গত ১৯ জানুয়ারি ক্ষতবিক্ষত ও যুদ্ধবিধ্বস্ত গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে। দীর্ঘ ১৫ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধের পর কাতার, মিশর আর যুক্তরাষ্ট্রের সহায়তায় এই যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে বলে ধারণা করা হচ্ছে। যুদ্ধবিরতির বিভিন্ন শর্ত নিয়ে দুই পক্ষের মধ্যে টানাপোড়ন চলছিল দীর্ঘদিন ধরে। ইসরায়েলের রক্তখেকো প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু এর একগুঁয়েমির কারণে যুদ্ধবিরতির বিভিন্ন ফাঁক ফোঁকর রয়ে গেছে বলে মনে করা হচ্ছে। বিশ্লেষকদের ধারনা, এই যুদ্ধবিরতি কয়দিন টিকবে? কারণ, গাজার পাশেই ফিলিস্তিনের পশ্চিম তীরে চলছে ইসরায়েলি আগ্রাসন। প্রতিদিন বিমান থেকে বোমা হামলা করে ফিলিস্তিনিদের হত্যা করা হচ্ছে। আন্তর্জাতিক সমর বিশেষজ্ঞদের ধারণা, গাজায় লজ্জাজনক হারের পর ইসরায়েল কি পশ্চিম তীরে আগ্রাসন চালিয়ে কট্টর ইহুদিপন্থিদের খুশি করছেন? পশ্চিম তীরে অবৈধ বসতি স্থাপনকারীরাও ইসরায়েলি আগ্রাসনে নিজেরা সম্পৃক্ত হয়ে ফিলিস্তিনিদের বাড়িঘর আগুন জ্বালিয়ে ধ্বংস করে দিচ্ছে। গাজায় যুদ্ধবিরতির পরদিন থেকে এই আগ্রাসন এক দিনের জন্যও থামেনি। নেতানিয়াহু জোটের দু’একজন মন্ত্রীও যুদ্ধবিরতির প্রতিবাদে পদত্যাগ করেছেন। তারা হুমকি দিয়ে বলেছে, পুনরায় যুদ্ধ শুরু না করলে তারা সরকার থেকে বের হয়ে আসবে। যদিও এতে নেতানিয়াহু সরকার অস্তিত্ব সংকটে ভুগবে না। যুদ্ধবিরতির পরদিন থেকে অবরুদ্ধ গাজাবাসীরা তাদের নিজেদের বাসস্থানে ফিরে আসতে শুরু করেছে। উত্তর গাজার ১১ লাখ বাসিন্দাদের নেতানিয়াহু প্রশাসন উচ্ছেদ করেছিল। অনেকেই দীর্ঘদিন উদ্বাস্তু থাকার পর উত্তর গাজার বাসায় এসে নিজেদের বাসস্থান চিনতে পারছেন না। উত্তর গাজার এক বাসিন্দা খালেদ ইব্রাহীম (৫২) নিজের বাড়ি ফিরে দেখেন, তার বাড়ীর কোন অস্তিত্ব নেই। খালেদের কথায়, ‘আমরা শারীরিক ও মানসিকভাবে বিপর্যস্ত। জীবন কঠিন হয়ে উঠেছে। আমাদের যা কিছু ছিল সবই হারিয়েছি। এখন বাড়ি ফিরে নিজের ঘরই চিনতে পারছি না’ ইব্রাহীমের মত লাখ লাখ উদ্বাস্তু বাড়ি ফিরে দেখেন, সবই ধ্বংসযজ্ঞ। কোন কিছুরই অস্তিত্ব নেই। তারা বুঝতে পারছে না কোথায় তারা মাথা গোঁজার ঠাঁই পাবেন? ১৫ মাসের রক্তক্ষয়ী যুদ্ধে ৪৭ হাজারের বেশি ফিলিস্তিনিকে শহীদ করেছে বর্বর ইসরায়েলি বাহিনী। এখনও ধ্বংসস্তুপের নিচে অনেক মরদেহ পড়ে আছে বলে মনে করা হচ্ছে। উত্তর গাজার বাসিন্দারা নেতজারিম করিডোর দিয়ে নিজেদের বাসস্থানে ফিরছেন লাখ লাখ ফিলিস্তিনি। অনেকে হেঁটে, গাড়িতে এবং ঘোড়া–গাধার গাড়িতে চড়ে উত্তর গাজায় ফিরে যাচ্ছেন। উত্তর গাজার সমস্ত অবকাঠামো যেন ধ্বংসস্তুপে পরিণত আজ। কোন কিছুরই নিশানা নেই। সবকিছু ইসরায়েলের ভয়ানক বোমার আঘাতে ক্ষত–বিক্ষত। ইসরায়েলের বোমার আঘাতে উত্তর গাজা বিরাণ ভূমিতে পরিণত হয়েছে। এই অঞ্চলটির ৭০ ভাগই মাটির সাথে মিশে গেছে। উত্তর গাজায় বসবাসের জন্য উপযোগী কোন উপকরণ নেই বললে চলে। আন্তর্জাতিক জিম্মি চুক্তি অনুযায়ী জিম্মিদের প্রতি আচরণ হামাসের জন্যই মানায় কিন্তু ইসরায়েলিদের জন্য মানায় না–এটা জানা গেছে মুক্ত ফিলিস্তিনবাসীদের বয়ানে। তাদের বর্বরতা হার মানিয়েছে নাৎসি যুগের বর্বরতাকেও। তাদেরকে খেতে দিত না, অকথ্য নির্যাতন করা হত, অমানবিক আচরণ করা হত তাদের সাথে। ১০ হাজারের অধিক ফিলিস্তিনি এখনো ইসরায়েলের কারাগারে বন্দি। গত ৩০ জানুয়ারি ৩ ইসরায়েলিসহ ৮ জিম্মিকে মুক্তি দিয়েছে ফিলিস্তিনের গাজার স্বাধীনতাকামী সংগঠন হামাস। তৃতীয় ধাপে তাদের মুক্তি দেওয়া হয় কিন্তু তার বিনিময়ে ১১০ ফিলিস্তিনিকে মুক্তি দেওয়ার সিদ্ধান্ত স্থগিত করেছে ইসরায়েল। এর পেছনে বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর দূরভিসন্ধিমূলক আচরণের ইঙ্গিত পাওয়া যাচ্ছে। এমন এক সময় নেতানিয়াহু এই সিদ্ধান্ত স্থগিত করার নির্দেশ দিলেন, যখন তার বিরুদ্ধে যুদ্ধবিরতি ও বন্দি বিনিময়ের চুক্তি ভেস্তে দেওয়ার পাঁয়তারা করার অভিযোগ উঠেছে। গত ১৯ জানুয়ারী ইসরায়েল ও হামাসের মধ্যে গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়। এরপর দুই ধাপে ইসরায়েলি কারাগার থেকে ২৯০ জনের বেশির্ ফিলিস্তিনি বন্দিকে মুক্তির বিনিময়ে ৭ জন ইসরায়েলি নারী সেনাকে মুক্তি দিয়েছিল হামাস। এখন যে কথাটি ভেসে বেড়াচ্ছে, সেটা হল–আদৌ কি নেতানিয়াহু যুদ্ধবিরতির শর্ত পালন করবেন? তার বিশ্বাসঘাতকতার প্রমাণ এর আগেও অনেকবার মিলেছে। ক্ষুব্ধ ইসরায়েলের ভেতর নেতানিয়াহু বিরোধী বিক্ষোভ ক্রমেই ফুঁসে উঠছে। একদিকে যুদ্ধ চালিয়ে যাওয়ার জন্য তার উপর প্রচন্ড চাপ, অপরদিকে সমপূর্ণ জিম্মি মুক্তি না হওয়া পর্যন্ত জিম্মি পরিবারের সদস্যদের চাপ–এই দু’য়ে মিলে প্রচন্ড মানসিক ও আন্তর্জাতিক কঠিন চাপের সম্মুখীন নেতানিয়াহু। ক্ষমতা কুক্ষিগত করে রাখার জন্য বিভিন্ন কূট–কৌশল অবলম্বন করছে রক্ত পিপাসু নেতানিয়াহু। পশ্চিম তীরের জেনিন শহরে যে হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে এখন তা শুধুমাত্র ক্ষুব্ধ ইসরায়েলিদের শান্ত করার নিমিত্তে। সুযোগ পেলে এই বর্বর ইসরায়েল নেতা যুদ্ধবিরতির শর্ত লংঘন করে আবারও যুদ্ধ শুরু করতে পারে গাজায়– এই আশঙ্কা কোন মতেই উড়িয়ে দেওয়া যায় না। যদিও ইসরায়েলি সৈন্যরা প্রচন্ড মানসিক চাপে আছে। তারা ১৫ মাসের যুদ্ধে পরিশ্রান্ত হয়ে পড়েছে। ৫ হাজারের অধিক ইসরায়েলি সৈন্যের মানসিক সমস্যা দেখা দিয়েছে, ১০ এর অধিক সৈন্য আত্নহত্যার পথ বেছে নিয়েছে। অনেকেই পুনরায় যুদ্ধে যাওয়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলেছে। বিলিয়ন বিলিয়ন ডলারের ক্ষতির সম্মুখীন হতে হয়েছে নেতানিয়াহুকে। এই আর্থিক ক্ষতি পুষিয়ে ওঠা অত্যন্ত কষ্টসাধ্য হবে বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। এদিকে বিশ্ব মোড়ল আমেরিকার নতুন ক্ষ্যাপাটে প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প ক্লিন গাজা মিশনের অংশ হিসাবে ফিলিস্তিন কর্তৃপক্ষকে গাজা খালি করার নির্দেশ দিয়েছে এবং এতে জর্ডান ও মিশরকে এই দায়িত্ব নেওয়ার জন্য বলা হয়েছে কিন্তু মিশর ও জর্ডান কর্তৃপক্ষ এতে সায় দেয়নি। ২২টি আরব দেশের সমন্বয়ে গঠিত আরবলীগও ট্রাম্পের এই সিদ্ধান্তের বিপক্ষে অবস্থান নিয়েছে। মনে করা হচ্ছে, ট্রাম্পের এটি একটি নতুন ছক, কৌশল। গাজা থেকে ফিলিস্তিনিদের বিতাড়িত করে এখানে অবৈধ ইহুদিদের বসতি স্থাপন করার স্বপ্নে বিভোর ট্রাম্প–নেতানিয়াহু, যেটা ১৯৪৮ সালে হয়েছিল। ফিলিস্তিনের অধিকাংশ ভূমি দখল করে বর্বর ইসরায়েলিরা বসতি স্থাপন গেড়ে বসে আছে যুগ যুগ ধরে। ধ্বংসস্তূপে পরিণত গাজার পূর্ণাঙ্গ সংস্কার করতে কয়েক দশক লেগে যেতে পারে বলে বিশ্লেষকদের ধারণা।
ইহুদিরা মনে করেছিল, শেষ হয়ে যাবে হামাস, সব জিম্মি তারা মুক্ত করে ছাড়বেই–দিন শেষে দেখা গেল এ সব যেন অন্তঃসারশূন্য। হামাস এর যেন দ্বিতীয়বারের মতন পুনর্জাগরণ ঘটেছে। ট্রাম্প–নেতানিয়াহুর চক্রান্ত সফল হবে না কষ্মিনকালেও। যুদ্ধ যদি আবার শুরু হয়ে যায় ঈমানী শক্তিতে বলিয়ান হামাসের দূরন্ত সৈনিকেরা আবার দ্বিগুন শক্তি নিয়ে লড়বে এবং লজ্জাজনক পরাজয় হবে বর্বর ইসরায়েলিদের।
লেখক: সভাপতি–রাউজান ক্লাব, সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি), রাঙ্গামাটি জেনারেল হাসপাতাল