২০২৪ এর ৫ আগস্ট দেশে অভূতপূর্ব ঘটনা ঘটে গেছে। একটি সরকারের টানা পনেরো বছর শাসনকালের অবসান হয়েছে। ক্ষমতার পটপরিবর্তনের পর ছাত্র ও সাধারণ মানুষ রাষ্ট্র সংস্কার নিয়ে আলোচনা করছেন। অনেক প্রাজ্ঞ ও বিজ্ঞজনেরা রাষ্ট্র সংস্কারের জন্য বিভিন্ন পরিকল্পনা, প্রস্তাবনা ও পরামর্শ প্রদান করেছেন। পত্রপত্রিকা ও সোস্যাল মিডিয়ার বদৌলতে বিগত সরকারের সময়ে সীমাহীন দুর্নীতির খবর সামনে আসছে। আমরা জানি সব সরকারের সময়ে কমবেশি দুর্নীতি হয়েছে। দুর্নীতি কেন হয়েছে তার কারণ অনেক। দুর্নীতি রোধ করতে হলে দুর্নীতির উৎস সন্ধান করে সেই সব দুর্নীতির উৎসধারায় আঘাত আনতে হবে প্রথমে। সংস্কার সেখানেই করা প্রয়োজন।
আমাদের সমাজে ব্যাপক সংখ্যক লোক রয়েছে, যারা দেশের কল্যাণকর বিষয় ঘটলে আনন্দিত হয় না। আবার অকল্যাণকর বিষয়ে কিছু ঘটলেও বিমর্ষ হয় না। এসব লোকের মনের ওপর যথেষ্ট নিয়ন্ত্রণ রয়েছে। বুঝতে হবে এদের প্রজ্ঞা বা বুদ্ধি দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত। এদেরকে সংস্কারের প্রয়োজনে কাজে লাগাতে হবে।
দেশের অর্থনীতির উন্নয়ন ও ধারাবাহিকতাকে সংস্কারের জন্য অগ্রাধিকার ভিত্তিতে সামনে রাখা প্রয়োজন। অর্থনৈতিকতে উন্নয়নের জন্য দেশের শিল্প–কারখানা সচল রাখা জরুরি এবং শিল্প বিনিয়োগকে উৎসাহিত করার জন্য প্রয়োজন ব্যাপক সংস্কার। অপরিকল্পিত প্রকল্পের কারণে অনেক সময় বিনিয়োগ হুমকির মধ্যে পড়ে যায়। সরকারের বিভিন্ন মহল হতে উদ্যোক্তাদেরকে শুরুতে শিল্প গড়ার জন্য অনেক অনেক উৎসাহব্যঞ্জক প্রতিশ্রুতি দেওয়া হয়। শুনানো হয় নানা প্রণোদনা ও করছাড়ের আশার বাণী। চাওয়া মাত্রই বিদ্যুৎ, গ্যাস ও পানি সহ সকল ইউটিলিটি দেওয়ার প্রতিশ্রুতি।
উদ্যোক্তাদের প্রতিশ্রুতি বন্যায় ভাসিয়ে দিয়ে মাঠে নামিয়ে সেবার বদলে শুধু্ই হয়রানি ও দীর্ঘসুত্রিতা। কাজ করতে গিয়ে লাল ফিতার দৌরাত্ম্য আর আমলাতান্ত্রিক জটিলতায় উদ্যোক্তাদের শিল্প গড়ার উচ্ছ্বাসে জল ঢেলে দেওয়া হয়। উচ্চ সুদে ব্যাংক ঋণ নিয়ে যখন মাঝখানে আটকে যায়। চালু হয় না শিল্প, তখন ব্যাংক থেকে নেওয়া ঋণের কিস্তি পরিশোধের জন্য দেওয়া হয় চাপ। এক পর্যায়ে ঋণখেলাপির তকমা। এভাবে অনেক উদ্যোক্তা শিল্প না করেই এখন ঋণখেলাপি হওয়ার খাতায় নাম লিখিয়েছে। অথচ এতে উদ্যোক্তাদের কোনো হাত নেই। দেশের বিভিন্ন স্থানের উদ্যোক্তারা এ সমস্যায় লোকসানের ভারে ন্যূজ হওয়ার উপক্রম। সবচেয়ে বেশি ক্ষতির মুখে পড়তে হচ্ছে। সরকারি–বেসরকারি উভয় ধরণের বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলের শিল্পোদ্যোক্তাদের। তারা না পাচ্ছেন গ্যাস, বিদ্যুৎ ও পানির মতো ইউটিলিটি সুবিধা, না পাচ্ছেন শিল্প চালুর সুযোগ। এ পরিস্থিতিতে ৭/৮ বছর ধরে জমি ইজারা নিয়েও বিনিয়োগে আসেননি বহু দেশি–বিদেশি কোম্পানি।
বিগত সরকার বিনিয়োগকারীদেরকে বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চল এবং সরকারি ও বেসরকারি শিল্পাঞ্চলগুলোতে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে গ্যাস সংযোগ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও মাসের পর মাস বছরের পর বছর আমলাতান্ত্রিক নানা জটিলতায় সব আটকে আছে। গ্যাসের অভাবে উৎপাদনে যেতে পারেনি অনেক প্রতিষ্ঠান। ফলে চালু হওয়ার আগেই রুগ্ন শিল্পে পরিণত হয়েছে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো। বর্তমান সময়ে পুনরায় প্রজ্ঞাপনের মাধ্যমে সকল শ্রেণির গ্যাস সংযোগ বন্ধ করে দেয়া হয়েছে।
সম্প্রতি খেলাপি ঋণের অঙ্ক হু হু করে বাড়ছে। বলা হচ্ছে বর্ণিত বিষয়াদি খেলাপি বাড়ার অন্যতম প্রধান কারণ। ব্যবসায়ীদের পক্ষ হতে বলা হচ্ছে, দেশে বর্তমানে উচ্চ মুদ্রাস্ফীতির কারণে সব প্রতিষ্ঠানের বিক্রি কমেছে। ঋণের উচ্চ সুদহার, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের মূল্য বৃদ্ধি সব কিছু মিলিয়ে কোনো প্রতিষ্ঠান তার পূর্ণ ক্ষমতায় চলতে পারছে না। বর্তমান পরিস্থিতিতে শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো টিকে থাকাই এখন বড় চ্যালেঞ্জ। এসব কারণে ইচ্ছাকৃত খেলাপির বাইরেও এখন বিদ্যমান অর্থনৈতিক পরিস্থিতির কারণে ব্যাংকে ঋণখেলাপি হয়ে পড়েছেন অনেক ভালো ভালো গ্রাহক। বর্তমান নীতিমালা অনুযায়ী কোনো গ্রাহক ছয় মাস কিস্তি দিতে না পারলে তাঁকে খেলাপি হিসেবে চিহ্নিত করা হয়। কিন্তু প্রকৃত অবস্থা হলো ব্যবসায় মন্দার কারণে ঠিকমতো উৎপাদনে যেতে পারছে না বহু শিল্প। আর যাঁরা নতুন শিল্প করেও চালু করতে পারছে না তাঁরাও অনিচ্ছাকৃত লোকসানের মুখে। ব্যাংক হতে ঋণ নেওয়ার ফলে ব্যাংকের চাপ আছে, অথচ চালু না করায় উৎপাদন না হওয়ায় কোনো আয় নেই, অথচ হতে যাচ্ছে ঋণ খেলাপি। উদ্যোক্তাদের পক্ষ হতে জানা গেছে তাঁরা সরকারের মধুর মধুর প্রলোভনে পড়ে শিল্পে বিনিয়োগ করে এখন রীতিমতো মহাসংকটের মধ্যে আছে।
সরকারের উচিত অবিলম্বে আবেদনকৃত সকলকে গ্যাস সংযোগ সহ সকল ধরনের সেবা দিয়ে শিল্প কারখানা চালুর ব্যবস্থা করে দেওয়া। পাশাপাশি বাস্তবতা বিবেচনা করে ঋণখেলাপি থেকে রক্ষা করতে নীতিমালা প্রণয়ন করে ব্যবসা করার সুযোগ করে দেওয়া। সিপিডি এর সম্মানীত ফেলো ড. মোস্তাফিজুর রহমানের মতে, ‘যে সব অর্থনৈতিক অঞ্চল ও শিল্পাঞ্চলে শিল্প স্থাপন করা হয়েছে। সেহেতু শিল্পগুলো চালু করতে পানি, বিদ্যুৎ ও গ্যাসের ব্যবস্থা করে দ্রুততম সময়ে শিল্প চালু করার জন্য যে সব সেবা প্রয়োজন সেগুলো দ্রুত দেওয়ার ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি। শিল্প প্রতিষ্ঠানগুলো চালু হলে যেমন কর্মসংস্থান হবে তেমনি পণ্য বিদেশে রপ্তানি করা যাবে। অর্থনীতিতেও এর সুফল পাওয়া যাবে।’
বেজার আইনে আনোয়ারায় স্থাপিত সর্ববৃহৎ বেসরকারি বিনিয়োগে প্রতিষ্ঠিত কোরিয়ান ইপিজেড বেজার আইনে চলার নির্দেশনা থাকলেও সেখানে গ্যাস সংযোগ পেতে নিত্য হয়রানির শিকার হতে হচ্ছে। হয়রানিমুক্তভাবে দ্রুততম সময়ে সেখানে গ্যাসের ব্যবস্থা গ্রহণ জরুরি। সরকার যেখানে শিল্প প্রতিষ্ঠান সমূহে সামান্য পরিমাণ গ্যাস সংযোগ দিতে পারছে না সেখানে ইউনাইটেড পাওয়ারের ন্যায় বৃহৎ পরিসরে বিদ্যুৎ উৎপাদনের জন্য ২০০ এমএমসি এফডি গ্যাস সরবরাহ করার পায়তারা করছে। যা বিগত সরকারের পেতাত্মা এদের মাঝে ভর করেছে বলে মনে করছেন বিশেষজ্ঞ মহল। দেশের বৃহত্তর স্বার্থে শিল্প কারখানায় গ্যাস সরবরাহ করে শিল্প কারখানা স্থাপনে উৎসাহিত করা প্রয়োজন। শিল্প কারখানা পর্যায়ে বিদ্যুৎ উৎপাদনে সরকারের বিনিয়োগ কম থাকে এবং কর্মসংস্থান বেশি হয়। এতে দেশের অর্থনীতির প্রবৃদ্ধির হার যেভাবে বাড়বে তেমনি দেশি–বিদেশি বিনিয়োগকারিরা আকৃষ্ট হবে এবং বেশি পরিমাণে কর্মসংস্থান সৃষ্টি হবে। আমাদের দেশে ১৭ কোটি মানুষ যদি যথেষ্ট পরিমাণে খাওয়া–দাওয়া করতে পারে, চাকরির সুবিধা নিশ্চিত হয় এবং শিক্ষা ও সর্বসুবিধাযুক্ত বাড়িতে বসবাস করতে পারে তবে তা হবে সরকারের একটা চমৎকার উন্নতির উদাহরণ। এতে জীবনযাত্রার সুফল বয়ে আনবে এবং প্রণয়নকৃত সংস্কার চক্ষুস্মান হবে।
লেখক: প্রাবন্ধিক, সম্পাদক–শিল্পশৈলী।