পরনের কাপড় ছেঁড়ে, পুরনো তেনা–তেনা হয়ে যাওয়া শাড়িটি আলিফ– জান পরে নিল। তার উপর আরেকটি রংজ্বলা শাড়ি জড়িয়ে নেয়।
শীত প্রায় যায় যায়, মাঘ মাসের ২১ তারিখে শীত উঠে যাবে। এবারের শীত আলিফ জানকে ভুগিয়েছে। ঠান্ডায় ডান পা ঝিঁঝিঁ করে, এরপর অবশের মতো হয়ে যায়। পায়ের দু’পাতা ফেটে রক্ত আর কষ মিলে চটচট করছে। এত কিছুর পরও আলিফ জানকে বেড়াতে যেতে হবে। ঘরে বসে থাকার উপায় নেই।
অনেক বছর ধরে সে বেড়িয়ে বেড়িয়ে খায়। কাছের দালান থেকে দূরের দালান, এদের দুয়ার থেকে তাদের দুয়ার এভাবেই আলিফ জান ভিক্ষে করে বেড়ায়।
রক্ত কষের উপর বালির আস্তর পরা ‘পাকে’ আলিফ–জান টেনে নিয়ে যায় আর মনে মনে স্বপ্ন বুনে,“আর ভিক্ষা মাঙ্গবো না, মানুষের কাছে খয়রাত চাইতে আমার ভাল লাগে না। হাতে যদি হাজার বিশেক টাকা পাই, তবে খেটে খাওয়া মানুষের জন্য ছোট একটা দোকান দিমু । যেই দোকানে মানুষ শীতল পাটিতে বইয়া ঘাম মুছবো আর টিনের থালে ডিমের পাতলা ঝোল দিয়া শান্তিতে কয়টা ভাত খাইবো।”
বাসিরন মেয়েকে সাথে নিয়ে দূরে দাঁড়িয়ে আছে।
বাসিরন: আলিফব্বু দেরি করলা কে ? বেলা উইঠা গেছে, তাড়াতাড়ি লও–
আলিফ জান: মাইয়ারে লইয়া বেড়াইতে পারবি?
বাসিরন: কই থুইয়া যামু কও, ওরে লইয়াই তো আমার জ্বালা। আপন ভাইয়ের কাছে থুইয়া গার্মেন্টস করতে গেছিলাম। ভাই ভাগ্নীর সর্বনাশ করল। সহ্য করতে না পাইরা আমি ভাইয়েরে খুন করলাম। আপন ভাইরে নিজের হাতে খুন কইরা, নারায়ণগঞ্জ থেইকা কামরাঙ্গীরচর, কামরাঙ্গীরচর থেইকা চট্টগ্রামের আকমল–আলী রোডে পুলিশের ডরে পলাইয়া বেড়াইতাছি।
এত এত বেডিরা চাকরি করে, পোলাপাইনডি কই থুইয়া যাইবো কও ? কেডা খাওয়াইবো ? কেডা অগরে মানুষ করব?
আলিফ জান: ল ছেড়ি, হাট তাড়াতাড়ি;
চার তলা–পাঁচতলা–ছয়তলা–
নাহ্, কোনো তলায় দরজা খোলে না।
বাসিরন কন্যা: মা পানি খামু,
বাসিরন: চুপ থাক,পানি পামু কই?
দুয়ারে হরেক রকম জুতা,স্যান্ডেল, নাগরা, বুট জুতা–
বাসিরন: ফিসফিস করে বলে, ও বুবু এক জোড়া লইয়া লও,পায়ে আরাম পাইবা–
স্যান্ডেলের দিকে তাকিয়ে আলিফ জানের চোখ চকচক করে ওঠে–
দুই সেকেন্ড, দু’মিনিট ঠাঁয় দাঁড়িয়ে থাকে আলিফ জান।
“অভাবে স্বভাব নষ্ট!”
অভাবের সর্বোচ্চ পর্যায়ে পরীক্ষায় বসলেই কেবল পাস–ফেলকে টপকাতে পারে মানুষ।
বাসীরন কন্যা: মা পানি দাও;
বাসিরন জোরে জোরে দরজা নাড়ে, একটু পানি দাও গো খালা,
খালা গো, একটু পানি দাও;
গৃহিণী: দরজা খুলে ছোট্ট প্লাস্টিকের আইসক্রিমের কাপে পানি দেয়। খাওয়া হলে কাপটা ফেলে দিস।
দরজার ফাঁকা দিয়ে, ঘরের ভেতর থেকে গান ভেসে আসে–
‘তোমরা যারা আজ আমাদের ভাবছো মানুষ কিনা?
আমরা মানুষ ভাগ্য শুধু করলো প্রবঞ্চনা।
করলো প্রবঞ্চনা।’
মেহেরাব হাসান অনেকক্ষণ রোদে দাঁড়িয়ে আছেন। শরীরের ভিতর ঘাম বিজবিজ করছে। মুছবার উপায় নেই। হাত শটান করে, থুতনি উঁচিয়ে তার মতো আরো বেশ কয়েকজন পিতা–মাতা দাঁড়িয়ে আছেন। কষ্টকর ট্রেনিং শেষে,সন্তানরা আজ পরিপূর্ণভাবে বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে যোগদান করবে।
দাঁড়িয়ে থেকে মেহরাব হাসান স্মৃতি আওরান। সন্তানের জন্য প্যাম্পার্স কেনার দৌড়ঝাঁপ, সেরিলাক কেনার আহাজারি, ঝিমাতে–ঝিমাতে বাসে করে কোচিংয়ে নিয়ে যাওয়া, মিথ্যে হুংকার দেবার অভিনয়, টিফিনের ফাঁকে জেলি মাখা ঠান্ডা পাউরুটি খাইয়ে দেওয়া–
দুর ছাই! চোখে পানি এসে যাচ্ছে!
আমাকে সভ্য,শান্ত ,ভদ্র থাকতে হবে;
ইস্ত্রি করা শার্ট–প্যান্ট পরা, মেহরাব সাহেব টান হয়ে দাঁড়িয়ে থাকেন। পুরনো জুতোর কথা মনে হতেই, পিঠ কুচকে পা বেঁকিয়ে জুতো জোড়া ঢাকবার ব্যর্থ চেষ্টা করেন।
মেহেরাব হাসান স্বপ্ন গাঁথেন, রমজান মাস প্রায় আসি আসি করছে। ছেলের প্রথম মাসের বেতন আর যাকাতের টাকা এমন একজনকে দিব, যে মানুষ এই টাকা কাজে লাগিয়ে, নিজের আয়ে নিজে চলতে পারবে।”
চতুর্দিকে সাজসজ্জা, কুচকাওয়াজ, প্যারেড।
গর্বে মেহেরাব সাহেবের নিঃশ্বাস উঠানামা করে।
ওই তো আমার সন্তান;
লাল গালিচায়, তালে–তালে হেঁটে আসছে,
মেহেরাব সাহেবের বুক টিপটিপ করে;
লম্বা, ছিপছিপে, শ্যামবর্ণ, ছোট করে চুল ছাঁটা ওই তো আমার কলিজার টুকরো–
ছেলে এগিয়ে আসছে…
মেহেরাব হাসান: চোয়াল শক্ত করে রাখে, কিছুতেই চোখে পানি আনা যাবে না
ড্রিম–ড্রিম–ড্রিম
ছেলে নিকটে আসে, আরো কাছে আসে–নিজের মাথার ক্যাপ খুলে বাবার মাথায় পরিয়ে দেয়–আলোকসজ্জা ,সুধীজন, শত লোককে বুড়ো আঙ্গুল দেখিয়ে ,বাবা অঝোরে কাঁদতে থাকেন–
দূরে গান বেজে চলছে–
‘আঙ্গুলে আঙ্গুল ছুঁয়ে শেখালে তুমি জীবনের পথ চলা,
নিজে না খেয়ে তুমি খাওয়ালে;
শেখালে কথা বলা,
বাবা তুমি আমার যত খুশির কারণ।
বলো তোমার মতন করবে কে শাসন।
বাবা তুমি আমার বেঁচে থাকার কারণ।।’