অনুভূতির বিস্তারণের লিপিবদ্ধ রূপ কবিতা। জীবনের জন্য জীবনের দৃষ্টি নীরিক্ষণ প্রস্রবনের স্রোতধারার মোহনা কবিতা। জীবনের আবেগ অনুভূতির সুখ দুঃখের জয়গান কবিতা। প্রকৃতি ভালোবাসার বিরহ বিচ্ছেদের বাস্তবিক দৃষ্টিভঙ্গির উপকরণ কবিতা। মানুষের অন্তঃশ্রবণ অন্তঃদহন অন্তঃদর্শনের প্রতিচ্ছবি কবিতা। কবির অন্তঃক্ষরণের ফল্গুধারা কবিতা। মানুষ দেশ জাতির অধিকার অবমূল্যায়নের ছবি আঁকে কবিতা। মানুষের জীবনের কোন প্রসঙ্গই কবির অগোচরে থাকে না। সে কলমের শাণিত অস্ত্রে রচিত করে মুক্তির সোপান। প্রকৃতি, ঋতু, দেশপ্রেম, আবহমান সমাজ, সংস্কৃতি, দৃশ্যমান অতীত বর্তমান, ভবিষ্যৎ, মৌল প্রত্যয়, মৌল কাঠামো, মানব প্রেম, অনুশাসন বাদ, ঈশ্বর প্রেম, উপদেশ অনুকরণ, সম্ভাবনা, সৃষ্টির প্রতিরক্ষার, প্রেম, বিরহ, বিচ্ছেদের উপপাদ্য উপকরণ বিবেকের নিঃসৃত বন্ধনসাক্ষী কবির সাহিত্য কবিতা গানের রূপরেখা। সৃষ্টির সৃজনশীল প্রক্রিয়ার সকল উপাত্ত মানুষের আনন্দের বাঁচার রসদ। লেখক দৃষ্টি অনুমান বিবেককে অনুভূতির রাজ্যে মিশিয়ে প্রসবের যন্ত্রণা অনুভব করে। এবং জন্ম দেয় গল্প, উপন্যাস, ছড়া, কবিতা, প্রবন্ধ, কথাসাহিত্য। প্রত্যেকটি বিষয় জীবনের তাল মাত্রার হিসেব।
কবির কবিতা কখনো গানের রূপশ্রী হয়ে উঠে। ছন্দোলিত শব্দচয়ন তাল মাত্রা সন্নিবেশিত স্থায়ী, অন্তরা, সঞ্চারি, আভোগ বিভাগ তৈরি করে তার মধ্যে হৃদয়গ্রাহী সুর সঞ্চারণ করে গীতিকার ও সুরকারের ভূমিকা ও সে রচনা করতে পারে। এই রসের উপাদানকে সে নানান ভাণ্ডারে সঞ্চিত করে। যেমন প্রেমপর্ব, প্রকৃতি পর্ব, ঋতুপর্ব, দেশাত্মবোধ পর্ব, ভক্তিমূলক পর্ব, প্রতিবাদী পর্ব, গণজাগরণ পর্ব, হাসিরসাত্মকপর্ব, ইত্যাদি ভাবের রূপ রস কথা রাগ সে আবেগঘন ব্যঞ্জনায় রচিত করতে পারে। প্রকৃতি গাছ লতা গুল্ম পাতা বায়ু জল যেমন প্রাণ দান করে প্রাণ ও প্রকৃতির। তেমনি আনন্দ বৈচিত্র্য সঞ্চার করে উদ্বেলিত করে মোহিত করে প্রকৃতি। ঐ উপলব্ধির ব্যক্ততা সঠিক অনুমেয় লেখকের লেখায়। সে ভাঙা গড়ার খেলায় একজন আর্কিটেট। বিচিত্র ভুবনকে বৈচিত্র্যময় করে উপস্থাপনে তিনি দার্শনিক। পরীক্ষণ নিরীক্ষণ তত্ত্ব–তথ্য বাস্তব বিশ্লেষণে তিনি সুচারু ভাবুক গবেষক। প্রাণে রস আনন্দ ঢেলে আবেগাপ্লুত করে কান্নার শিহরণ জাগাতে পারে, কান্না ঝরাতে পারে তিনি প্রতিবেদক। তিনি সার্থক লেখক। যিনি প্রাণে দুঃখ বেদনা ভুলে রসের সঞ্চার করতে পারে তিনি রসিক। যিনি শব্দ সাজিয়ে প্রাণের গভীরে সুরের সন্তরণ ঘটাতে পারে তিনি নৈপুণ্যের শিল্পী। যিনি অন্তরে অদৃশ্যকেও প্রাণবন্ত ছবিতে রূপদান করতে পারে। তিনি কবিত্বের চারুশিল্পী। যিনি অনবদ্য লেখনীতে কাঁদাতে হাসাতে জাগাতে পারেন কবিতা পড়ার জন্য এক মঞ্চে সংগঠিত করতে পারেন তিনি মস্তবড় সংগঠক। সৃষ্টির সৃজনশীলতার রসোদ্যানে তিনি সৃষ্টি করেন আবার লেখক, পাঠক, উপস্থাপক, প্রতিবেদক, আলোচক, গবেষক, শিল্পী, সংগঠক। যাতে তার সৃষ্টি ও সংগঠন অমরত্ব বর লাভ করে। প্রকৃত লেখকের কৌশলী ধারা অমরত্বের প্রতীক। যেমন রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর লিখে গেছেন ‘আমার সৃজনশীল ভাণ্ডারে জমে জমে সব যে পুষ্ট হবে এমন নয় তবে আমার সঙ্গীত চিরদিন বাঙালিকে গাইতে হইবে এই চির সত্য’। বিদ্রোহী কবি কাজী নজরুল ইসলাম লিখে গেছেন ‘দেশদ্রোহে, যুদ্ধবিগ্রহ, প্রতিবাদে আমার গণজাগরণমূলক সঙ্গীত সকলকে গাইতে হবে। আমার বিদ্রোহী কবিতা জনতরঙ্গে ঝড় তুলবে’। নজরুলের সাম্যবাদের চেতনায় লেখনী শ্রেষ্ঠ লেখা। তার গজল অন্যমাত্রিক সৃষ্টি। বাঙালির বাঙালিত্বের নিখুঁত রূপ। বর্ণনায়, ধারণায়, পরিবেশনায় উপস্থাপনায়, চেতনায় বাঙালিকে বিশ্বরূপে মাথা উঁচু করে প্রতিষ্ঠিত করেছেন বলিষ্ঠ সৃজনশীলতার রূপ রসে, ছন্দে চেতনার শক্ত বলিরেখায় এই দুই কবি। আরো অনেকে কাছাকাছি যুক্ত হতে চেয়েছেন, কিন্তু তাদের লেখনী শক্তি অনেকের চেয়ে আলাদা অনন্য মাত্রার বলিষ্ঠ হাতিয়ার। আমার ভাবতে ভালো লাগে আমার চট্টগ্রামে ও লেখালেখিতে শ্রেষ্ঠত্বের জয়গান জেগে উঠেছে। জন্ম নিয়েছে স্বগর্বে শিশুসাহিত্যিক, কথা সাহিত্যিক, উপন্যাসিক, গল্পকার, প্রবন্ধকার, ছড়াকার, নাট্যকার, কবি, সাহিত্যিক, রম্য সাহিত্যিক নানা ফসলের নানা উপকরণের নানা নামে। এদের সম্মিলন বিচরণক্ষেত্র ভাব প্রদানক্ষেত্র চট্টগ্রামে বলিষ্ঠ পাটাতন চট্টগ্রাম একাডেমি। ঢাকায় বাংলা একাডেমি। কলকাতায় রবীন্দ্রসদন। আমার চোখের সার্থকতার প্রতিচ্ছবি। নিসর্গের বৈচিত্র্য বিশাল উদারতার প্রশংসা, মা মাটির লালনের গর্বিত প্রশংসা, মানুষে মানুষে মানবিকতার প্রশংসা লেখক করতে পারেন। কাগজের পাতায় পাতায় কলম ও কালির আঁচড়ে নন্দিত বন্দনা সঙ্গীত নির্ঝরিনীর মতো প্রাণে প্রাণে ঝরাতে পারেন। নিষ্ঠুরতার দুর্ভেদ্য ভেদ করে সহজ তরঙ্গের দোলা সহজে জাগাতে পারেন। তাই পাঠক সৃষ্টি হয়। পাঠকের পাঠের নেশায় লেখকের সাহিত্য রঙ্গ, কবির কবিতা ও গানের অস্তিত্বের বিকাশ ঘটে। জীবনের উত্থান পতনের ঘটনা প্রবাহ যেমন ঊপন্যাসিকের লেখনীর মূল ধারা হয়ে উঠে। তেমনি জীবন ও জীবিকার নানা হাতছানি রসরঙের চিত্র লেখকের বৃত্ত, কবিতা ও গানে জেগে উঠে। জীবনের পরতে পরতে স্মৃতির কুঞ্জ পুঞ্জীভূত আবহ তৈরি করে গড়িয়ে পরে স্থান করে নেয় সাহিত্যে। প্রকৃতি ও মানুষ লেখকের প্রথম উপাত্ত। তারপর জীবনের অন্যান্য অনুষঙ্গ যে মনের কথা সবার মাঝে এক সুরে বাজে সেই কথাই কবি ব্যক্ত করেন। কোনো ভ্রান্ত ধারণা তাকে ছুঁতে পারে না। সত্যকে তার ধারণ করতে হয় নির্বিবাদে। সত্য নির্বাচন উদঘাটন তার শ্রেষ্ঠত্বের পথ। ভুল তথ্য লেখকের অস্তিত্বের অপলাপ ঘটায়। মিথ্যাকে নির্বাসনে পাঠিয়ে তার গর্বিত যাত্রা সমাজ সংসার রাষ্ট্রে অর্বাচীনের মতো।
লেখক কখনো স্বপ্ন ও ভালোবাসা কথনশিল্প বুনে মানসপটে, শুভ বৃক্ষরাজি ডাল পাতা মেলে আবাহন করে আগামীর। প্রেম, ভক্তি, বিরহের ছবি চোখ উম্মিলিত করে ঐসময় ঠাঁই নেয় কবিতার বুকে। লেখক কথার ফুলঝুরিতে সাজায় জীবনের প্রাপ্তি অপ্রাপ্তি, সুখ দুঃখ, পাওয়া না পাওয়ার, ইতিহাস ঐতিহ্যের, ভাঙা গড়ার ট্রাজেডি হয়ে ওঠে কথা শিল্পীর সাহিত্য। হয়ে ওঠে ঔপন্যাসিকের বিনয়াবনত রূপ। আবার মনের মাধুরী মিশিয়ে সে পারে রাঙাতে সুরে সুরে গীত। এই মোহিনী মোহিত শক্তিতে সে রাঙাতে পারে, অভিমান ভাঙাতে পারে, নতুন দিগন্তে প্রাণের জোয়ার জাগাতে পারে, অসীম অপরূপ সৌন্দর্যে নাইতে পারে, প্রগতির সিঁড়ি গড়তে পারে, ভক্তিরসে শান্তির বীজ বুনতে পারে, আনন্দধারা বয়ে দিতে পারে, সম্প্রীতির বন্ধন এনে দিতে পারে। সমাজ ও দৃষ্টি, ভাষা ও সংস্কৃতি, সাহিত্য ও শিল্প, লেখকের অন্তঃতুলিতে কালক্ষেপণের এক অন্তরঙ্গ রচনা শৈলী।
লেখক: প্রাবন্ধিক, সংগীতশিল্পী; অবসরপ্রাপ্ত অধ্যাপক,
লতিফা সিদ্দিকী ডিগ্রি কলেজ।