বিশিষ্ট অর্থনীতিবিদ ও সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেছেন, উন্নয়নকে সব সময় পরিবেশের বিপরীতে দাঁড় করানো হয়েছে। আইন যথাযথ বাস্তবায়নের অভাবে পরিবেশ সুরক্ষা কার্যক্রম বাধাগ্রস্ত হচ্ছে। এ জন্য সম্মিলিত প্রচেষ্টা ও উদ্যোগ প্রয়োজন। তবে সবার আগে এ বিষয়ে করণীয় নির্ধারণে বিশেষ কমিশন গঠন করতে হবে। বাংলাদেশ পরিবেশ আন্দোলনের (বাপা) ২৫ বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত দুই দিনের বিশেষ সম্মেলনের উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে রেহমান সোবহান এ কথা বলেন। শুক্রবার রাজধানীর শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসি মিলনায়তনে যৌথভাবে এ সম্মেলনের আয়োজন করে বাপা ও বাংলাদেশ পরিবেশ নেটওয়ার্ক।
একই অনুষ্ঠানের পৃথক অধিবেশনে পরিবেশ উপদেষ্টা সৈয়দা রিজওয়ানা হাসান বলেন, বাংলাদেশ আন্তর্জাতিক নদী আইনে স্বাক্ষর করতে যাচ্ছে। তিস্তা নিয়ে সরকার একটি মহাপরিকল্পনা চূড়ান্ত করে যাবে। উদ্বোধনী অনুষ্ঠানে রেহমান সোবহান বলেন, দেশের বিদ্যমান আইন ও আন্তর্জাতিক নিয়ম মানলেই পরিবেশ সুরক্ষা করা সম্ভব। অতি মুনাফা ও বাজার অর্থনীতি পরিবেশ ধ্বংসের মূল কারণ। তিনি বলেন, বাজার অর্থনীতির কারণে জমির অস্বাভাবিক মূল্য বেড়েছে। যে কারণে নদ–নদী, জলাভূমি ও বনভূমি দখল করে আবাসন নির্মাণ করা হচ্ছে। এতে পরিবেশ ধ্বংস হচ্ছে। এ ক্ষেত্রে কালোটাকার প্রভাবও দায়ী বলে উল্লেখ করেন তিনি।
পরিবেশ সুরক্ষায় অন্তর্বর্তী সরকার ইতিবাচক পদক্ষেপ নেবে বলে আশা প্রকাশ করেন রেহমান সোবহান। তিনি বলেন, পরিবেশ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্বপ্রাপ্ত উপদেষ্টা নিজেই একজন পরিবেশবিদ। তিনি পরিবেশ সুরক্ষায় ইতিমধ্যে ইতিবাচক উদ্যোগ নিয়েছেন। তবে বিভিন্ন ইস্যুতে সরকার কমিশন ও বিশেষ কমিটি গঠন করেছে। কিন্তু পরিবেশের মতো গুরুত্বপূর্ণ ইস্যুতে এখনো কোনো পদক্ষেপ নেওয়া হয়নি। এ বিষয়ে দ্রুত পদক্ষেপ গ্রহণের জন্য তিনি অন্তর্বর্তী সরকারের প্রতি আহ্বান জানান।
পরিবেশ সুরক্ষায় বাংলাদেশের নাগরিকদের সম্পৃক্ততার প্রশংসা করেন রেহমান সোবহান। তিনি বলেন, নাগরিক সম্পৃক্ততা থাকলেও অনেকেই ভিন্ন ভিন্ন প্ল্যাটফর্ম থেকে আন্দোলন করছে। ফলে দেশে অনেক যুগোপযোগী ও অত্যাধুনিক আইন থাকলেও যথাযথ বাস্তবায়নের অভাবে তার সুফল পাওয়া যাচ্ছে না। সুফল পেতে চাইলে সবাইকে একই মঞ্চে আনতে হবে। এর মাধ্যমে সরকারের প্রতি চাপ সৃষ্টি সহজ হবে।
বিশেষজ্ঞরা বলেছেন, জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে বিশ্ব আজ নানাধরনের প্রাকৃতিক বিপর্যয়ের সম্মুখীন হচ্ছে। তাপমাত্রার অস্বাভাবিক বৃদ্ধি এবং খরার মতো সমস্যাগুলো আমাদের জীবনে বিরূপ প্রভাব ফেলছে। জলবায়ুর বিরূপ প্রভাবে আমাদের এই সবুজ পৃথিবী ক্রমশই মরুকরণের দিকে এগিয়ে যাচ্ছে। জাতিসংঘের তথ্য অনুযায়ী, পরিবেশ বিপর্যয়ের ফলে প্রতি বছর বিশ্বের বিভিন্ন দেশের প্রায় দুই বর্গকিলোমিটার এলাকাতে মরুকরণ হচ্ছে। বাংলাদেশেও এ সমস্যাগুলো প্রকট আকার ধারণ করছে। এ অবস্থায় পরিবেশ সুরক্ষায় সবাইকে দায়িত্বশীল ভূমিকা পালন করতে হবে। তাঁরা বলেন, চলতি শতাব্দীতে পৃথিবী যে চরম বিপর্যয়ের সম্মুখীন হচ্ছে তার মূল হলো বিশ্ব উষ্ণায়ন। বিশ্ব উষ্ণায়নের জন্যে আবহাওয়া ও জলবায়ুতে পরিবর্তন আসার ফলে নানা প্রাকৃতিক দুর্যোগ বৃদ্ধি পাচ্ছে। বৃক্ষনিধন বন্ধ ও বৃক্ষরোপণে কার্যকর ভূমিকা রাখলে এই পৃথিবী সত্যিই বাসযোগ্য থাকবে।
বিশেষজ্ঞরা বলেন, পরিবেশ আজ বড়ই বিপন্ন। পরিবেশ বিপন্ন হওয়ার ফলে দেখা দিচ্ছে প্রাকৃতিক বিপর্যয়। মানবজীবনও হুমকিতে পড়েছে। পরিণামে জ্যামিতিক হারেই বাড়ছে পরিবেশ শরণার্থীর সংখ্যা।
পরিবেশ বিজ্ঞানী, পরিবেশবিদ এবং পরিবেশ দূষণের শিকার সচেতন জনগণের মতে, বৃক্ষ নিধন ছাড়াও প্রাণী বৈচিত্র্য রক্ষা না করা, রাসায়নিক সার ব্যবহার করা, কল–কারখানার বর্জ্য, পলিথিন ও পোড়া জ্বালানি, কালো ধোঁয়া, কীটপতঙ্গ ধ্বংস করা, বস্তির উদ্ভব, ঘনবসতি, ধূমপান, পানিতে মলমূত্র ও মৃত প্রাণীদেহ ফেলা, আর্সেনিক ও অপরিকল্পিত নগরায়ণ ও শিল্পায়ন, গাড়ির হর্ণ ও মিলকারখানার শব্দ এবং অসচেতনতা ও শিক্ষার অভাব সর্বোপরি আইন অমান্য করা ও দেশপ্রেমের অভাবই পরিবেশ দূষণের অন্যতম প্রধান কারণ হিসাবে কাজ করছে।
তাই সময় থাকতেই পরিবেশ সুরক্ষায় সম্মিলিত প্রচেষ্টা গ্রহণ করতে হবে। পরিবেশ বিপর্যয়ের ক্ষতিকারক উপাদানগুলোকে পরিহার করতে হবে এবং পরিবেশ রক্ষায় জোরালো পদক্ষেপ নিতে হবে। পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধে জনসচেতনতা বাড়ানো গেলে, আইনের যথাযথ প্রয়োগ হলে এবং সকলেই যার যার অবস্থান থেকে পরিবেশ দূষণ প্রতিরোধে কাজ করলে একটি বাসযোগ্য পৃথিবী গড়া সম্ভব।