ভোগ্যপণ্য পরিবহনে মানা হচ্ছে না নিয়ম, বাড়ছে স্বাস্থ্যের ঝুঁকি

সার, ক্লিংকার ও কেমিক্যাল জাতীয় পণ্য পরিবহনের পর করা হয় না পরিষ্কার । নৌবাহিনী ও কোস্টগার্ডকে বিষয়টি দেখভাল করার আহ্বান

হাসান আকবর | মঙ্গলবার , ২৮ জানুয়ারি, ২০২৫ at ৬:০৬ পূর্বাহ্ণ

লাইটারেজ জাহাজে ভোগ্যপণ্য পরিবহনে নিয়মনীতির তোয়াক্কা না করা জনস্বাস্থ্যের জন্য বড় ধরণের হুমকি হয়ে উঠছে। প্রচলিত নিয়ম কানুন অনুসরণ না করে বিভিন্ন ধরনের কেমিক্যালসহ ক্ষতিকর পণ্যবাহী জাহাজেই পরিবহন করা হচ্ছে ভোগ্যপণ্য। সার, ক্লিংকার, কেমিক্যাল, কয়লা জাতীয় পণ্য পরিবহনের পরপরই গম ডালসহ নানা ভোগ্যপণ্য জাহাজীকরণ করার ঘটনা ঘটছে। অথচ নিয়মানুযায়ী এই ধরনের পণ্য পরিবহনের পর ভোগ্য পণ্য পরিবহন করতে হলে জাহাজের হ্যাজ পুরোপুরি ধুয়ে মুছে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন এবং শুকিয়ে নেয়ার নিয়ম রয়েছে। কিন্তু জাহাজের হ্যাজগুলো পরিস্কার করার ব্যাপারটি ব্যয়বহুল এবং কষ্টকর হওয়ায় এসবের তোয়াক্কাই করা হচ্ছে না।

আবার দীর্ঘদিনের পুরানো এবং লক্কর ঝক্কর মার্কা জাহাজেও ভোগ্যপণ্য পরিবহন করছে। জং ধরা এসব জাহাজের লোহার কনাও মিশে যায় ভোগ্যপণ্যে। বিষয়টি নিয়ে সাধারণ ভোক্তাদের পক্ষ থেকে উদ্বেগ প্রকাশ করা হলেও গভীর সাগরে যথাযথ তদারকির অভাবে লাইটারেজ জাহাজ মালিকেরা পার পেয়ে যাচ্ছেন বলে মন্তব্য করে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বাংলাদেশ নৌবাহিনী এবং কোস্টগার্ডকে বিষয়টি দেখভাল এবং তদারকির দায়িত্ব দেয়ার অনুরোধ জানানো হয়েছে।

সূত্র জানায়, চট্টগ্রাম বন্দর থেকে লাখ লাখ টন ভোগ্যপণ্যসহ দেশের আমদানি বাণিজ্যের আশি শতাংশেরও বেশি হ্যান্ডলিং হয়। বড় বড় জাহাজে বোঝাই করে বিশ্বের নানা দেশ থেকে আনা এসব পণ্য লাইটারেজ জাহাজে বোঝাই করে দেশের অভ্যন্তরীণ ঘাটগুলোতে পরিবহন করা হয়। শুধু বড় বড় মাদার ভ্যাসেল থেকেই নয়, চট্টগ্রাম বন্দরের অভ্যন্তরে নোঙর করা জাহাজের ওভারসাইড থেকেও পণ্য লাইটারেজ জাহাজে বোঝাই করা হয়। এই প্রক্রিয়ার মাধ্যমে টিকে রয়েছে দেশের অভ্যন্তরীণ নৌ পরিবহন খাত ও সাপ্লাই চেইন নেটওয়ার্ক। বছরে অন্তত দশ কোটি টনেরও বেশি পণ্য দেশের অভ্যন্তরীণ রুটে পরিবাহিত হয়।

চট্টগ্রাম বন্দর থেকে পণ্য পরিবহনে প্রায় ১৮শ’ লাইটারেজ জাহাজ রয়েছে। এসব জাহাজ চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙর থেকে কর্ণফুলী নদীর ১৬টি ঘাট এবং ঢাকা, মিরপুর, নগরবাড়ী, বাঘাবাড়ী, নোয়াপাড়া, খুলনা, বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন স্থানে পণ্য পরিবহন করে। চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে গম, ডাল, সরিষা, লবন, সুগার, সার, ক্লিংকার, স্টিল প্লেট, কয়লাসহ বিভিন্ন ধরনের পণ্য পরিবহন করে। সব পণ্যই পরিবহন করা হয় লাইটারেজ জাহাজের মাধ্যমে। সার কিংবা কয়লা পরিবহনকারী জাহাজই পরের ট্রিপে খোলা গম কিংবা রসুগার নিয়ে গন্তব্যে যায়। আবার সিমেন্ট ক্লিংকার পরিবহনের পরপরই দেখা যায় পরের ট্রিপে জাহাজটি সরিষা বা গম নিয়ে অন্য গন্তব্যে যাচ্ছে।

এক ট্রিপে কয়লা, পাথর বা ক্যামিকেল পরিবহন করে পরের ট্রিপে গম সরিষা বা ভোগ্যপন্য পরিবহন করতে পারবে না এমন কোন নিয়ম নেই। তবে একটি নিয়ম রয়েছে যে, জনস্বাস্থ্যের জন্য ক্ষতিকর পণ্য পরিবহনের পরপরই জাহাজটিকে ভালোমতে পরিস্কার পরিচ্ছন্ন এবং শুকিয়ে ফেলতে হবে। এরপর খাদ্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তার কাছ থেকে অনাপত্তি পত্র নেয়ার পরই কেবল ওই জাহাজে ভোগ্য পণ্য বোঝাই করা যাবে। যাতে আগের ট্রিপে পরিবাহিত ক্ষতিকর কোন পণ্যের কোন উপাদান যাতে ভোগ্যপণ্যের সাথে মেশার সুযোগ না থাকে। কিন্তু চট্টগ্রাম বন্দরের বহির্নোঙরে এসব নিয়ম কানুনের কোন বালাই নেই। লাইটারেজ জাহাজের মাস্টার এবং নাবিকেরাই নিজেদের মতো করে পণ্য বোঝাই করে গন্তব্যে পৌঁছে দিচ্ছেন।

সূত্র বলেছে যে, খাদ্য অধিদপ্তরের গম পরিবহনকালে কোন কোন সময় কড়াকড়ি করা হয়। তবে বেসরকারি ভোগ্যপণ্য পরিবহনকালে এসবের তোয়াক্কা করা হয় না। কয়লা, পাথর, সার কিংবা ক্লিংকার পরিবহনের পরপরই জাহাজে খোলা গম পরিবহনের অনেক ঘটনা ঘটেছে। বিষয়টি অত্যন্ত উদ্বেগজনক এবং জনস্বাস্থ্যের জন্য মারাত্মক হুমকি তৈরি করছে বলে মন্তব্য করেছেন সংশ্লিষ্টরা।

খাদ্য অধিদপ্তরের একজন শীর্ষ কর্মকর্তা বিষয়টি স্বীকার করে বলেন, সমস্যা আসলে প্রকট। এটা অত্যন্ত সেনসেটিভ একটি ইস্যু। খাদ্য অধিদপ্তরের কোন জাহাজ নেই। খাদ্য অধিদপ্তরে বাজার থেকে জাহাজ নিয়ে ভোগ্যপণ্য পরিবহন করে। কিন্তু দেশে শুধু ভোগ্যপণ্য পরিবহনের জন্য কোন ডেডিকেটেড লাইটারেজ জাহাজ নেই। এটিও একটি বড় সমস্যা। একটি জাহাজ আগের ট্রিপে সার কয়লা কিংবা ক্লিংকার পরিবহন করে, পরের ট্রিপেই ভোগ্য পণ্য পরিবহন করছে। নিয়মানুযায়ী ভোগ্যপণ্য পরিবহনের আগে ওই জাহাজকে ধুয়ে মুছে খুবই ভালোভাবে পরিস্কার করার কথা। কিন্তু বুঝেন তো, আমাদের খুব বেশি কিছু করার থাকে না।

তিনি বলেন, ভোগ্যপণ্য বোঝাই করার আগে খাদ্য অধিদপ্তরের সংশ্লিষ্ট বিভাগ থেকে রসায়নবিদ গিয়ে জাহাজের হ্যাজ পরীক্ষা করেন। তিনি ক্লিয়ারেন্স লেটার ইস্যু করলেই কেবল পণ্য জাহাজীকরণ করা হয়।

কিন্তু কাগজে কলমে এসব নিয়ম থাকলেও বাস্তবে তা মানা হচ্ছে না বলে উল্লেখ করে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলেছে, সার কয়লা পাথর কিংবা কেমিক্যাল পরিবহনের পরের ট্রিপে ভোগ্যপণ্য পরিবহনের ওয়ার্কঅর্ডার পেলে জাহাজটিকে একেবারে ধুয়ে মুছে জাহাজটিকে একেবারে শুকনো অবস্থায় প্রস্তুত করার কথা। যাতে পরের ট্রিপের পণ্যে আগের ক্যামিকেল কিংবা অন্যান্য পণ্যের কোন ছোঁয়া না লাগে। কিন্তু জাহাজের হ্যাজগুলো ধুয়ে মুছে পরিস্কার করে শুকনো অবস্থায় প্রস্তুত করা বেশ কষ্টসাধ্য, ব্যয়বহুল এবং সময়সাপেক্ষ। তাই জাহাজ মালিক এবং কর্মচারীরা তা না করে জাহাজকে পরের ট্রিপের পণ্য বোঝাইয়ের জন্য পাঠিয়ে দেয়। আবার জং ধরা পুরানো জাহাজের লোহার কনারও অবাধ মিশ্রন ঘটে ভোগ্যপণ্যে।

বিষয়টি নিয়ে লাইটারেজ জাহাজ পরিচালনার সাথে জড়িত বাংলাদেশ ওয়াটার ট্রান্সপোর্ট কোঅর্ডিনেশন সেলের (বিডব্লিউটিসিসি) একজন নেতা বলেন, আমরা জাহাজের সিরিয়াল মেনে জাহাজ বরাদ্দ দিই। ওই জাহাজ আগের ট্রিপে কি পরিবহন করেছিল সেটা আমরা জানি, তবে পরের ট্রিপের জন্য জাহাজটিকে পরিস্কার বা তৈরি করা হয়েছে কিনা সেটা আমরা জানি না। তাছাড়া বড় বড় শিল্প গ্রুপের একাধিক ব্যবসা রয়েছে। তারা সিমেন্ট বানায়, চিনি উৎপাদন করে আবার ভোগ্যপণ্যও আমদানি করে। তাদের সব পণ্যই তাদের জাহাজগুলোতেই পরিবাহিত হয়। এসব জাহাজ আমাদের সিরিয়ালে আসেনা, আমরা জানিও না যে তারা কখন কি পরিবহন করছে।

গম কিংবা রসুগারের সাথে কয়লা কিংবা পাথরের গুঁড়ো মিঙড হওয়া বা সারের ক্যামিকেল যুক্ত হওয়া জনস্বাস্থ্যের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। একাধিক চিকিৎসক জানিয়েছেন, এটি একটি ভয়াবহ ব্যাপার। এই ধরণের মিশ্রন মানবদেহের জন্য অত্যন্ত ক্ষতিকর। সার, কয়লা কিংবা পাথরের উপাদান যদি ভোগ্যপণ্যে জড়িয়ে থাকে তাহলে ক্যান্সারসহ নানা ধরণের রোগ হতে পারে। গমের সাথে কয়লা কিংবা পাথর বা অন্য কেমিক্যাল থাকলে সেটি ক্রাশ করার পর আটার সাথে থেকে যাবে। এই উপকরণ কোনভাবেই বাইরে যাবে না। যা মানুষের শরীরে প্রবেশ করে নানা রোগবালাই সৃষ্টি করবে।

সিংগভাগ ভোগ্যপণ্যই বোঝাই করা হয় বহির্নোঙরে। সাগরে গিয়ে এসব দেখভাল করার সময় সুযোগ সুবিধা একমাত্র বাংলাদেশ নৌবাহিনী বা কোস্টগার্ড ছাড়া অন্য কোন সংস্থার নেই। তাই বিষয়টি তদারকির দায়িত্ব এই দুইটি সংস্থাকে দেয়া গেলে দেশের জনস্বাস্থ্য বড় ধরণের হুমকি থেকে রক্ষা পেতো। তারা বলেন, কী ধরণের জাহাজ ভোগ্যপণ্য পরিবহন করতে পারবে তার একটি মাপকাঠি থাকা দরকার। যে কোন জাহাজের ক্ষেত্রে ভোগ্যপণ্য বোঝাই করার অবারিত সুযোগ থাকা উচিত নয় বলেও সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো মন্তব্য করেছে।

পূর্ববর্তী নিবন্ধরুমায় দুই কেএনএফ সদস্য আটক
পরবর্তী নিবন্ধন্যায়বিচারের স্বার্থে ভারত হাসিনাকে ফেরত পাঠাবে, আশা ক্যাডম্যানের