ড. মইনুল ইসলামের কলাম

| বৃহস্পতিবার , ৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ at ৭:৪৭ পূর্বাহ্ণ

পতিত স্বৈরশাসক হাসিনা নানাবিধ খামখেয়ালী প্রকল্পে যথাযথ ‘ফিজিবিলিটি স্টাডি’ ছাড়া ‘সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট’ গ্রহণের কারণে বাংলাদেশ অতি দ্রুত ‘ঋণের সাগরে নিমজ্জমান দেশের কাতারে’ প্রবেশ করেছে। দৈনিক বণিক বার্তা ৫ ডিসেম্বর ২০২৩ তারিখে খবর প্রকাশ করেছিল যে ২০২৩ সালের নভেম্বরে বাংলাদেশের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ১০০ বিলিয়ন ডলার ছাড়িয়েছে। ২০১৫১৬ অর্থবছরের শেষে সরকারি ও বেসরকারি খাতের বৈদেশিক ঋণের পরিমাণ ছিল ৪১.১৭ বিলিয়ন ডলার। ঐ পর্যায়ে বিদেশী ঋণ ছিল জিডিপি’র ১৫.৫ শতাংশ। ঐ সময় বৈদেশিক ঋণের প্রবৃদ্ধির হার ছিল ৯.৭ শতাংশ। এরপর থেকে বিদেশী ঋণগ্রহণের প্রবৃদ্ধি হয়েছে উচ্চহারে। ২০২০২১ অর্থবছরে বৈদেশিক ঋণের প্রবৃদ্ধির হার বেড়ে ১৯ শতাংশ ছাড়িয়ে যায়, ২০২১২২ অর্থবছরেও বৈদেশিক ঋণের প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১৬.৯ শতাংশ। সরকারি ঋণের পাশাপাশি বেসরকারী খাতেও এরপর দ্রুত বিদেশী ঋণ বাড়তে থাকে, পাঁচ বছরে বেসরকারি খাতের ঋণ ১২.৮ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে ২০২২ সালের সেপ্টেম্বরে ২৫.৪০ বিলিয়ন ডলারে গিয়ে পৌঁছায়। খামখেয়ালিভাবে গৃহীত নানা প্রকল্পে পতিত স্বৈরশাসক হাসিনার ইচ্ছেমত বৈদেশিক ঋণ গ্রহণের হিড়িক তিন বছরের মধ্যেই বিদেশী ঋণকে ১০০ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে দিয়েছিল। ২০২৫ সাল থেকে এই খামখেয়ালিপনার খেসারত হিসেবে ঋণগুলোর সুদাসলে কিস্তি পরিশোধ শুরু হয়ে যাচ্ছে। ২০২৩২৪ অর্থবছরে ঋণের সুদ পরিশোধ খাতে বরাদ্দের প্রস্তাব রাখা হয়েছিল ৯৪,০০০ কোটি টাকা। শুধু বৈদেশিক ঋণের সুদাসলে কিস্তি পরিশোধ ২০২২২৩ অর্থবছরের ২.৭৪ বিলিয়ন ডলার থেকে বেড়ে আগামী ২০২৫২৬ অর্থবছরের বাজেটে ৪.৫ বিলিয়ন ডলারে পৌঁছে যাবে। বৈদেশিক ঋণ পরিশোধের এহেন উচ্চপ্রবৃদ্ধি ২০২৯ সাল পর্যন্ত বহাল থাকবে বলে প্রাক্কলন করা হয়েছে। আরো দুঃখজনক হলো, এসব ঋণের অর্থে প্রকল্পগুলোর বাস্তবায়ন যখন সম্পন্ন হচ্ছে তখন প্রকল্পগুলোর আয় থেকে ঋণের কিস্তির অতি সামান্য অংশ পরিশোধ করা সম্ভব হচ্ছে।

আওয়ামী লীগের অন্ধ সমর্থকদের মধ্যে একটা ধারণা বদ্ধমূল হয়ে গেড়ে রয়েছে যে শেখ হাসিনার সাড়ে পনেরো বছরের স্বৈরশাসনের মেয়াদকালে দেশের অর্থনীতি প্রশংসনীয় গতিতে প্রবৃদ্ধি অর্জন করেছে। কিন্তু, একজন নির্মোহ উন্নয়নগবেষক হিসেবে তাদেরকে বলতে চাই, আওয়ামী লীগের অর্থনৈতিক উন্নয়নের খেসারত হলো আঠারো লক্ষ কোটি টাকা ঋণের সাগরে জাতিকে ডুবিয়ে দিয়ে অর্থনৈতিক উন্নয়নের ভুয়া বয়ান সৃষ্টির পাশাপাশি বেলাগাম পুঁজিলুন্ঠন ও বিদেশে পুঁজি পাচারের এক অবিশ্বাস্য রেকর্ড সৃষ্টি। শেখ হাসিনার সময়ে যে অর্থনৈতিক উন্নয়ন অর্জিত হয়েছিল সেটা ছিল ঋণ করে ঘি খাওয়ার ক্লাসিক উদাহরণ, ঋণের সাগরে জাতিকে ডুবিয়ে দিয়ে হাসিনা জিডিপি প্রবৃদ্ধির হারকে কৃত্রিমভাবে বাড়িয়ে দিচ্ছিলেন। হাসিনা তাঁর স্বৈরাচারী শাসনামলে তাঁর পরিবার, আত্মীয়স্বজন, দলীয় নেতাকর্মী, কতিপয় অলিগার্কব্যবসায়ী এবং পুঁজিলুটেরাদেরকে সাথে নিয়ে সরকারী খাতের প্রকল্প থেকে যে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা লুন্ঠনের প্রাতিষ্ঠানিক ব্যবস্থা গড়ে তুলেছিলেন তার ভয়াবহ কাহিনী তাঁর পতনের পর উদ্‌ঘাটিত হতে শুরু করেছে। ৭ আগস্ট ২০২৪ তারিখে দৈনিক বণিক বার্তার হেডলাইনের খবরে প্রকাশিত তথ্যউপাত্তের দাবি অনুযায়ী ২০২৪ সালের ৫ আগস্ট তারিখে বাংলাদেশ সরকারের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের মোট ঋণের স্থিতি দাঁড়িয়েছে আঠারো লক্ষ পঁয়ত্রিশ হাজার কোটি টাকারও বেশি। অথচ, ২০০৯ সালের ৬ জানুয়ারি শেখ হাসিনা ক্ষমতাসীন হওয়ার দিনে বাংলাদেশ সরকারের অভ্যন্তরীণ ও বৈদেশিক ঋণের স্থিতি ছিল মাত্র দুই লক্ষ ছিয়াত্তর হাজার আট’শ ত্রিশ কোটি টাকা। এর মানে, এই দুই ঋণের স্থিতির অংকের পার্থক্য দাঁড়িয়েছে পনেরো লক্ষ আটান্নো হাজার দুই’শ ছয় কোটি টাকা। গত ৫ আগস্ট পালিয়ে যাওয়ার আগে হাসিনা এই সুবিশাল আঠারো লক্ষ পঁয়ত্রিশ হাজার কোটি টাকার ঋণের সাগরে দেশের জনগণকে নিমজ্জিত করে প্রতি বছর মাথাপিছু জিডিপি’র উচ্চপ্রবৃদ্ধি দেখিয়ে চলেছিলেন, যাকে বলা চলে ‘নিকৃষ্টতম শুভংকরের ফাঁকি’ ও জনগণের সাথে ভয়ানক প্রতারণা। ফলে, ২০২৫ সালের জানুয়ারিতে প্রতিজন বাংলাদেশীর মাথার ওপর এক লক্ষ টাকার বেশি ঋণ নিজেদের অজান্তেই চেপে বসে গেছে। কমপক্ষে আগামী এক দশক ধরে দেশের অর্থনীতি বিপর্যয়কর পরিস্থিতিতে ডুবে থাকবে এই বিশাল অংকের ঋণের সুদাসলে কিস্তি পরিশোধের দায় মেটানোর কারণে। হাসিনার শাসনামলে অর্থনৈতিক উন্নয়নকে ত্বরান্বিত করার অজুহাতে একের পর এক মেগাপ্রকল্প গ্রহণ ও বাস্তবায়নের পাশাপাশি সারা দেশে বেলাগামভাবে বাস্তবায়িত হয়েছে শত শত উন্নয়ন প্রকল্প। প্রতিটি মেগাপ্রকল্পে প্রকৃত ব্যয়ের তিনচার গুণ বেশি ব্যয় দেখানোর মাধ্যমে আত্মসাৎ করা হয়েছে লক্ষ লক্ষ কোটি টাকা, যেজন্য এসব প্রকল্পের ব্যয় ‘বিশ্বের সর্বোচ্চ’ পর্যায়ে পৌঁছে গেছে। গত সাড়ে পনেরো বছর ছিল দেশে দুর্নীতি ও পুঁজিলুন্ঠনের মহোৎসবকাল।

বিশ্ব ব্যাংক, আইএমএফ কিংবা এশীয় উন্নয়ন ব্যাংকের মত আন্তর্জাতিক ঋণদাতা সংস্থাগুলোর কাছ থেকে ‘সফট লোন’ পাওয়া গেলে বাংলাদেশের শাসকমহল সব সময় নিতে আগ্রহী ছিল, কিন্তু হাসিনা সরকারের বৈদেশিক ঋণের সিংহভাগই ছিল ‘সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট’। সাপ্লায়ার্স ক্রেডিটের অসুবিধে হলো যোগানদাতারা প্রকল্পের প্ল্যান্ট, যন্ত্রপাতি ও সরঞ্জাম ঋণ হিসেবে দেওয়ার সময় প্রতিযোগিতামূলক আন্তর্জাতিক বাজার দামের চাইতে অনেক বেশি দাম ধরে ঋণের পরিমাণকে বাড়িয়ে দেয়। উপরন্তু, সাপ্লায়ার্স ক্রেডিটের সুদের হারও সফট লোনের সুদের হারের চাইতে বেশি, ঋণ পরিশোধের সময়সীমাও কম থাকে। আরো গুরুতর হলো, সাপ্লায়ার্স ক্রেডিটে রাজনীতিবিদ, ঠিকাদার ব্যবসায়ী ও আমলাদের ‘মার্জিনের হার’ অনেক বেশি হয়ে থাকে। সেজন্য সাপ্লায়ার্স ক্রেডিটকে লুটপাটের অর্থনীতির সবচেয়ে বহুলব্যবহৃত মেকানিজম অভিহিত করা হয়। দুঃখজনকভাবে হাসিনা সরকারের আমলে বাংলাদেশে সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট শাসকমহলের দুর্নীতি ও পুঁজিলুন্ঠনের সবচেয়ে মারাত্মক হাতিয়ারে পরিণত হয়েছিল। সেজন্য বাংলাদেশের মেগাপ্রজেক্টগুলোর ব্যয় বিশ্বের মধ্যে সর্বাধিক হয়ে গিয়েছিল, কারণ এসব প্রকল্প থেকে পুঁজি লুন্ঠন আওয়ামী লীগের নেতা ও হাসিনার পৃষ্ঠপোষকতাপ্রাপ্ত ব্যবসায়ীদের সবচেয়ে লোভনীয় ধান্দায় পরিণত হয়েছিল। আন্তর্জাতিক ঋণদান সংস্থা বিশ্ব ব্যাংক ও এশীয় উন্নয়ন ব্যাংক থেকে ঋণ পেতে হলে যেহেতু তাদের অনেক কঠিন শর্তগুলো পরিপালনে শাসকরা জটিলতার সম্মুখীন হয় তাই বাংলাদেশে ২০১৪ সাল থেকে সাবেক সরকার প্রধানত সাপ্লায়ার্স ক্রেডিটের প্রতি অতিমাত্রায় ঝুঁকে পড়েছিল। বিশেষত, হাসিনা সরকারের শেষের সাত/আট বছর বেলাগামভাবে অনেকগুলো অত্যন্ত বাজে প্রকল্পে ঋণ গ্রহণে হাসিনার দৃষ্টিকটু আগ্রহ পরিলক্ষিত হয়েছিল। এসব প্রকল্প থেকে পুঁজিলুন্ঠনই যে প্রধান উদ্দেশ্য ছিল সেটা আন্দাজ করা যায়। চীন যেহেতু এখন তাদের ‘বেল্ট এন্ড রোড ইনিশিয়েটিভ’ বাস্তবায়নের লক্ষ্যে উন্নয়নশীল দেশগুলোকে উদারভাবে সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট দেওয়ার নীতি বাস্তবায়ন করছে তাই চীনের সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট পাওয়া অনেক সহজ হয়ে গেছে। বাংলাদেশ এপর্যন্ত চীন থেকে মোট ১,৮৫৪ কোটি ডলার ঋণ গ্রহণ করেছে। এর মধ্যে গত এগার বছরে বাংলাদেশ চীন থেকে সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট নিয়ে মোট ১২টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করেছে। চীনা সাপ্লায়ার্স ক্রেডিটে যেসব মেগাপ্রকল্প এদেশে বাস্তবায়িত হয়েছে বা বাস্তবায়নাধীন রয়েছে সেগুলো হলো পদ্মা সেতু হয়ে ঢাকাযশোরপায়রা রেলপথ প্রকল্প, কর্ণফুলী টানেল প্রকল্প এবং ঢাকাগাজীপুর বিআরটি প্রকল্প। জাপানের জাইকার সাপ্লায়ার্স ক্রেডিটে অর্থায়িত যেসব মেগাপ্রকল্প বাস্তবায়িত হয়েছে বা বাস্তবায়নাধীন রয়েছে সেগুলো হলো ঢাকা মেট্রোরেল প্রকল্প, মাতারবাড়ি গভীর সমুদ্র বন্দর, মাতারবাড়ি কয়লাচালিত বিদ্যুৎ প্রকল্প, ঢাকা শাহজালাল বিমান বন্দরের থার্ড টার্মিনাল, যমুনা রেলসেতু এবং চট্টগ্রাম আউটার রিং রোড। ঢাকাযশোর রেলপথ এবং ঢাকাগাজীপুর বিআরটি প্রকল্প নিঃসন্দেহে নিকৃষ্ট প্রকল্প। কিন্তু, বাংলাদেশের নিকৃষ্টতম ‘সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট প্রকল্প’ ১২ বিলিয়ন ডলার রাশিয়ান ঋণে নির্মীয়মাণ রূপপুর প্‌রমাণবিক বিদ্যুৎ প্রকল্প। এটি আক্ষরিকভাবেই ‘সাদা হাতি প্রকল্প’। দুই ইউনিটের এই বিদ্যুৎকেন্দ্রটি নির্মাণের প্রাক্কলিত ব্যয় হবে ১৩৫০ কোটি ডলার। ইউনিট দুটোর কাজ শেষ হতে সময় লাগবে ২০২৫ সাল পর্যন্ত। এই দুটো ইউনিট থেকে ২৪০০ মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদিত হবে বলে আশা করা হচ্ছে। প্রাক্কলিত নির্মাণ ব্যয় ১৩৫০ কোটি ডলারের মধ্যে ১২০০ কোটি ডলার ঋণ দিচ্ছে রাশিয়া, বাকি দেড়শ কোটি ডলার বাংলাদেশ ব্যয় করছে। রাশিয়ার ঋণের সুদের হার ৪ শতাংশ, যা ১০ বছরের গ্রেস পিরিয়ড সহ ২৮ বছরে বাংলাদেশকে সুদাসলে পরিশোধ করতে হবে। অনেকেরই জানা নেই যে মাত্র ৬ বিলিয়ন ডলার রাশিয়ান ঋণে ভারতের তামিলনাড়ুর কুদান কুলামে ২০০০ মেগাওয়াটের বিদ্যুৎ প্ল্যান্ট স্থাপিত হয়েছে কয়েক বছর আগে। অথচ, আমাদের ২৪০০ মেগাওয়াট ক্ষমতার বিদ্যুৎ প্ল্যান্টের জন্য ১২ বিলিয়ন ডলার রাশিয়ান ঋণ নিতে হলো কেন? এত বেশি ‘ইনফ্লেটেড প্রজেক্ট কস্ট’ হাসিনা সরকারের কর্তাব্যক্তিদের লুটপাটের সাক্ষ্য বহন করছে। ঢাকাযশোরপায়রা রেললাইন প্রকল্পের খরচ প্রায় চল্লিশ হাজার কোটি টাকা, যার মধ্যে একুশ হাজার কোটি টাকার বেশি চীনের সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট। কর্ণফুলী টানেলে খরচ হয়েছে ১০,৬৮৯ কোটি টাকা, যার মধ্যে ছয় হাজার কোটি টাকারও বেশি চীনের সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট। ঢাকাগাজীপুর বিআরটি প্রকল্পে খরচ হচ্ছে সাড়ে চার হাজার কোটি টাকা, যার পুরোটাই চীনের সাপ্লায়ার্স ক্রেডিট।

স্বল্পপ্রয়োজনীয় প্রকল্পে যথাযথ ফিজিবিলিটি স্টাডি ছাড়া খামখেয়ালিভাবে বিনিয়োগের হিড়িকের ব্যাপারে আমি আপত্তি জানানোয় সাবেক প্রধানমন্ত্রী হাসিনা ব্যঙ্গ করে আমাকে ‘অর্বাচীন অর্থনীতিবিদ’ আখ্যা দিয়েছিলেন। ২০২২ সালের মে মাসে জার্মান টিভি ডয়শে ভেলে আমাকে এব্যাপারে মন্তব্য করতে বলায় আমি বলেছিলাম,‘তিনি আমাকে অর্বাচীন অর্থনীতিবিদ বলছেন! তা তিনি বলতেই পারেন, কিন্তু আমি আমার অবস্থান বদলাবো না’। আমার এই সাবধান বাণীকে আমলে না নেয়ার ফলে ২০২১ সাল থেকে যে বৈদেশিক মুদ্রার রিজার্ভের দ্রুত পতনের ধারা আমাদের অর্থনীতিকে চরম টালমাটাল অবস্থায় নিয়ে গেছে তা সামাল দিতে পারেনি হাসিনা সরকার। দেশের রিজার্ভ ২০২১ সালের আগস্টে ৪৮ বিলিয়ন ডলার অতিক্রম করেছিল, ২০২৪ সালের প্রথমদিকে ‘নীট রিজার্ভ’ ১৬ বিলিয়ন ডলারেরও নিচে নেমে গিয়েছিল।

দেশের এক কোটি পঞ্চান্ন লাখ মানুষ বিদেশে কর্মরত থাকলেও তাঁদের অধিকাংশই হুন্ডি পদ্ধতিতে দেশে রেমিট্যান্স পাঠাচ্ছেন। দেশ থেকে বিদেশে অর্থ পাচারকারীরাই এই হুন্ডি ডলারের চাহিদাকে শক্তিশালী রাখছিল, যেজন্য দেশ থেকে বিদেশে পুঁজিপাচার হাসিনার শাসনামলে দেশের ‘এক নম্বর সমস্যায়’ পরিণত হয়েছিল। সংখ্যায় দেশ থেকে পুঁজিপাচারকারী হয়তো কয়েক হাজারের বেশি হবে না। বাংলাদেশী সমাজের উচ্চমধ্যবিত্ত, উচ্চবিত্তশালী ও ‘এলিট’ অংশে ছিল তাদের বেশিরভাগের অবস্থান। অর্থনৈতিক টানাপোড়েনের কারণে তারা দেশ থেকে বিদেশে অর্থ পাচার করতে বাধ্য হয়েছে বলা যাবে না। এদেশে তাদের সামাজিক, অর্থনৈতিক ও রাজনৈতিক ‘এলিট’ গোষ্ঠীর মধ্যে অবস্থান সত্ত্বেও আরো বেশি সুখশান্তির আশায় তারা দেশত্যাগে উদগ্রীব হচ্ছে। তাদের সংখ্যাগরিষ্ঠই দুর্নীতিবাজ আমলা, ব্যবসায়ীশিল্পপতি (উল্লেখযোগ্য সংখ্যক গার্মেন্টস মালিক), প্রকৌশলী ও রাজনৈতিক নেতা। তাদের বেশিরভাগের বৈশিষ্ট্যগত ‘কমন ফ্যাক্টর’ হলো তাদের সিংহভাগ ‘কালো টাকার মালিক’, ভাল মানের শহুরে সম্পত্তির মালিক কিংবা শিল্পকারখানাব্যবসায়ের মালিক হওয়ায় দেশের ব্যাংকঋণ পাওয়ার ক্ষমতা রাখে।

আমার সংবাদপত্রের কলামগুলোতে আমি তাদেরকে ‘জাতির এক নম্বর দুশমন’ আখ্যায়িত করে চলেছি। আমি যাদেরকে ‘জাতীয় দুশমন’ অভিহিত করছি তারা দেশের ব্যাংকিং সিস্টেমকে অপব্যবহার করে ব্যাংকঋণ নিয়ে তা বছরের পর বছর ফেরত না দিয়ে বিদেশে পাচার করেছে। তারা ব্যাংকগুলোর ‘ইচ্ছাকৃত ঋণখেলাপি’ হিসেবে ঋণলুটপাটকারীর ভূমিকা পালন করছে। তারা রাজনীতিক পরিচয়ে হাজার হাজার কোটি টাকা লুন্ঠন করে বিদেশে পালিয়ে যাওয়ার প্রক্রিয়ায় অংশগ্রহণকারী। তারা ৫৪ বছরের স্বাধীনতাউত্তর বাংলাদেশের ‘এক নম্বর সমস্যা’ দুর্নীতি ও পুঁজিলুন্ঠনের মাধ্যমে কালো টাকার মালিক হয়ে তাদের দুর্নীতিলব্ধ ও লুন্ঠনকৃত অর্থ মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, কানাডা, যুক্তরাজ্য, অস্ট্রেলিয়া, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া কিংবা দুবাইয়ে পাচার করেছে। এরাই কানাডার টরন্টোর বেগমপাড়া এবং মালয়েশিয়ার সেকেন্ড হোম বানাচ্ছে।

লেখক : সাবেক সভাপতি, বাংলাদেশ অর্থনীতি সমিতি,

একুশে পদকপ্রাপ্ত অর্থনীতিবিদ ও অবসরপ্রাপ্ত প্রফেসর,

অর্থনীতি বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়

পূর্ববর্তী নিবন্ধএনআইডিতে ভুল সংশোধন, হয়রানি ও ইসির করণীয়
পরবর্তী নিবন্ধচট্টগ্রাম একাডেমি-অধ্যাপক খালেদ শিশুসাহিত্য পুরস্কার ২০২৪ ঘোষণা