আমার জন্মদিনটা পরিবারের সদস্যরা একান্ত ঘরোয়াভাবে পালন করলেও এতে উৎসাহের কোনো কমতি থাকে না। তারা ‘হ্যাপি বার্থ ডে’ বলে কেক কাটে। আমি তাদের বললাম এবার তোমরা ‘ধুঁই পিঠা’ কেটো। কেক মানে তো পিঠাই। পঁচা ডিমের তৈরি কেকের চাইতে বিশুদ্ধ আর পুষ্টিকর ‘ধুঁই পিঠা’ খাওয়াই উচিত। আমার পুত্রবধু এবং নাতনি অনেক কষ্ট করে বড় আকারের একটা ধুঁই পিঠা তৈরি করলো। আমরা সবাই মহা আনন্দে সেই পিঠা কেটে একে অপরের মুখে তুলে ধরলাম। এটা স্মরণীয় করে রাখবার জন্য সবাই স্মার্ট ফোনে ছবি তুললো। আমি ইতিহাসের অংশ হয়ে গেলাম। আমি ঘরের পোষা কুকুরটাকে গরম ধুঁই পিঠা খেতে দিলে সে আর্তনাদ করে উঠলো। পরে ঠান্ডা পিঠা দিলাম। সে ভয়ে এটা খেলো না। কাক গরম ধুঁই পিঠা খেলেও তা সে আবর্জনার মধ্যে ফেলে আরো নোংরা করে তুলে। সবাই বলে কাক হলো মেথর, সে নোংরা জায়গাকে পরিচ্ছন্ন করে। এখন দেখছি কথাটা শতভাগ সত্য নয়। এখন মেথর হয়েছে ‘সুইপার’। মেথরপট্টি হয়েছে ‘সেবক পল্লী’। শৈশবে একবার আমি এক মেথরকে কলা আর বিস্কুট খেতে দিয়েছিলাম। সে চমকে উঠে বলেছিলো আমরা অপবিত্র মানুষ। খেলে তোমার অকল্যাণ হবে। এ নগরীকে পবিত্র করতে তাদের চেষ্টার অন্ত নেই। আমরা শিক্ষিত–অশিক্ষিত সবাই স্বাচ্ছন্দ্যে পলিথিন ব্যাগ নর্দমায় ফেলি। কলার চোকলা ফেলি রাস্তায়। এতে কেউ কেউ পা পিছলে পড়ে কোমর এবং হাঁটু ভাঙ্গে। এই হলো আমদের সুনাগরিক হওয়ার নমুনা। মুক্তিযুদ্ধের সময় আমরা সবাই গ্রামে এসে আশ্রয় নিয়েছিলাম। আমি ধুঁই পিঠা ভক্ত বলে মা আমাকে গরম গরম ধুঁই পিঠা বানিয়ে খাওয়াচ্ছিলেন। হঠাৎ খান সেনারা ঢুকে পড়লো। অন্যান্যরা আগেই টের পেয়ে পালিয়ে গিয়েছিলো। আমি আর মা পারলাম না। খান সেনাদের একজন আমাকে ‘ধুঁই পিঠা’ খেতে দেখে সেও একটা খেতে নিয়ে বললো ‘বহুত্্ আচ্ছা’। অন্যান্যরাও খেলো। সবাই বললো ‘বহুত আচ্ছা’। ‘সব কুচ ঠিক হ্যায়’ বলে খুশি মনে ওরা ঘর হতে বের হয়ে গেলো। ধুঁই পিঠার কারণেই বেঁচে গেলাম। সেসময় গ্রামের মেয়েরা পুরুষের সামনে আসতে লজ্জা পেতো। এক আত্মীয়’র বাড়িতে বেড়াতে গেছি। কিছুক্ষণ পরে দেখি একটি লাজুক মেয়ে গরম গরম ধুঁই পিঠা নিয়ে আসলো। ধুঁই পিঠার জন্য মেয়েটিকে ভালো লাগলো। শহর হতে গ্রামে আসলেই ওদের বাড়িতে যেতাম। ভালো লাগাটা পরিণত হলো ভালোবাসায়। আমি চলে আসবার সময় শুধু বলতো পিঠা খেতে আসবেন কিন্তু। তার চোখের দিকে তাকিয়ে বুঝতে পারতাম সেও আমাকে ভালোবাসে।
অতএব, ধুঁই পিঠাকে ভালোবাসুন। জীবনকে ভালোবাসতে পারবেন। আসুন আমরা সবাই গরম গরম ধুঁই পিঠা খেয়ে সঞ্জীবিত হই।