প্রবাসী আয়ের ওপর বাংলাদেশের অর্থনীতি ব্যাপকভাবে নির্ভরশীল হলেও দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে অভ্যন্তরীণ আয় বৃদ্ধির বিকল্প নেই বলে মন্তব্য করেছেন সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) নির্বাহী পরিচালক ড. ফাহমিদা খাতুন। গত শনিবার শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে ‘প্রবাসী আয় বৃদ্ধিতে করণীয়’ শীর্ষক সেমিনার এবং আন্তর্জাতিক অভিবাসী দিবস উপলক্ষে বিতর্ক প্রতিযোগিতার চ্যাম্পিয়ন ও রানার্সআপ দলের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে প্রধান অতিথির বক্তব্যে এ কথা বলেন।
পত্রিকায় প্রকাশিত খবরে বলা হয়, প্রবাসী আয় দেশের অর্থনীতির জন্য এক বিরাট আশীর্বাদ উল্লেখ করেন ড. ফাহমিদা খাতুন। তিনি বলেন, দেশের নিজস্ব উৎপাদন এবং অর্থনীতি সংকীর্ণ হওয়ায় রিজার্ভের অনেকাংশ এই প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো রেমিট্যান্সের ওপর নির্ভরশীল। তবে দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে অভ্যন্তরীণ আয় বাড়াতে হবে। নীতিমালা গ্রহণের ক্ষেত্রে অন্তর্দ্বন্দ্বমূলক নীতি থেকে বেরিয়ে জনকল্যাণমূলক নীতিমালা গ্রহণে বেশি মনোযোগী হতে হবে। জনগণের স্বার্থের বিষয়ে গুরুত্ব দেওয়া গুরুত্বপূর্ণ।
দক্ষতা বাড়ানোর গুরুত্ব উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, বাংলাদেশের শ্রমিকরা সংখ্যায় বেশি হলেও আয়ে পিছিয়ে। বিদেশি ভাষা শেখা ও দক্ষতা বৃদ্ধিতে গুরুত্বারোপ করতে হবে। আমাদের শ্রমিকদের আরও প্রশিক্ষিত করে বিদেশে পাঠাতে হবে। হুন্ডির দৌরাত্ম্য কমাতে সরকারকে আরও শক্তিশালী ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানিয়ে তিনি প্রবাসী আয়কে বাড়াতে প্রণোদনা ও প্রযুক্তিভিত্তিক সুবিধা বাড়ানোর প্রস্তাব দেন। জনগণের স্বার্থে কর ব্যবস্থার উন্নয়ন ও সেবার মান বাড়াতে হবে এবং শিক্ষা ও স্বাস্থ্য খাতে কার্যকর সেবা নিশ্চিত করা জরুরি বলেও উল্লেখ করেন ফাহমিদা খাতুন। পাঠ্যবইয়ের বাইরের দক্ষতা অর্জনের প্রতি তরুণদের মনোযোগ বাড়ানোর আহ্বানও জানান তিনি।
বাংলাদেশ পরিসংখ্যান ব্যুরোর (বিবিএস) খাদ্যনিরাপত্তা পরিসংখ্যান ২০২৩–এর তথ্য অনুযায়ী, বাংলাদেশে গড়ে প্রতি পাঁচজনের মধ্যে অন্তত একজন খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার শিকার। সামপ্রতিক বছরগুলোয় এ পরিস্থিতিকে সঙ্গিন করেছে ডলার সংকট ও মূল্যস্ফীতি। চাপে পড়েছে কৃষি উৎপাদন ও খাদ্যনিরাপত্তা। সে হিসেবে বলা যায়, দেশের প্রায় ২২ শতাংশ মানুষ এখনো খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে।
বিশেষজ্ঞদের মতে, দেশের প্রধান খাদ্যশস্য চাল। সামপ্রতিক বছরগুলোয় খাদ্যশস্যটির উৎপাদন বৃদ্ধির হার জনসংখ্যা প্রবৃদ্ধি হারের নিচে নেমে গেছে। বিষয়টি খাদ্যনিরাপত্তা নিশ্চিতের পথে বড় চ্যালেঞ্জ হয়ে দাঁড়াবে বলে আশঙ্কা বিশ্লেষকদের। কৃষি মন্ত্রণালয়ের তথ্য বিশ্লেষণে উঠে এসেছে, গত তিন অর্থবছরে দেশে চালের উৎপাদন প্রবৃদ্ধির হার ছিল ১ শতাংশের নিচে। যদিও বিবিএসের পরিসংখ্যান অনুযায়ী, ২০২৩ সালে দেশে বার্ষিক জনসংখ্যা স্বাভাবিক বৃদ্ধির হার (আরএনআই) ছিল ১ দশমিক ৩৩ শতাংশ, যা আগের বছরে ছিল ১ দশমিক ৪ শতাংশ। এছাড়া আন্তঃশুমারি গড় জনসংখ্যা বৃদ্ধির হার ১ দশমিক ১২ শতাংশ।
চালের উৎপাদন প্রবৃদ্ধি এ মাত্রায় শ্লথ হয়ে আসার পেছনে বিশেষজ্ঞরা দায়ী করছেন আবাদি জমি হ্রাস ও কৃষিতে নতুন জনশক্তি যুক্ত না হওয়াকে। এ বিষয়ে তাদের বক্তব্য হলো, কৃষি খাতে কাঠামোগত পরিবর্তন ঘটছে অত্যন্ত দ্রুতগতিতে। আবাদি জমির পরিমাণ কমছে। উৎপাদন ব্যয় বৃদ্ধি ও ধানের কাঙ্ক্ষিত মূল্য না পাওয়ায় কৃষক অন্য ফসলে ঝুঁকছেন। আবার কৃষিতে যান্ত্রিকীকরণের গতিকে ধীর করে তুলছে ডলারের বিনিময় হারের অস্থিরতা। এ অস্থিরতার কারণে যান্ত্রিকীকরণে উৎপাদন ব্যয় কমার কথা থাকলেও সে সুযোগ নিতে পারছেন না কৃষক। এ অবস্থায় কৃষি ছেড়ে যাচ্ছেন অনেকেই।
বিবিএসের প্রতিবেদনের তথ্যমতে, শ্রেণীভিত্তিক বিভাজনে অতিদরিদ্রদের মধ্যে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতার হার ৭০ দশমিক ৩৭ শতাংশ। দরিদ্রদের মধ্যে ২২ দশমিক ৯ শতাংশ। মধ্যবিত্তদের মধ্যে এ হার ১৪ দশমিক ৮৮ শতাংশ। ধনীদের মধ্যে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভোগে ১ দশমিক ১১ শতাংশ। এ বিষয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পুষ্টি ও খাদ্যবিজ্ঞান ইনস্টিটিউটের এক অধ্যাপক বলেন, ‘খাদ্যের জোগান থাকার পরও প্রয়োজনীয় খাদ্য গ্রহণ করতে না পারলে তাকে খাদ্যনিরাপত্তাহীনতা বলা হয়। এখন আগের চেয়ে মূল্যস্ফীতি অনেক বেশি। আয় করার পরও মানুষ হয়তো জিনিসের দাম বাড়ার কারণে প্রয়োজনীয় পণ্য ক্রয় করতে পারছে না।’
বিশ্লেষকরা বলেন, ‘দেশের দারিদ্র্যসীমার নিচে রয়েছে ১৮ শতাংশ মানুষ আর ২২ শতাংশ মানুষ খাদ্যনিরাপত্তাহীনতায় ভুগছে। তার মানে দাঁড়াচ্ছে, যারা দারিদ্র্যসীমার ওপরে আছে তারাও উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে পড়ছে। স্বল্প আয়ের চাকরিজীবীদেরও ক্রয়ক্ষমতার ঘাটতি তৈরি হচ্ছে। তারা সঞ্চয় ভেঙে খাচ্ছে। এমনকি মধ্যবিত্তরা টিসিবির ট্রাকের পেছনে লাইনে দাঁড়িয়ে নিত্যপণ্য কিনতে বাধ্য হচ্ছে।’ তাই অভ্যন্তরীণ আয় বৃদ্ধির ওপর জোর দিতে হবে। দেশের অর্থনীতিকে শক্তিশালী করতে হলে অভ্যন্তরীণ আয় বাড়াতেই হবে।