মানুষের ইতিহাসে বর্বরতম এক হত্যাযজ্ঞের বিরতি। ১৯ জানুয়ারি ২০২৫ ইসরাইল এবং হামাসের মধ্যে সাময়িক এক যুদ্ধ বিরতি চুক্তি স্বাক্ষরের মাধ্যমে গাজায় গণহত্যার আপাত বিরতি ঘটেছে। আপাত বিরতি বলছি কারণ ইসরাইল চাইলে যে কোনো সময় যে কোনো অজুহাতে এ বিরতির অবসান ঘটিয়ে আবারো পুরাদমে মানুষ হত্যায় মেতে উঠতে পারে। সাময়িক এ বিরতি নিয়ে ইতিমধ্যে সদ্য শপথ নেওয়া মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ট ট্রাম্পও সংশয় প্রকাশ করে বলেছেন এ যুদ্ধ বিরতি তথা হত্যা বিরতি যে কোনো সময় ভেঙে পড়তে পারে। তবে এ হত্যাবিরতির পর পরই গাজার রাস্তায় হাজার হাজার হামাস প্রতিরোধ যোদ্ধার নেমে পড়া এবং জিম্মি তিন ইসরাইলীর হস্তান্তর প্রক্রিয়ায় যে উল্লাস তারা প্রর্দশন করেছে তা দেখে বিশ্ববাসী এ কথা ভাবতেই পারে, কয়েক শ দিন ধরে ইসরাইলী যুদ্ধ বিমানগুলির অবিরাম বোমাবর্ষণ, বর্তমান পৃথিবীর সবচেয়ে শক্তিধর দেশ আমেরিকার সরবরাহকৃত র্স্বাধুনিক ট্যাংক বহর, ২০০০ পাউন্ড বোমাগুলির মাধ্যমে গাজায় ইসরাইলীদের দ্বারা তাণ্ডব, হাজার হাজার ফিলিস্তিনীর খোলা আকাশের নিচে অমানবিক বন্দী জীবন, এসব সত্তেও পৃথিবীর চতুর্থ প্রবল শক্তিশালী সামরিক বাহিনীকে গাজায় কেবল পরাজয়ই বরণ করতে হয়েছে। এ পরাজয় স্বীকার করে নিয়ে ইসরাইলী সামরিক বাহিনী প্রধান জেনারেল ‘হালভি’ ২১ জানুয়ারি পদত্যাগ করেছেন।
উল্লেখ্য ইতিমধ্যে গাজায় ৪৭ হাজার ৩৫ জন মানুষের মৃত্যু হয়েছে। ধ্বংস স্ত্তূপের পরিমাণ ৪২ মিলিয়ন মেট্রিক টন। এই ধ্বংস স্তুপের নিচে আরো কত বহুশত মৃতদেহ চাপা পড়ে আছে তা সময়ে জানা যাবে। গাজায় বাস্ত্তুচ্যুত মানুষের সংখ্যা প্রায ১৯ লক্ষ, এটি গাজার মোট জনসংখ্যার ৯০%। বাড়ি ঘর ধ্বংস হয়েছে ৪ লক্ষ ৩৬ হাজার। গাজায় বর্তমানে বিদ্যুৎ নাই, টেলি যোগাযোগ ধ্বংসপ্রাপ্ত, শিক্ষাব্যবস্থা বির্পযস্ত, চিকিৎসা ব্যবস্থা ধ্বংস করা হয়েছে পরিকল্পিত ভাবে।
হেগস্থ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে গাজায় ইসরাইলী হত্যাকাণ্ড সম্বন্ধে বলতে গিয়ে আইরিশ আইনজ্ঞ ‘ব্লেনি নি গ্রা লেই’ উল্লেখ করেন বিশ্ব এখন ইলেকট্রনিক সম্প্রচারের বদৌলতে প্রতিদিনই গাজায় গণহত্যার দৃশ্য অবলোকন করছে। ইউরোপ আমেরিকার সরকারগুলি বিশেষ করে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্র, জার্মানী এবং বৃটেনের কনজার্ভেটিব সরকারের ইসরাইলকে অর্থ অস্ত্র সাহায্য তাদের হত্যাযজ্ঞ চালাতে বেপরোয়া করে তোলে।
৪ শত ৭১ দিন গাজা অবরুদ্ধ এবং অবিরাম বোমাবর্ষণের শিকার হয়েছে। অবশেষে ১৯ জানুয়ারি ২০২৫ গাজায় যুদ্ধ বিরতি বলবৎ হয়। যুদ্ধ বিরতি এ চুক্তি প্রণয়নে কাতার মিশর এবং সৌদি আরব অগ্রণী ভূমিকা পালন করে। আমেরিকান প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম তার শপথ গ্রহণ পূর্ব এক বিজয়ী ভাষণ প্রদান করেন। মজার ব্যাপার হল এই ভাষণে গাজা যুদ্ধ বিরতি চুক্তি বিষয়ে তিনি তার পূর্বসুরি বাইডেনকে নিয়ে অনুষ্ঠানে উপস্থিত হাজারো শ্রোতার মাঝে এক হাস্য রসের সৃষ্টি করেন। প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম বলেন ‘আমি র্ন্বিাচিত হয়ে প্রেসিডেন্ট না থেকেও তিন মাসে গাজায় যুদ্ধ বিরতি চুক্তি নিশ্চিত করেছি, আর বাইডেন চার বছর প্রেসিডেন্ট থেকেও কিছুই করতে পারেনি, এখন বিদায় বেলায় যুদ্ধ বিরতি চুক্তির কৃতিত্ব নেওয়ার চেষ্টায় আছেন’। বাইডেনকে নিয়ে এ প্রসঙ্গে তিনি উপহাসও করেন। ট্রাম বলেন, আমি র্ন্বিাচনে জিতার পর ‘স্টিভ বিটকম’কে মধ্যস্থ্যতার জন্য মধ্যেপ্রাচ্যে কাজ করার জন্য অনুরোধ করি, এ চুক্তি স্টিভ’এরই কৃতিত্ব।
২০ জানুয়ারি ২০২৫ অনেক আগ্রহ ভরে ট্রামের শপথ গ্রহণ অনুষ্ঠান দেখছিলাম। ট্রাম আমেরিকার ইতিহাসে সবচেয়ে বয়সী হিসাবে শপথ নিয়েছেন সি এন এন এর ভাষ্যকার একই সাথে আরো একটি তথ্য দর্শকদের জ্ঞাতার্থে তুলে ধরেন কোন সাজাপ্রাপ্ত ব্যক্তির আমেরিকার ইতিহাসে এই প্রথম শপথ গ্রহণ। এসব আমাকে মোটেও আন্দোলিত করেনি। কিন্ত্তু যখন ফাদার এসে বাইবেল থেকে জলদ গম্ভীর স্বরে উচ্চারণ করলেন ‘প্রভু আমাদের দূরদর্শিতা, মানবিক শক্তি, ন্যায়পরানতার ক্ষমতা দান কর’। এ কথা গুলি উচ্চারিত হবার সময় আমার চোখ বারবার বিদায়ী আর শপথ নিতে যাওয়া দুই আমেরিকান প্রেসিডেন্টের দিকে নিবদ্ধ হচ্ছিল, তারা কি এই কথা গুলি মনে রেখেছিলেন বা মনে রাখবেন দায়িত্ব পালনকালীন। দূরাশা!
এবার চুক্তি প্রসঙ্গে আসি। চুক্তি বাস্তবায়িত হবে তিন ধাপে।
প্রথম ধাপ। এই ধাপে ৩৩জন ইসরাইলী মুক্তি পাবে। এই ৩৩ জনের মধ্যে ১৯ বছরের নিচে শিশু থাকলে তারা অগ্রাধিকার পাবে এরপর নারী যাদের বয়স ৫০ উর্দ্ধ, তারপর নারী সামরিক বাহিনীর সদস্য এসব মিলিয়ে ৩৩ জন না হলে তবে মৃত ইসরাইলীদের দেহ হস্তান্তর করে ৩৩ পূর্ণ করা হবে।
বিনিময়ে প্রতি একজন ইসরাইলীর জন্য ৩০ জন ফিলিস্তিনী শিশু এবং নারী মুক্তি লাভ করবে। প্রতিদিন ৬০০ ট্রাক গাজায় সাহায্য বহন করে প্রবেশ করবে। এই ৬০০ এর মাঝে ২৫০ ট্রাক জ্বালানী বহন করবে। এই জ্বালানী গাজার ধ্বংসস্ত্তুপ সরানোর কাজে নিয়োজিত যন্ত্রপাতি, হাসপাতাল সহ অন্যান্য সেবা খাতে ব্যবহার হবে। ফিলিস্তিনীরা তাদের ঘরবাড়িতে ফিরে আসবে, ক্রমান্বয়ে ইসরাইলী সৈন্য গাজা থেকে প্রত্যাহৃত হবে।
দ্বিতীয় ধাপ। এই ধাপে ইসরাইলী সামরিক বেসামরিক সমস্ত জিম্মি মুক্তি পাবে। বিনিময়ে ইসরাইল একটি সম্মত সিদ্ধান্তে ফিলিস্তিনীদের মুক্তি দেবে। ইসরাইলী অবশিষ্ট সৈন্য গাজা থেকে প্রত্যাহৃত হবে–
তৃতীয় ধাপ। উভয় পক্ষ শান্তির বাতাবরণ সৃষ্টিতে আত্মনিয়োগ করবে। ইসরাইল গাজা অবরোধের অবসান ঘটাবে। হামাস নতুন করে সামরিক শক্তি বৃদ্ধি করবে না।
চুক্তির বাস্তবায়নকালীন যা ঘটবে বা ঘটতে পারে। ইসরাইলী উগ্রবাদী গোষ্ঠী হয়ত এই গণহত্যা বন্ধকে সহজে মেনে নিতে চাইবে না। নানা অজুহাতে তারা ফিলিস্তিনি ভূখণ্ড অবৈধ দখলে নিতে তৎপর হবে। এটা তাদের সম্প্রসারণবাদী মনোভাবের জন্য ঘটবে। এ ক্ষেত্রে চুক্তি ভঙ্গ হয়ে পুনরায় উভয় পক্ষ সংঘাতের মুখামুখি হতে পারে। ফ্লোরিডার কট্টর ইসরাইল সমর্থক সিনেটর রোবিও এখন আমেরিকার পররাষ্ট্রনীতির কর্ণধার এ উৎসাহ হয়ত ভবিষ্যৎ এ ইসরাইলীদের আক্রমণাত্মক হওয়ার পথে পরিচালিত করতে পারে।
সিরিয়ায় প্রেসিডেন্ট বাসার আল আসাদের পতনের পর ইরান থেকে হামাসের জন্য যে সরবরাহ পথ অবারিত ছিল তা অনেকটা কঠিন হয়ে পড়েছে। এটি হামাসের ভবিষ্যৎ এর সিদ্ধান্তে প্রভাব ফেলবে। এক্ষেত্রে সিরিয়ার উপর তুরস্কের প্রভাব নিয়ামক শক্তি হিসাবে প্রতিভাত হবে। হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরুল্লাহর তিরোধান এবং হিসবুল্লাহ’র শক্তিক্ষয় ফিলিস্তিনিদের ভোগাবে। আমেরিকার সদ্য ক্ষমতারাহোনকারী প্রেসিডেন্ট ট্রাম তার সময় কালে ‘আব্রাহাম চুক্তি’র আরো বিস্তৃতি ঘটানোতে মনোনিবেশ করবেন নিঃসন্দেহে।
‘আব্রাহাম চুক্তি’ হল ডোনাল্ট ট্রাম এর গত মেয়াদে আমেরিকার উদ্যোগে ইসরাইল এবং ইউনাইটেড আরব আমিরাতের মধ্যে স্বাক্ষরিত দ্বিপাক্ষিক সমঝোতা চুক্তি। এ চুক্তির মূল কথা তথা ঘোষণা ছিল
‘We, the undersigned, recognize the impotence of maintaining and strengthening peace in the Middle East and around the world based on mutual understanding and coexistence, as well as respect for human dignity and freedom, including religious freedom’ ইউ এ ই এবং ইসরাইলের এই ঘোষণা পরবর্তী ওমান, মরক্কো এবং সুদানও ইসরাইলের সাথে সর্ম্পক স্বাভাবিক করে। উল্লেখ্য মিসর এবং জর্দান ইতিপূর্বে ইসরাইলকে স্বীকৃতি প্রদান করে। এখন আমেরিকা মধ্যপ্রাচ্যের বাকী দেশগুলিকে এই পথে আনার প্রয়াস পাবে।
দুর্ভাগ্যের বিষয় হল আমেরিকার দুতিয়ালীতে বর্ণিত দেশগুলি ইসরাইলকে স্বীকৃতি দিলেও ফিলিস্তিন জবর দখলকারী ইসরাইল ফিলিস্তিনকে স্বীকার করে নিতে অস্বীকৃতি জানিয়ে আসছে। এ জায়গাটি ঘিরেই ভবিষ্যৎ এ মধ্যপ্রাচ্যে আবার সংঘাতের লেলিহান শিখা প্রজ্জলিত হতে পারে। সে রকম পরিস্থিতিতে আমি নিশ্চিত ইয়াহিয়া সিনওয়ারের এ আহ্বান ফিলিস্তিনিরা কখনো ভুলে যাবেন না।
‘স্বাধীনতার স্বপ্নের বিশাল এক দায়িত্ব
আমি বয়ে বেড়িয়েছি,
এ দায়িত্ব বহনে আমি
কখনো মাথা নোয়াইনি।
জীবন বিপন্ন হলেও
ভেঙে পড়বেন না।
স্বাধীনতার অবিচলতার এক
অবিনাশী জোয়ার সৃষ্টি করুন
এবং এ থেকে কখনো নিবৃত্ত হবেন
না, যতক্ষণ না পৃথিবী আমাদের
মাতৃভূমির উপর
আমাদের নায্য অধিকার
স্বীকার করে নেয়’
লেখক : প্রাবন্ধিক, কলামিস্ট; সামরিক এবং নিরাপত্তা বিশ্লেষক