানে ছিলো আশ্রয় কেন্দ্র। তখন গ্রামীণ অঞ্চলে প্রতি বাড়িতে ছিলো বাংলা ঘর বা কাচারি ঘর। সেখানে বাড়ির ছেলে মেয়েরা লজিং মাস্টারের তত্ত্বাবধানে পড়ালেখা করতেন। ভাষা সংগ্রামী ছাত্র তরুণরা প্রচার পত্র বিলি করে বাড়ি ফিরতে না পারলে গ্রামের বন্ধুদের বাংলা ঘর বা কাচারি ঘরে থেকে যেতেন। সে সময় এমন অতিথি পেলে বাড়ির মানুষ আনন্দের সাথে অতিথি আপ্যায়ন করতেন” [সূত্র : ‘সাম্প্রতিক চট্টগ্রাম ও দৈনন্দিন টুকিটাকি, সাখাওয়াত হোসেন মজনু, দৈনিক আজাদী, ১২ অক্টোবর, ২০২০ খ্রিস্টাব্দ]

() বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির রক্তাক্ত ট্রাজেডি ও সরকার বিরোধী সংগ্রামে অংশগ্রহণ: বায়ান্নর একুশে ফেব্রুয়ারির রক্তাক্ত ট্রাজেডির খবর পৌঁছালে সারা বাংলাদেশে দাবানলের মত বিক্ষোভের আগুন ছড়িয়ে পড়ে। ভাষা আন্দোলনের সাথে জড়িত বীর চট্টলার বীরসেনানিরা বিক্ষোভে ফেটে পড়েন এবং সরকার বিরোধী সংগ্রামে ঝাঁপিয়ে পড়েন। এ প্রসংগে ভাষাসৈনিক বদিউল আলম চৌধুরী তাঁর সাক্ষাৎকারে উল্লেখ করেন-“ ঢাকায় ২১শে ফেব্রুয়ারি রক্তাক্ত ট্র্যাজেডির পর ২২ শে ফেব্রুয়ারি মোমিন রোড হতে মিছিল করে লালদিঘি মাঠে সমাবেশ করি। মিছিলের আগে পিছে পুলিশ ছিল। কোন কোন ক্ষেত্রে পুলিশ ও গোয়েন্দা কর্মকর্তা আমাদের উৎসাহিত করেছে। ২৫ ফেব্রুয়ারি লালদীঘি ময়দানে আয়োজিত জনসভায় ব্যাপক গোলযোগ হয়। গণপরিষদের সদস্য একে খানকে পদত্যাগ করে বক্তব্য রাখতে বাধ্য করা হয়। এ জনসভায় দুহাজারের অধিক লোক সমাগম হয়। এক পর্যায়ে সভা ভেঙে যায়” [সূত্র : () ভাষাসৈনিক বদিউল আলম চৌধুরীর সাক্ষাৎকার– – ‘স্মৃতিচারণ (একুশের সৈনিক), মাসিক চাটগাঁ ডাইজেস্ট, ৬ষ্ঠ বর্ষ, ২য় সংখ্যা, ২০০০ এবং () এম আর মাহবুব সম্পাদিত ‘ভাষা সংগ্রামের স্মৃতি, ভাষা আন্দোলনের গবেষণা কেন্দ্র ও জাদুঘর, ২০১৬] (চলবে)

লেখক: মরহুমের কন্যা, সরকারি কর্মকর্তা, অর্থনীতিবিদ ও প্রাবন্ধিক

পূর্ববর্তী নিবন্ধযোগ্য, যোগ্যতা, যোগ্যতার খেসারত
পরবর্তী নিবন্ধহল্যান্ড থেকে