পণ্য নিয়ে সাগরে ভাসছে আড়াইশর বেশি জাহাজ

সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ এটি দাম বাড়ানোর কৌশল পণ্যর এজেন্টরা বলেছে ভিন্ন কথা চট্রগ্রামে লাইটার জাহাজের সংকট প্রকট রমজানে বাজার অতিস্থিশীল করার অপচেষ্টা কিনা খতিয়ে দেখার আহব্বান

হাসান আকবর | শুক্রবার , ৭ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ at ৬:১৬ পূর্বাহ্ণ

রমজানকে সামনে রেখে আমদানিকৃত হাজার হাজার টন পণ্য নিয়ে এক মাসেরও বেশি সময় ধরে সাগরে ভাসছে আড়াইশ’রও বেশি লাইটারেজ জাহাজ। বাজারে দাম বাড়ানোর কৌশল হিসেবে আমদানিকারকেরা পণ্যগুলো খালাস না করে সাগরে ভাসমান গুদাম বানিয়ে রেখেছেন বলে অভিযোগ করা হয়েছে। এদিকে সময়মতো পণ্য খালাস না করায় চট্টগ্রামে লাইটারেজ জাহাজের সংকট প্রকট হয়ে উঠেছে। আমদানি পণ্য খালাসে প্রয়োজনীয় জাহাজ যোগাতে সংশ্লিষ্টদের হিমশিম খেতে হচ্ছে। অপরদিকে কিছু কিছু জাহাজ মালিকের ভূমিকার সমালোচনা করে পণ্যের এজেন্টেরা বলেছেন, পণ্য খালাস হওয়ার পর কিছু কিছু জাহাজ নিজেদের মতো করে পণ্য পরিবহনের জন্য লাইটারেজ জাহাজের নিয়ন্ত্রক সংস্থা বাংলাদেশ ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট কোঅর্ডিনেশন সেল বা বিডব্লিউটিসিসি’র সিরিয়ালে আসে না। আবার কোনো কোনো জাহাজ মালিক ভোগ্য পণ্য পরিবহন করতে চান না। তারা খালি থাকলেও ঘোষণা না দিয়ে চুপচাপ বসে থাকেন। অন্যদিকে মোংলা এবং পায়রাতে ভাড়া অপেক্ষাকৃত বেশি হওয়ায় অনেক জাহাজই সেদিকে চলে যায়। ভোগ্য পণ্য পরিবহনে জাহাজ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করা বেশ খরচ এবং সময়সাপেক্ষ। এসব ঝামেলা এড়াতেও অনেক খালি জাহাজ ভাড়ার জন্য সিরিয়ালে আসছে না। গতকালও চট্টগ্রাম সাইলোতে গম বোঝাই করতে যাওয়া তিনটি অপরিচ্ছন্ন জাহাজকে খাদ্য বিভাগ রিজেক্ট করেছে। সবকিছু মিলে জাহাজ বরাদ্দ দেয়ার ক্ষেত্রে বিডব্লিউটিসিসিকে সংকটের মুখে পড়তে হচ্ছে। তারা পুরো সেক্টরে শৃংখলা না আসলে পরিস্থিতির উন্নতি হবে না বলেও মন্তব্য করেছেন। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো জানিয়েছে, রমজানকে সামনে রেখে প্রচুর ভোগ্যপণ্য আমদানি করা হয়েছে। এসব পণ্যের অধিকাংশই কন্টেনার জাহাজের মাধ্যমে বন্দরে খালাস করে রেখে দেয়া হলেও ছোলা, ডাল, ভুট্টা, গম, চিনি, সয়াবিন সিড, চনার ডালসহ নানা পণ্য খোলা অবস্থায় আমদানি করা হয়েছে। এসব পণ্য নিয়ে আসা বড় বড় মাদার ভ্যাসেলগুলো বন্দরের জেটিতে প্রবেশ করতে পারে না। এগুলো বহির্নোঙরে অবস্থান নিয়ে লাইটারেজ জাহাজে পণ্য খালাস করে। এরমধ্যে কিছু কিছু জাহাজের পণ্য বিভিন্ন গন্তব্যে খালাস করা হলেও অধিকাংশ জাহাজকেই ভাসমান গুদাম বানিয়ে রাখা হয়েছে।

বিডব্লিউটিসিসির তথ্যানুযায়ী ২৬৯টি লাইটারেজ জাহাজে কয়েক লাখ টন পণ্য গত এক মাস আগে খালাস করা হলেও সেগুলো অভ্যন্তরীণ বাজারে আনা হয়নি। সবগুলো জাহাজই বিভিন্ন গন্তব্যে গিয়ে নদীতে ভাসছে। সংশ্লিষ্ট আমদানিকারকেরা রমজানকে সামনে রেখে দাম বাড়ার অপেক্ষায় জাহাজগুলোকে নিরাপদ গুদাম বানিয়ে আটকে রেখেছে বলেও অভিযোগ করা হয়েছে। সচরাচর বিভিন্ন সময় গুদামে প্রশাসনের অভিযান পরিচালিত হয়, পণ্যের অবৈধ গুদামজাতকরণের জন্য জরিমানা হয়। ঝুঁকি থাকে। কিন্তু জাহাজে এসবের ঝুঁকি থাকে না। সাগরে জাহাজে কোনো অভিযান পরিচালিত না হওয়ায় আমদানিকারকেরা দাম বাড়ানোর এ কৌশল খোঁজেন বলেও অভিযোগ করা হয়।

এদিকে ২৬৯টি জাহাজ ভাসমান গুদামে পরিণত হওয়ায় লাইটারেজ জাহাজের সংকট প্রকট হয়ে উঠেছে বলে জানিয়েছেন বিডব্লিউটিসিসির নির্বাহী পরিচালক মেজর (অব.) জিএম খান। তিনি বলেন, এতগুলো জাহাজ এক মাসের বেশি সময় ধরে আটকে রাখা হলে সংকট সৃষ্টি হওয়া স্বাভাবিক। তিনি সংশ্লিষ্ট আমদানিকারক এবং পণ্যের এজেন্টদের জাহাজগুলো দ্রুত খালাস করে দেয়ারও আহ্বান জানিয়েছেন। তিনি বলেন, গতকাল পর্যন্ত সর্বমোট ৮৮৮ জাহাজ কয়েক লাখ টন পণ্য নিয়ে দেশের ৬৯টি ঘাটে অবস্থান করছে। এসব জাহাজে ভুট্টা, গম, চিনি, ছোলা, ডাল, মটর ডাল, টিএসপি, ইউরিয়া, এমওপি, কয়লা, পাথর এবং ক্লিংকারসহ বিভিন্ন পণ্য রয়েছে।

গতকালের পরিস্থিতি উল্লেখ করে তিনি বলেন, আজ চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে ৩৫টি মাদার ভ্যাসেল অবস্থান করছে। একটি জাহাজে কমপক্ষে দুইটি করে জাহাজ দিলেও ৭০টি জাহাজ দরকার। অথচ বিডব্লিউটিসিসির সিরিয়ালে ৪০ থেকে ৪৫টি জাহাজ রয়েছে। এতে করে সবগুলো জাহাজে চাহিদা মোতাবেক জাহাজ দেয়া সম্ভব হবে না। আমদানিকারকেরা দ্রুত লাইটার খালি না করলে পরিস্থিতির আরো অবনতি হবে বলেও তিনি আশংকা প্রকাশ করেছেন।

লাইটারেজ জাহাজ সংকটের কারণে দেশের আমদানি বাণিজ্যের পণ্য খালাস ব্যাহত হচ্ছে বলে উল্লেখ করে সূত্র বলেছে, চাহিদা মোতাবেক জাহাজ দেয়া সম্ভব হচ্ছে না বহু মাদার ভ্যাসেলে। এতে বহির্নোঙরে জাহাজের অবস্থানকাল বেড়ে যাচ্ছে। যা দেশের সার্বিক আমদানি বাণিজ্যের জন্য ক্ষতিকর বলেও সূত্র জানিয়েছে।

ভোগ্য পণ্যের বাজার অস্থিতিশীল করার জন্য লাইটারেজ জাহাজ খালি না করে জাহাজগুলোকে ভাসমান গুদাম বানিয়ে রাখা হয়েছে কিনা তা খতিয়ে দেখার জন্যও সরকারের বিভিন্ন এজেন্সির প্রতি অনুরোধ জানানো হয়েছে।

মেজর (অব.) জিএম খান ১৫ জন পণ্যের এজেন্টকে আমদানিকারকদের চাপ দিয়ে জাহাজ খালি করার উদ্যোগ নেয়ার আহ্বান জানিয়েছেন। জাহাজ খালি হলেই কেবল পরিস্থিতি স্বাভাবিক হবে বলেও তিনি মন্তব্য করেন।

আমদানিকারকদের প্রতিনিধি পণ্যের এজেন্টদের পক্ষে থেকে বিডব্লিউটিসিসির বক্তব্যের সাথে দ্বিমত পোষণ করে বলেন, কিছু জাহাজ আটকে আছে কথাটি ঠিক। তবে গত ১৫/২০ দিন আগে যারা পণ্য বোঝাই করতে বরাদ্দ পেয়েছেন তাদেরকে তো জাহাজ খালি করার সময় দিতে হবে। প্রতিটি ট্রিপের জন্য তো একটি নির্দিষ্ট ফ্রি টাইম আছে। গতকাল বরাদ্দ দিয়ে আজ যদি জাহাজ খালি করতে বলা হয় তাহলে তো হবে না। তারা বলেন, বেশ কিছু জাহাজ মালিক জাহাজ খালি করার পরও ঘোষণা না দিয়ে ভালো ভাড়ার জন্য অপেক্ষা করেন। আবার অনেকেই সিরিয়ালের বাইরে গিয়ে পণ্য পরিবহন করেন। ওই জাহাজ খালি হওয়ার তথ্যই বিডব্লিউটিসিসিকে দেয়া হয় না। প্রতিটি জাহাজের নাম ধরে ধরে খোঁজ করলে দেখা যাবে অনেক জাহাজই গন্তব্যে পণ্য খালাস করার পর কোথাও ঘাপটি মেরে বসে আছে। আবার কোনো কোনো জাহাজ মালিক বাড়তি ভাড়ার লোভে পায়রা ও মোংলা বন্দরের পণ্য পরিবহন করতে চলে গেছেন। ওই জাহাজগুলো চট্টগ্রামের সিরিয়ালেই নেই। তাই চট্টগ্রামে মাদার ভ্যাসেলের জন্য লাইটারেজ জাহাজ পাওয়া যাচ্ছে না।

ভোগ্য পণ্য পরিবহনের ব্যাপারে জাহাজ মালিক এবং নাবিকদের অনাগ্রহ এক্ষেত্রে বড় ধরনের সংকট সৃষ্টি করছে উল্লেখ করে একাধিক পণ্যের এজেন্ট জানান, ভোগ্য পণ্যের জন্য জাহাজ পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন করার বাধ্যবাধকতা রয়েছে। খাদ্য বিভাগের সার্ভেয়ার সরজমিনে পরিদর্শন করে জাহাজটি ভোগ্য পণ্য পরিবহনে উপযোগী হিসেবে রিপোর্ট দেয়ার পরই কেবল জাহাজটি পণ্য বোঝাই করতে পারে। আগের ট্রিপে পাথর কিংবা কয়লা বহনকারী অনেক জাহাজও পরিষ্কার না করে ভোগ্য পণ্য বোঝাই করতে চলে যায়। গতকালও সাইলো জেটিতে তিনটি লাইটারেজ জাহাজ ভোগ্য পণ্য বোঝাই করতে গেলেও সেগুলো ছিল একেবারে অপরিষ্কার। খাদ্য বিভাগ জাহাজ তিনটিকেই রিজেক্ট করেছে। সংশ্লিষ্ট পণ্যের এজেন্ট নতুন করে তিনটি জাহাজ দেয়ার আবেদন করেছে। কিন্তু ওখানে তিনটি জাহাজ দেয়ার পরিস্থিতি গতকাল বিডব্লিউটিসিসির ছিল না বলেও সূত্র জানিয়েছে।

সূত্র জানায়, পুরো সেক্টরে একটি সমন্বিত শৃংখলা না আসা পর্যন্ত এগুলো নিয়ন্ত্রণ করা যাবে না বলেও পণ্যের এজেন্টদের কয়েকজন মন্তব্য করেছেন।

উল্লেখ্য, চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙর এবং ওভারসাইড থেকে দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পণ্য পরিবহনের উপযোগী প্রায় ১৮শ’ লাইটারেজ জাহাজ রয়েছে। এরমধ্যে কিছু জাহাজ মেরামতসহ নানা কাজে ডক ইয়ার্ডে থাকে। বেশ কিছু জাহাজ সিরিয়ালের বাইরে গিয়ে ভাড়ায় চলে। আবার কিছু জাহাজ মোংলা এবং পায়রা বন্দরে চলে গেছে। এতে করে চট্টগ্রামে বর্তমানে যে জাহাজ রয়েছে সেগুলোর মধ্যে ভাসমান গুদামে পরিণত হওয়া জাহাজের সংখ্যা বাদ দিলে বাকি জাহাজ দিয়ে দেশের অভ্যন্তরীণ রুটে পণ্য পরিবহন সামাল দেয়া কঠিন বলেও সূত্র জানিয়েছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধজিন্নাহর ঘোষণায় দেশব্যাপী তীব্র প্রতিবাদের ঝড় বয়ে যায়
পরবর্তী নিবন্ধখুচরো পয়সা কেনা নিয়ে ক্রেতাদের মধ্যে এ মারামারি