দেশে আলুর বাম্পার ফলনে কৃষকের কপালে ভাঁজ পড়তে শুরু করেছে। একদিকে বাড়তি ফলন, অন্যদিকে রপ্তানির পরিমাণ কমে যাওয়া এবং সংরক্ষণ সুবিধা পর্যাপ্ত না হওয়ায় কৃষকদের দিশেহারা হওয়ার উপক্রম হয়েছে। উৎপাদিত আলু সংরক্ষণ সুবিধার পাশাপাশি রপ্তানি বাজার সম্প্রসারণের ওপর গুরুত্বারোপ করে সূত্র বলেছে, সরকার বিশেষভাবে উদ্যোগ না নিলে কৃষকদের হতাশা গ্রাস করবে।
আলু দেশের কৃষির অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ অর্থকরী ফসল। দেশের খাদ্য নিরাপত্তা ও অর্থনীতিতে আলু যুগ যুগ ধরে উল্লেখযোগ্য ভূমিকা রেখে আসছে। একসময় ভারত থেকে দেশে প্রচুর আলু আমদানি করতে হতো। কিন্তু দেশের কৃষি বিজ্ঞানীদের নিরলস চেষ্টা এবং কৃষকদের আগ্রহে দেশ শুধু আলুতে স্বয়ংসম্পূর্ণ নয়, একইসাথে আলু রপ্তানিকারক দেশ হিসেবেও বাংলাদেশের আত্মপ্রকাশ ঘটে। কিন্তু বিদেশে বাজার সম্প্রসারণে যথাযথ পৃষ্ঠপোষকতা এবং প্রয়োজনীয় সুযোগ–সুবিধার অভাবে দেশে উৎপাদিত আলু নিয়ে কৃষকেরা বেকায়দায় পড়ছেন। অথচ বিশ্বে আলুর সম্ভাবনাময় একটি বাজার রয়েছে। এই বাজার ঠিকভাবে ধরা সম্ভব হলে দেশের কৃষি খাতের চেহারা পাল্টে যাবে।
সূত্রে জানা যায়, বর্তমানে দেশে বছরে ৮৫ থেকে ৯০ লাখ টন আলুর চাহিদা রয়েছে। অথচ গত বছর দেশে আলু উৎপাদিত হয় ১ কোটি ১০ লাখ টনের বেশি। উদ্বৃত্ত আলুর একটি অংশ বিদেশে রপ্তানি করা হয়েছিল। দেশেও কৃষকেরা আলুর ভালো দাম পেয়েছিলেন। চলতি মৌসুমে দেশে আলুর ফলন আরো ভালো হয়েছে। সরকারের কৃষি বিভাগ এবং কৃষকেরা আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন, এবার সোয়া কোটি টনের বেশি আলু উৎপাদিত হবে। কিন্তু চাহিদার চেয়ে ৩০ থেকে ৩৫ লাখ টন বাড়তি আলু নিয়ে কৃষকেরা চোখে–মুখে অন্ধকার দেখছেন।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বিদেশে আলু রপ্তানি বাড়াতে পারলে এই সংকট ঘুচানো সম্ভব হতো। কিন্তু আলু রপ্তানির বাজার ক্রমে সংকোচিত হচ্ছে। বাংলাদেশ মালয়েশিয়া, সিঙ্গাপুর, শ্রীলঙ্কা, সংযুক্ত আরব আমিরাত, মালদ্বীপ, সৌদি আরব, কাতার, বাহরাইন, ভিয়েতনাম ও ব্রুনাইসহ বিভিন্ন দেশে আলু রপ্তানি শুরু করেছিল। ২০২১–২২ অর্থবছরে চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে ৫৪ হাজার ৫৯৭ টন আলু রপ্তানি হয়। পরের বছর ২০২২–২৩ অর্থবছরে তা কমে ২৯ হাজার ৫৬০ টনে নেমে আসে। গত অর্থবছরে (২০২৩–২৪) তা আরো কমে যায়। গত অর্থবছরে মাত্র ১১ হাজার ১২৭ টন আলু চট্টগ্রাম বন্দর দিয়ে বিদেশে পাঠানো হয়।
বিশ্বে আলুর চাহিদা প্রতি বছর বাড়ছে। বিশ্বের শীর্ষস্থানীয় রপ্তানিকারক দেশগুলো হাজার হাজার কোটি টাকার আলু রপ্তানি করে। বাংলাদেশের সামনে সেই অপার সম্ভাবনা থাকলেও বিদেশে বাজার সৃষ্টি করতে না পারায় আলু রপ্তানির পরিমাণ কমে গেছে। বিদেশের বাংলাদেশ দূতাবাসগুলো আলুসহ সবজির বাজার সৃষ্টিতে বড় ভূমিকা রাখতে পারে মন্তব্য করে সূত্র বলেছে, প্রবাসী বাংলাদেশিদের নিকট দেশীয় আলুর কদর আলাদা। তারা দেশের আলু কিনতে চান। কিন্তু দেশীয় আলু পাওয়া না যাওয়ায় তারা অন্যান্য দেশ থেকে যাওয়া আলু কিনে থাকেন। এক্ষেত্রে রপ্তানি বাড়ানোর জন্য সরকারই উদ্যোগ নিতে পারে।
দেশে আলু সংরক্ষণের সুযোগ–সুবিধা সীমিত উল্লেখ করে সূত্র বলেছে, দেশে মোট ২৮ দশমিক ১০ লাখ মেট্রিক টন আলু হিমাঘারে সংরক্ষণের সুবিধা রয়েছে। এতে প্রচুর খরচ হয়। সময়ভেদে এক বস্তা আলু সংরক্ষণ করতে ৫০ থেকে ৩০০ টাকা পর্যন্ত খরচ হয়। যা ভোক্তা পর্যায়ে প্রভাব ফেলে। আলু সংরক্ষণের সুবিধা বাড়ানোর একটি প্রকল্প গ্রহণ করা হলেও তাতে বেশি সফলতা আসেনি। কৃষকেরা হিমাঘারের পাশাপাশি নিজেদের বাড়িতে আলু সংরক্ষণ করেন। বাড়িতে রাখা আলু অনেক সময় নষ্ট হওয়ার উপক্রম হলে কৃষকেরা তা পানির দরে বিক্রি করে দিতে বাধ্য হন।
বর্তমানে প্রতি কেজি আলুর উৎপাদন খরচ ১২ থেকে ১৫ টাকা বলে উল্লেখ করে সূত্রগুলো বলেছে, অথচ কৃষকেরা এই দরের কাছাকাছিতে বর্তমানে আলু বিক্রি করতে বাধ্য হচ্ছেন। পাইকারদের হাত ঘুরে খুচরা বাজারে বর্তমানে ২৫ টাকা কেজি দরে আলু বিক্রি হচ্ছে। গত বছর বাড়তি দাম পাওয়ায় প্রচুর কৃষক আলুর চাষ করেছেন। চলতি বছর উৎপাদনের বাম্পার ফলনের ফলে আলু সংরক্ষণ কিংবা রপ্তানির ব্যাপারটি মুখ্য হয়ে উঠেছে।
আলুর বর্তমান পরিস্থিতি নিয়ে সেঞ্চুরি এগ্রো গ্রুপের ব্যবস্থাপনা পরিচালক এস এম সিরাজুল ইসলাম বলেন, প্রচুর আলু উৎপাদিত হয়েছে। উদ্বৃত্ত আলু কিংবা দেশের চাহিদার জন্য প্রয়োজনীয় আলু যথাযথভাবে সংরক্ষণ জরুরি। ঠিকভাবে সংরক্ষণ করা না গেলে কৃষকেরা আগামীতে নিরুৎসাহিত হবেন, যা দেশের কৃষক এবং কৃষিখাতকে বড় সংকটের মুখে ফেলে দেবে। আলুর মতো একটি অর্থকরী ফসল এবং দেশের কৃষি সেক্টরের জন্য এক্ষেত্রে সরকারকে বিশেষ মনোযোগ দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি।