সুইজারল্যান্ডের ডাভোসে বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামে বার্ষিক সম্মেলনে যোগ দিয়ে প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস বাংলাদেশের পাচার হওয়ার অর্থ ফেরাতে তার বিদেশি বন্ধুদের সহায়তা চেয়েছেন। গতকাল বুধবার বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান ও মন্ত্রীদের সঙ্গে বৈঠকে তিনি আওয়ামী লীগ সরকারের শাসনের সময়ে দুর্নীতি খতিয়ে দেখতে বিশেষজ্ঞ, থিংক ট্যাংক, সাংবাদিক ও আন্তর্জাতিক বিভিন্ন সংস্থাকে বাংলাদেশে পাঠানোর আহ্বানও জানান।
সুইজারল্যান্ডের ডাভোসে জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেসের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন প্রধান উপদেষ্টা মুহাম্মদ ইউনূস। প্রধান উপদেষ্টার দপ্তর জানিয়েছে, গতকাল বুধবার ওয়ার্ল্ড ইকোনমিক ফোরামের সম্মেলনের ফাঁকে এই বৈঠকে তারা একে অপরের সঙ্গে শুভেচ্ছা ও কুশল বিনিময় করেন। বিশ্ব অর্থনৈতিক ফোরামের (ডব্লিউইএফ) বার্ষিক সম্মেলনে যোগ দিতে গত মঙ্গলবার সুইজারল্যান্ডে পৌঁছান মুহাম্মদ ইউনূস। খবর বিডিনিউজের।
প্রধান উপদেষ্টার সঙ্গে বৈঠকে উপস্থিত তার বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী জার্মান মন্ত্রী বয়ফগাং শ্মিথকে চুরি যাওয়া অর্থ উদ্ধারে বাংলাদেশ সরকারের চেষ্টার বিষয়টি তুলে ধরেন।
লুৎফে সিদ্দিকী বলেন, পাচারের অর্থ ফেরানোর বিষয়ে একটি সম্পদ পুনরুদ্ধার কমিটি ও বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নরের নেতৃত্বে একটি টাস্কফোর্স গঠন করা হয়েছে। অর্থ উদ্ধারের পদক্ষেপ নিয়ে প্রাথমিকভাবে শীর্ষ ২০ অর্থ পাচারকারীকে চিহ্নিত করা হয়েছে। এসময় দুর্নীতিমুক্ত বাংলাদেশ গড়তে অন্তর্বর্তী সরকারের চেষ্টার কথা তুলে ধরে প্রধান উপদেষ্টা জার্মান মন্ত্রীকে বলেন, ‘আমরা যখন নতুন বাংলাদেশ নিয়ে কথা বলি, তখন আমরা পরিচ্ছন্ন বাংলাদেশের কথাও বলি।’ এ ক্ষেত্রে জার্মানির সমর্থন চেয়ে দেশটির মন্ত্রী শ্মিথের সঙ্গে অর্থনৈতিক সহযোগিতার সম্ভাব্য ক্ষেত্র নিয়ে আলোচনা করেন ইউনূস। জবাবে শ্মিথ বলেন, এপ্রিল মাসে একটি জার্মান ব্যবসায়িক প্রতিনিধিদল বাংলাদেশ সফর করবে।
পরে প্রধান উপদেষ্টার উপ–প্রেস সচিব আবুল কালাম আজাদ মজুমদার বৈঠকের বিষয়গুলো সাংবাদিকদের অবহিত করেন বলে বাসস জানিয়েছে। জার্মান মন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকে মুহাম্মদ ইউনূস নেপালের জলবিদ্যুতের জন্য ভারত, নেপাল ও ভুটানকে অন্তর্ভুক্ত করে একটি অর্থনৈতিক প্ল্যাটফর্ম তৈরির কথা বলেন। তিনি বলেন, ‘নেপাল সত্যিই বিদ্যুৎ বিক্রি করতে প্রস্তুত এবং বাংলাদেশ একটি ভালো বাজার। এটি প্রচুর কর্মসংস্থান তৈরি করতে পারে এবং জীবাশ্ম জ্বালানির উপর নির্ভরতা কমাতে পারে।’
সুইজারল্যান্ডের পররাষ্ট্র বিভাগের ফেডারেল কাউন্সিলর ইগনাজিও ক্যাসিসের সঙ্গে অর্থনৈতিক সহযোগিতা ও জলবায়ুতে অর্থায়নসহ পারস্পরিক স্বার্থের বিষয়গুলো নিয়ে আলোচনা করেন প্রধান উপদেষ্টা। বিশ্বের বৃহত্তম ম্যানগ্রোভ বন সুন্দরবনে কার্বন রোধ চেষ্টায় বাংলাদেশকে সহায়তার অনুরোধ জানান তিনি। সুইজারল্যান্ডকে বাংলাদেশের যুবসমাজের সম্ভাবনা কাজে লাগাতে বিনিয়োগের আহ্বানও জানান তিনি। বাংলাদেশের অন্তর্বর্তী সরকারের সংস্কার পরিকল্পনা ও পরবর্তী সাধারণ নির্বাচনের পরিকল্পনাও বিশ্ব নেতাদের কাছে তুলে ধরেন মুহাম্মদ ইউনূস। জার্মান মন্ত্রী ও সুইস কাউন্সিলরের সঙ্গে সাক্ষাতে বাংলাদেশের জ্বালানি নিরাপত্তা নিয়েও আলোচনা করেন। সফরের দ্বিতীয় দিন বুধবার বেলজিয়ামের রাজা ফিলিপ ও কঙ্গোর রাষ্ট্রপতি ফেলিঙ শিসেকেদির সঙ্গেও সাক্ষাত করেন প্রধান উপদেষ্টা। একটি ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি কীভাবে আফ্রিকান দেশটিতে গ্রীষ্মমণ্ডলীয় বন সংরক্ষণ করেছে সেটি সাক্ষাতে মুহাম্মদ ইউনূসকে অবহিত করা হয়। কঙ্গোর সংঘাতপ্রবণ অঞ্চলে ক্ষুদ্রঋণ প্রচলনকারী প্রিন্স ইমানুয়েল ডি মেরোড বলেন, ক্ষুদ্রঋণ সেখানে ২১ হাজার কর্মসংস্থান সৃষ্টি করেছে। ক্ষুদ্রঋণ কর্মসূচি ওই অঞ্চলের কিছু অংশে শান্তি ফিরিয়ে আনতে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেছে।
থাইল্যান্ডের প্রধানমন্ত্রী পেতংতার্ন সিনাওয়াত্রার সঙ্গে সাক্ষাতে রোহিঙ্গা সংকট ও জাহাজ চলাচলসহ অর্থনৈতিক সহযোগিতার ক্ষেত্রগুলো নিয়ে আলোচনা করেন প্রধান উপদেষ্টা। তিনি বলেন, ‘আমরা রোহিঙ্গা সংকট দ্রুত সমাধান করতে চাই। কারণ আরও বেশি সংখ্যক রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আসছে।’ সিনাওয়াত্রা দুই দেশের মধ্যে যুব সম্পৃক্ততা বাড়াতে তার আগ্রহ প্রকাশ করেন। ইউনূস বলেন, থাই প্রধানমন্ত্রীর বাবা থাকসিন সিনাওয়াত্রা ক্ষুদ্রঋণ ও সামাজিক ব্যবসার বড় ভক্ত ছিলেন। পেতংতার্ন সিনাওয়াত্রাকে ‘থ্রি জিরোর’ ধারণা দেন তিনি। বৈঠকে থাই প্রধানমন্ত্রী বলেন, বিমসটেক শীর্ষ সম্মেলন এ বছরের এপ্রিলে ব্যাংককে হবে। জবাবে ইউনূস বলেন, শীর্ষ সম্মেলনের সময় বিমসটেকের চেয়ারম্যানের দায়িত্ব গ্রহণের জন্য তিনি অধীর। আসিয়ানের সেক্টরাল সংলাপ অংশীদার হতে এবং বাংলাদেশের পূর্ণ সদস্যপদ পেতে থাইল্যান্ডের সমর্থন কামনা করেন।
এদিন দুবাই সংস্কৃতি ও শিল্প কর্তৃপক্ষের চেয়ারপারসন শেখ লতিফা বিনতে মোহাম্মদ বিন রশিদ আল মাকতুম, জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ক প্রাক্তন মার্কিন বিশেষ দূত জন কেরি এবং প্রাক্তন ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী টনি ব্লেয়ারের সঙ্গেও বৈঠক করেন প্রধান উপদেষ্টা। প্রধান উপদেষ্টার বৈঠকে তার বিশেষ দূত লুৎফে সিদ্দিকী ছাড়াও এসডিজিবিষয়ক মুখ্য সচিব লামিয়া মোরশেদ এবং জেনেভায় বাংলাদেশের স্থায়ী প্রতিনিধি তারেক আরিফুল ইসলাম উপস্থিত ছিলেন।