সূফী সাধক হযরত শাহজাহান শাহ (রহ.)

ড. মোহাম্মদ জাফর উল্লাহ | সোমবার , ৩ ফেব্রুয়ারি, ২০২৫ at ৭:০১ পূর্বাহ্ণ

অসংখ্য ওলি যাঁরা অক্লান্তর পরিশ্রমের মাধ্যমে বাংলায় ইসলামের অমীয় বাণী প্রচার করেছেন তাঁদের মধ্যে অন্যতম হলেন হযরত শাহ জাহান (রহ.)। হযরত শাহ জাহান শাহ (রহ.) হলেন এক মহান আল্লাহর ওলি যিনি এতদঞ্চলে ইসলাম প্রচারের জন্য সুদূর আরব থেকে আগমন করেছেন। কাশফুল কুবুর নামক আধ্যাত্মিক ধ্যান মারফতে জানা গেছে যে, তিনি একজন কুতুবুল ইরশাদ স্তরের ওলি ছিলেন। যা গাউছুল আযম সৈয়দ গোলামুর রহমান (.) এর বাণী থেকে প্রমাণিত হয়েছে।

ইতিহাস পর্যালোচনায় জানা যায় যে, অষ্টম শতকে আরব বণিকরা জলপথে চট্টগ্রামে এসে বসতি স্থাপন শুরু করে। বণিকদের সাথে সুফি দরবেশের আগমনও এ সময়কাল থেকে লক্ষ্য করা যায়। ইসলাম প্রচার ও মুসলিম সংস্কৃতি প্রতিষ্ঠায় এদের ব্যাপক ভূমিকা রয়েছে। চট্টগ্রামের বিভিন্ন অঞ্চল যথা, সুলুক বহর, হালিশহর, আলকরণ ইত্যাদি আরবি নামে নামকরণও এর অন্যতম কারণ।

উল্লেখ্য, খ্রিস্টীয় ত্রয়োদশ শতাব্দীর গোড়ার দিকে ইখতিয়ার উদ্দীন মোহাম্মদ বখতিয়ার খলজীর সেনাপতি কদল খাঁ গাজী কর্তৃক চট্টগ্রাম মুসলমানদের দখলে আসে। এ ধারাবাহিকতায় মুসলমানদের আদিপত্য হোসেন শাহী আমল পর্যন্ত বজায় থাকে ইতিহাস থেকে জানা যায়। তবে কিছুকাল চট্টগ্রাম আরাকান রাজ্যের অধীনে চলে গেলেও এতদঞ্চলে সূফিসাদকের কারণে মুসলমানদের প্রভাব কমে যায়নি। এ সময় বিভিন্ন দেশ থেকে এ দেশে মুসলমানদের আগমন বৃদ্ধি পেতে থাকে। বিখ্যাত পরিব্রাজক ইবনে বাতুতার বিবরণেও দেখা যায় যে, বাংলাদেশে মুসলমান সূফীদের বেশ আনাগোনা হয়। ইবনে বাতুতা ১৩৪৬৪৭খ্‌্ির. এর দিকে চট্টগ্রাম বন্দরে আগমন করেন এবং সেখান থেকে সিলেট গিয়ে শাহ জালালের সাথে সাক্ষাৎ করেন। তিনি বলেন যে, সুলতান ফখরুদ্দীন মোবারক শাহ সূফীদের অত্যন্ত ভক্তি করতেন এবং তিনি সূফীদের থেকে পথকর বা নৌকা ভাড়াও মওকুফ করেন। তবে ৮ম৯ম শতাব্দীর দিকে চট্টগ্রামে মুসলমানদের আগমন শুরু হলেও চতুর্দশ শতাব্দীতে চট্টগ্রামে ইসলাম প্রচার জোরদার হয়। পঞ্চদশ শতকের প্রথম দিকে চট্টগ্রামে যে মুসলমান আধিপত্য পুরোপুরি বজায় ছিল ইতিহাসে তার অনেক প্রমাণ পাওয়া যায়। ফখরুদ্দীন মোবারক শাহ’র চট্টগ্রাম অভিযানের উপর ভিত্তি করে চতুর্দ্দশ ও পঞ্চদশ শতকে চট্টগ্রামে বহু সূফী সাধকের আগমন ঘটে। তাঁদের মধ্যে একজন উচ্চমার্গের অলি ও সূফী সাধক হযরত শাহজাহান শাহও ছিলেন। এভাবে সূফীগণের আগমনে ফলে চট্টগ্রামে ইসলাম ধর্মের গোড়াপত্তন ঘটে।

অবশ্য ফখরুদ্দীনের চট্টগ্রাম বিজয়ের (১৩৪০ খ্রিঃ) পরবর্তী তিন শতাব্দী যাবত চট্টগ্রামের উপর রাজনৈতিক কর্তৃত্ব নিয়ে, ত্রিপুরার হিন্দু রাজা, আরাকানের বৌদ্ধরাজা এবং তার পাশাপাশি বিদেশী পর্তুগজি ঔপনিবেশিক শক্তির সাথে বাংলার মুসলিম সুলতানদের লড়াই অব্যাহত থাকে। ১৪০৬ খ্রিষ্টাব্দে আরাকানের রাজা ছিলেন সেং সোয়ামন। চট্টগ্রাম তখন তাঁরই অধিকারে। তিনি বর্মী রাজার হাতে পরাজিত হয়ে বাংলায় আশ্রয় নেন। বাংলায় তখন রাজা গণেশের পুত্র যদু ইসলাম গ্রহণ করে জালালউদ্দীন নাম ধারণ করে শাসন করছিলেন। প্রায় ২৪ বছর রাজ্যহারা আরাকান রাজা চট্টগ্রামে অবস্থান করেন। পরে সুলতান জালালউদ্দীনের সহায়তায় রাজ্যহারা আরাকান রাজা আবার তাঁর সিংহাসন ফিরে পান। এই সাহায্যের কৃতজ্ঞতা স্বরূপ আরাকান রাজার পৃষ্ঠপোষকতায় বিভিন্ন মুসলিম সূফীসাধকেরা চট্টগ্রামে ধর্ম প্রচারের সুযোগ পান।

খ্রিষ্টীয় পঞ্চদশ শতকের গোড়ার দিকে আরাকান রাজা কর্তৃক চট্টগ্রাম দখলের এ সময়কালের সাথে হযরত শাহজাহান শাহ’র (রহ.) চট্টগ্রাম আগমনের সময়কালটি অনেকটাই সমসাময়িক বলে মনে হয়। কারণ ধলই দরবার শরীফের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়এই মাযার শরীফ সংস্কারের বিষয়টি নিয়ে ধলই দরবার শরীফ কমপ্লেক্সের সেক্রেটারী মাওলানা মুহাম্মদ নুরুল আলম চৌধরী উল্লেখ করেছেনআমাদের পূর্বপুরুষগণ মাজার শরীফ প্রশস্ত ও মেরামত করার সময় একটি শিলালিপি পেয়েছিলেন। শিলালিপি পর্যালোচনা করে তাঁর ওফাত দিবস নির্ধারণ করা হয়।

মাযার শরীফ সংস্কারের সময় সেখানে যে শিলালিপিটি পাওয়া যায় তাতে মগী ভাষায় সনতারিখ লিখা ছিল। আরো উল্লেখ্য, উক্ত সংস্কারের কাজের সময় মাযার সন্নিহিত অপর একটি কবরের কিছু মাটি খুঁড়া হয়ে যায়। এতে কবরের অভ্যন্তরে একজন সদ্য সমাহিত লাশের মত ধবধবে সাদা কাফন ও একটা ‘আসা’ বা লাঠি দেখা যায়। এগুলো থেকে সুগন্ধি বের হতে থাকে বলে নির্ভরযোগ্য সূত্রে জানা যায়। এই কবরটিও এই মহান অলি হযরত শাহ জাহান শাহ (রহ.)এর কোন এক বুজুর্গ খাদেমের কবর হিসেবে চিহ্নিত হয়। এই সময় মাযারে যে ইট পাওয়া যায়, তা ১৪২০ ঈসায়ী সনের তৈরী বলে মাযার কর্তৃপক্ষ সূত্রে প্রকাশ। ইতিহাসের পাতা বেয়ে চট্টগ্রামের সমসামায়িক ধর্মীয় অবস্থার প্রতি দৃষ্টিপাত করলে দেখা যায়তখন এখানে মগরাজ্য ছিল। স্থানীয় অধিবাসীগণ ছিল মগ। তাদেরকে তিনি (হযরত শাহজাহান শাহ) ইসলামের সুশীতল পরশ ও আধ্যাত্মিক ক্ষমতা বলে বিনা যুদ্ধে আল্লাহর মনোনীত পবিত্র ধর্ম ইসলামে দীক্ষিত করতে সক্ষম হয়েছেন।

হযরত শাহজাহান শাহ এতদঞ্চলে ইসলাম প্রসার ও প্রচারের ক্ষেত্রে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখেন। তিনি মানব কল্যাণেও যথেষ্ট অবদান রাখেন। তাঁর আদি নাম জানি শাহ বলেও কোন কোন মহলে জনশ্রুতি আছে। তিনি আরব থেকে প্রথমে লাহোর এবং পরে দিল্লী ও গৌড় হয়ে জলপথে চট্টগ্রাম জেলার সাতকানিয়া থানার ইল্লা নামক স্থানে অবরতণ করেন। কিছুকাল পর তিনি হাটহাজারী থানার ধলই নামক গ্রামে মোগল খিল বা মোগলের কেল্লা নামক স্থানে আস্তানা স্থাপন করেন। আধ্যাত্মিক সাধনা বলে তিনি মারেফাতের সর্বোচ্চ মকামে পৌঁছতে সক্ষম হন যা কুতুবুল আকতাব হযরত সৈয়দ গোলামুর রহমান মাইজভাণ্ডারী ও বিশ্ব ওলি হযরত সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারী (.) জবানে বর্ণিত হয়েছে। জনশ্রুতি আছে যে, হিংস্র বাঘও তাঁর অনুগত ছিলো। হযরতের ওফাতের পরও অসংখ্য বাঘ মাজারে এসে শ্রদ্ধা নিবেদন করতে অসংখ্য মানুষ দেখেছেন। হযরত শাহজাহান শাহ (রহ.) থেকে এখনো মানুষ উপকৃত হচ্ছে, ভবিষ্যতে হবে ইনশাল্লাহ।

হযরত শাহজাহান শাহ একজন মহান মানব প্রেমিক ও জ্যোতির্ময় মহাপুরুষ। তাঁর প্রেমজ ও কল্যাণকামী শিক্ষা ও আদর্শের অনুসরণে তাঁর মাজার শরিফ প্রাঙ্গণে গড়ে উঠেছে জনকল্যাণমূলক অবকাঠামো। আজ দিবারাত কোলাহল মুখর হযরত শাহজাহান শাহ (রহ.) এর মাজার শরিফ। বিভিন্ন নামে মানবতার কর্মযজ্ঞে মুখর পুরো ধলই এলাকা। ধলই ফার্সি শব্দ এর অর্থ সেনাপতি। মোগল আমলে সেনাপতি থাকতো বলেই এ এলাকার নামকরণ ধলই হয়। বর্তমানে মোগল সেনাপতি না থাকলেও প্রকৃত সেনাপতির মতই উজ্জ্বল হয়ে আছে, বার বা বহু আউলিয়ার অন্যতম অলি হযরত শাহজাহান শাহ (রহ.)

একজন মহাপুরুষের আবির্ভাবে জগত ও জীবন আলোকিত হয়। সকল প্রকারের গোঁড়ামি ও কুসংস্কার থেকে মানুষ মুক্ত হয়। জগদ্বাসীর কল্যাণের জন্যই মহাপুুরুষের আগমন হয়। হযরত শাহজাহান শাহ (রহ.) এমনি একজন মহাপুরুষ তিনি আমাদের জন্য রেখে গেছেন তাঁর অমূল্য শিক্ষা। এ শিক্ষা হলো মানবতার শিক্ষা। প্রকৃত প্রস্তাবে ধর্ম সমাজ ও সভ্যতা এবং এ সবের অগ্রগতি হচ্ছে মহাপুরুষদের সাধনা, ত্যাগ ও কষ্টের ফসল।

বর্তমান হুজরা শরিফে তিনি ১৫০৫ খ্রষ্টাব্দের ২০ মাঘ ওফাত প্রাপ্ত হন। তাঁর ওফাত বার্ষিকীতে আমাদেরকে শপথ নিতে হবে যেন আমরা ওলিগণের আদর্শে আমাদের জীবন গড়তে পারি। শপথ নিতে পারি ইসলামের সার্বজনীন অসম্প্রদায়িক ও মানবতাকামী আদর্শকে জীবনের সর্বস্তরে অনুশীলন করার। আল্লাহ তাআলার নিকট ফরিয়াদ আমরা যেন, তাঁর প্রিয় বান্দাদের আদর্শ অনুসরণের মাধ্যমে হযরত শাহ জাহনা শাহ (রহ.) এর ওরস শরীফকে সার্থক করতে পারি। আল্লাহ তাআলার ওলিগণ প্রেম, মানবতা ও শান্তির দূত তাঁদের রেখে যাওয়া আদর্শ অনুসরণ করে ধর্মান্ধতা পরিহার করে উদার মানবিকতা দিয়ে জয় করতে পারি মানুষের হৃদয় ও মন। এভাবে সম্ভব হবে ইসলামের সত্যিকার খেদমত। এভাবে সার্থক হবে হযরত শাহ জাহান শাহ (রহ.) এর স্মরণ উপলক্ষে বিশাল আয়োজন ওরস শরীফ।

লেখক : অধ্যাপক, আরবী বিভাগ, চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয়।

পূর্ববর্তী নিবন্ধট্রাম্পের চোখে বিশ্ব
পরবর্তী নিবন্ধডিপসিক বনাম চ্যাটজিপিটি এবং জেমিনি, চীনা আধিপত্য : বাংলাদেশ প্রেক্ষাপট