ওরা কি এসেছিল?

সোহবাত খান গালিব | সোমবার , ২০ জানুয়ারি, ২০২৫ at ৭:২৬ পূর্বাহ্ণ

জাহেদুল আলমের সম্পাদনায় “নাট্যমঞ্চ” বতর্মানে চট্টগ্রামে একমাত্র নিয়মিত নাট্য পত্রিকা। “নাট্যমঞ্চ “ প্রকাশ করার পাশাপাশি নাট্যমঞ্চ রেপার্টরি নাটক প্রযোজনা করে আসছে। নাট্যমঞ্চ রেপার্টরি সমপ্রতি জাহেদুল আলমের রচনা ও নির্দেশনায় ‘ওরা আসবে ‘ প্রযোজনাটি মঞ্চে নিয়ে এসেছে। এতে তাদের পূর্বের প্রযোজনাগুলোর মতোই চট্টগ্রামের বিভিন্ন সংগঠনের নাট্যকর্মীরা অভিনয় করেছেন। নাটকটি ইতোমধ্যে নাট্যমঞ্চ পত্রিকার দশমতম সংখ্যায় প্রকাশিত হয়েছে।

ওরা আসবে নাটকটি গতানুগতিক আঙ্গিকে লিখিত নাটকের চেয়ে ভিন্নতর। সাধারণত আমরা নাটকের একটি দৃশ্যের পর আরেকটি দৃশ্য দেখে থাকি। কিন্তু এ নাটকে মঞ্চে একই সময়ে দুটি দৃশ্য মঞ্চায়িত হতে দেখা যায়। দুটি দৃশ্যের সংলাপও সমান্তরালভাবে প্রক্ষেপিত হতে দেখা যায়। এতে নাটকের ধারাবাহিকতা ও রস আস্বাদনে কোনো সমস্যা হয় না। মন্তাজ আঙ্গিকে একই সাথে কয়েকটি দৃশ্যের যে উপস্থাপন দেখতে পাওয়া যায় খানিকটা তার মত হলেও এর সংলাপ উপস্থাপন ভিন্নতর। মঞ্চে একই সাথে দুটি দৃশ্য চলছে এবং এক দৃশ্যের পাত্রপাত্রীর সংলাপের প্রতি সংলাপ অন্য দৃশ্যের পাত্রপাত্রী দিচ্ছে। এভাবেই দৃশ্য এগিয়ে যায়।

নাটকটিতে দেখা যায় একই পরিবারের দুই ভাই একজন শহুরে উচ্চ মধ্যবিত্ত অপরজন গ্রামের সাধারণ কৃষক। দুই পরিবারের যুগপৎ টানাপোড়েনে ঘটনা এগিয়ে যেতে থাকে। দুটি ভিন্ন পরিবারের জীবনযাপন ভিন্ন হলেও এক পরিবারের সকালের ঘটনায় যা যা ঘটে থাকে অন্য পরিবারে একই ঘটনার আবহ ভিন্নতর হলেও পারস্পরিক সংলাপের বিনিময়ে নাটক এগিয়ে যেতে থাকে। প্রথম কয়েকটি দৃশ্য এ আঙ্গিকে উপস্থাপিত হলেও শেষের দৃশ্যসমূহে এর ধারাবাহিকতা বজায় থাকেনি। অবশ্য এতে নাটকের ধারাবাহিকতায় কোন অসামঞ্জস্য তৈরি হয়নি।

নাটকের পাত্রপাত্রীরা চট্টগ্রামের বিভিন্ন সংগঠনের নতুন পুরাতন অভিনেতা। কারো মধ্যে জড়তা না থাকলেও পর্যাপ্ত মহড়ার অভাববাধ হয়েছে। নাটকের সংলাপ যেহেতু ভিন্ন ধারায় তাই সংলাপের উপর পূর্ণ দখল না থাকলে তা শ্রুতিকটু লাগে। মোহাম্মদ আলী টিটু, নাসরিন হীরা, জুয়েনা আফসানা মৈত্রী চৌধুরী, যার যার চরিত্রে সাবলীল। বাবা চরিত্রে সুশোভন চৌধুরি দ্বিতীয় প্রদর্শনীতে সুজিত দাম বাপ্পী যতটুকু সুযোগ পেয়েছেন তার পরিপূর্ণ ব্যবহার করেছেন। নাটকের ব্যাপ্তির সাথে সাথে তাদের চরিত্রের যে ব্যাপ্তি তাতে অসম্পূর্ণ মনে হয়ছে। মায়ের চরিত্রের উল্লেখ থাকলেও তাকে মঞ্চে না দেখায় তা যুক্তিযুক্ত মনে হয়নি। ছেলে চরিত্রে রিহাম খুবই ন্যাচারাল অভিনয় করেছেন। শহুরে ছেলে চরিত্রে সায়েমকে যথার্থ মনে হয়নি। সংলাপ ডেলিভারিতে তাড়াহুড়ো ও কোরিওগ্রাফিতে তালের মাত্রায় অসামঞ্জস্য মনে হয়েছে। শহুরে মেয়ে চরিত্রের অভিনেত্রীর আরও চর্চার প্রয়োজন আছে। গ্রামীণ আবহে পাত্রপাত্রীদের মীরসরাইয়ের কথ্যভাষা আরও চর্চায় প্রযুক্ত হলে নাটকের মান বৃদ্ধি করবে। প্রথম দৃশ্যের কোরিওগ্রাফি আরও পরিকল্পিতভাবে করলে তা দর্শককে নাটকে প্রবেশ করাতে সহায়ক হতে পারে। প্রথম প্রদর্শনীতে দুটি নাচ ২য় প্রদর্শনীতে হেমা বড়ুয়ার কোরিওগ্রাফিতে একটি নাচ খুব প্রসঙ্গিক মনে হয়নি। তবে নাচের অংশগ্রহণকারীরা তাদের কাজটুকু যত্ন নিয়ে করেছে।

সুবীর মহাজনের পরিমিত সেট ও আলোক পরিকল্পনা নাটকটির উপস্থাপনে গুরুত্বপূর্ণ সহায়ক ভূমিকা রেখেছে। দুটি ভিন্ন পরিপ্রেক্ষিতকে একই সাথে মঞ্চ বিশ্বাসযোগ্যভাবে তুলে ধরার জন্য যে পরিকল্পনা করেছেন তা প্রশংসনীয়। তবে গ্রামীণ আবহে পেছনের দরজাটির ব্যবহারে আরও চিন্তার সুযোগ রয়েছে। আলোক প্রক্ষেপণ যথাযথ না হলে তা দর্শকের মনোযোগ বিচ্ছিন্ন করে।

বর্তমানে চট্টগ্রামের নাট্য প্রযোজনার আবহ পরিকল্পনার জন্য মঈনুদ্দিন কোহেল এক অপরিহার্য নাম। তাঁর সুপরিকল্পিত আবহ নাটকের সৌন্দর্য বর্ধন করে। তবে প্রথম কোরিওগ্রাফিতে শহুরে নাচের অতি পরিচিত মিউজিকটির বিকল্পচিন্তা করা যেতে পারে। গ্রামে ঘোরার সময় ছোট ছেলের হাহাকার “আর গ্রাম কনডে” নারীকণ্ঠের ব্যবহারের কারণটি পরিষ্কার নয়। দুই ভাইয়ের গল্পচ্ছলে দোন (পানি সেচ) টানার অংশটি প্রয়োজন অপ্রয়োজনে যন্ত্রের ব্যবহারে গ্রামের ঐতিহ্যবাহী কৃষি কৌশলের হারিয়ে যাওয়াকে মনে করিয়ে দেয়।

নাট্যকার ও নির্দশক জাহেদুর আলমের অভিনব কৌশলে লিখিত নাটকটি স্বল্প ব্যাপ্তির হওয়ায় তা তৃপ্তি মেটায় না। তাছাড়া নাটকের শেষের দিকে যে দ্বন্দ্ব তৈরি হওয়ার সুযোগ ছিল তা আরও দীর্ঘায়িত হতে পারে কিনা তা ভেবে দেখার সুযোগ রয়েছে। যে সমাধানটি দেখানো হয়েছে তা কিছুটা তাড়াহুড়ো মনে হয়েছে। কোন দেশেতে তরুলতা কবিতাটি অন্যভাবে প্রয়োগ করা যায় কিনা তা নির্দেশক ভেবে দেখতে পারেন। বাবার চরিত্রের যে ব্যাপ্তি তাতে তাকে আরও দেখার আক্ষেপ রয়ে যায়। পুরো নাটকে গ্রামীণ ও শহুরে জীবনের টানাপোড়েন, শহরায়নের আগ্রাসী থাবা, পারিবারিক সম্পর্ক ও দেশপ্রেম মুখ্য বিষয় হিসেবে প্রতীয়মান হলেও নাটকের শিরোনাম ও শেষে শ্রুতিমধুর “সব কটা জানালা খুলে দাও না” গানটির ব্যবহার হলেও তা অপ্রাসঙ্গিক ও আরোপিত মনে হয়েছে। সম্ভাবনাময় নাটকটি সামনের প্রদর্শনীগুলোতে আরও ভাবনার খোরাক যোগাবে ও দর্শককে আলোড়িত করবে এ কামনা করতেই পারি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধরাশেদ রউফ এর অন্ত্যমিল
পরবর্তী নিবন্ধশ্যাম বেনেগাল: নবতরঙ্গের উজ্জ্বল জ্যোতিষ্ক