কক্সবাজারে সংঘটিত খুলনার কাউন্সিলর গোলাম রাব্বানী টিপু হত্যাকাণ্ডের পুরো রহস্য উদঘাটন করতে সক্ষম হয়েছে পুলিশ। ‘কিলিং মিশন’ বাস্তবায়নে অংশ নিয়েছিলো আটজনের গ্রুপ। যেখানে ছিলেন নিহত রাব্বানীর নারী সঙ্গী ঋতুও। গ্রুপটি নিখুঁত ছক করে অত্যন্ত কৌশলে ‘কিলিং মিশন’ বাস্তবায়ন করেন। হত্যাকাণ্ডে ব্যবহৃত পিস্তলটি ছিলো আমেরিকার তৈরি। এই পিস্তলটি পাঁচটি গুলিসহ সরবরাহ করেন খুলনা শহরের দৌলতপুরের রায়হান শেখ নামের এক ব্যক্তি। পুলিশ বাদি হয়ে একটি পৃথক অস্ত্র মামলাও দায়ের করা হয়েছে। অন্যদিকে এই হত্যাকাণ্ডে গ্রেপ্তার আরেক কাউন্সিলর শেখ ইফতেখার হাসানের সম্পৃক্ততাও পেয়েছে পুলিশ।
হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার তিন আসামির আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দির উদ্ধৃতি দিয়ে কক্সবাজার সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. ইলিয়াছ খান এসব তথ্য জানিয়েছেন।
ওসি জানিয়েছেন, রাব্বানী হত্যায় মৌলভীবাজার থেকে গ্রেপ্তার হওয়া শাহরিয়ার ইসলাম, গোলাম রসুল ও ঋতু ১৫ জানুয়ারি রাতে কক্সবাজার সিনিয়র জুডিশিয়াল ম্যাজিস্ট্রেট আদালতে ১৬৪ ধারায় স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছেন। পুলিশের দায়ের করা অস্ত্র মামলার বিষয়ে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য শাহরিয়ার ও গোলাম রসুলের সাত দিনের রিমান্ড চাওয়া হয়েছে।
জবানবন্দিতে যা বললেন আসামিরা : জবানবন্দিতে শাহরিয়ার বলেন, ৯ জানুয়ারি সন্ধ্যা সাড়ে ৬টায় সি–গাল হোটেলের সামনের সমুদ্রসৈকতে ‘কিটকটে’ বসে আড্ডা দিচ্ছিলেন গোলাম রাব্বানী ও ঋতু। রাত আটটার দিকে কিটকট ছেড়ে দুজন সৈকত থেকে হেঁটে সিগাল হোটেলের দিকে যাচ্ছিলেন। ঋতু রাব্বানীর চার–পাঁচ কদম আগে আগে হাঁটছিলেন। পেছনে মুঠোফোনে কথা বলতে বলতে হাঁটছিলেন গোলাম রাব্বানী। আগে থেকেই গোলাম রাব্বানীকে নজরদারিতে রাখেন শাহরিয়ার। সৈকত থেকে পাকা সড়কে ওঠার জন্য গোলাম রাব্বানী যখন ঝাউবাগানের ভেতরে চলে আসেন, তখন সামনে এগিয়ে যান শাহরিয়ার। অন্ধকার রাতে পেছন দিক থেকে রাব্বানীর মাথায় পিস্তল ঠেকিয়ে একটি গুলি ছোড়েন শাহরিয়ার। সঙ্গে সঙ্গে মাটিতে লুটিয়ে পড়েন রাব্বানী। এরপর গোলাম রসুলকে সঙ্গে নিয়ে শাহরিয়ার রিকশায় উঠে চলে যান কক্স কুইন রিসোর্টে। আর ঋতু ও রিয়াজ নামের আরেকজন সরে পড়েন অন্যদিকে। চাচা চরমপন্থী নেতা শহীদুল হত্যার বদলা নিতে শাহরিয়ার রাব্বানীকে হত্যার পরিকল্পনা করেছিলেন। হত্যা পরিকল্পনায় যুক্ত ছিলেন আটজন। সবাই খুলনার বাসিন্দা।
আদালতে দেওয়া স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দিতে ঋতু বলেন, ৯ জানুয়ারি সন্ধ্যায় রাব্বানীকে নিয়ে তিনি হোটেল থেকে সমুদ্রসৈকতে যান। রাত আটটার দিকে রাব্বানীকে নিয়ে হেঁটে হোটেলের দিকে ফিরছিলেন। রাব্বানীর চার–পাঁচ কদম সামনে হাঁটছিলেন। হঠাৎ একটি গুলির শব্দ শুনতে পান। এরপর একমুহূর্তের জন্যও পেছনে ফিরে তাকাননি ঋতু। সোজা চলে যান ডলফিন মোড়ে। কারণ, তিনি জানতেন পরিকল্পনা অনুযায়ী রাব্বানীর মাথায় গুলি করেছেন শাহরিয়ার।
অস্ত্র প্রসঙ্গে কক্সবাজার সদর মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. ইলিয়াছ খান বলেন, গ্রেপ্তার তিনজনের স্বীকারোক্তি মতে, হত্যার ঘটনায় ব্যবহৃত অস্ত্রটি কক্স কুইন রিসোর্টের ২০৮ নম্বর কক্ষের একটি সানশেড থেকে উদ্ধার হয়েছে। পিস্তলের সঙ্গে চারটি গুলিও উদ্ধার করা হয়। উদ্ধার করা পিস্তলটির গায়ে ইংরেজিতে ‘মেড ইন ইউএসএ’ লেখা রয়েছে। এ ঘটনায় ১৫ জানুয়ারি কক্সবাজার সদর মডেল থানায় অস্ত্র আইনে একটি মামলা হয়েছে। মামলায় আসামি করা হয়েছে পাঁচজনকে। আসামিরা হলেন, শেখ শাহরিয়ার ইসলাম (২৭) ও গোলাম রসুল (২৫), রিপন প্রকাশ এলকো রিপন (৪৫), রায়হান শেখ (৩২) ও রিয়াজুল ইসলাম ২৭)। তাঁদের সবার বাড়ি খুলনা শহরের দৌলতপুরে।
জবানবন্দিতে হত্যায় ব্যবহৃত অস্ত্র সম্পর্কে শাহরিয়ার ইসলাম বলেন, রাব্বানী হত্যা পরিকল্পনার বিষয়টি তিনি খুলনার মিল্লাত হাজিকে জানান। মিল্লাত তখন জিজ্ঞাসা করে জিনিস (অস্ত্র) আছে কি না? জবাবে ‘আছে’ বলে প্রতিউত্তর দেন শাহরিয়ার। এরপর শাহরিয়ার যান তাঁর প্রয়াত চাচা হুজি শহীদুলের দেহরক্ষী রিপনের কাছে। রিপনের কাছে অস্ত্র চান শাহরিয়ার। রিপন অস্ত্র সরবরাহ করতে বলেন রায়হানকে। এরপর রায়হানের কাছ থেকে পাঁচটি গুলিসহ পিস্তলটি পান শাহরিয়ার। সেটি নিয়ে কক্সবাজারে চলে আসেন তিনি।
আসামিদের মধ্যে শাহরিয়ার ও গোলাম রসুল পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার হয়েছেন। দুজনকে অস্ত্র আইনে করা মামলায় সাত দিন করে রিমান্ড চেয়ে আদালতে আবেদন করেছে পুলিশ।
মামলার এজাহারে যা আছে : মামলার এজাহারে বলা হয়, আসামি শাহরিয়ার ইসলামের চাচা হুজি শহীদকে ২০১৫ সালে খুন করেন গোলাম রাব্বানীর লোকজন। এছাড়া আওয়ামী লীগ সরকারের আমলে বিভিন্ন হত্যা মামলায় শাহরিয়ারকে আসামি করে জেল খাটানো হয়। এর প্রতিশোধ নিতে একাধিকবার গোলাম রাব্বানীকে হত্যার পরিকল্পনা নিয়েও ব্যর্থ হন শাহরিয়ার। গত বছরের ৫ আগস্ট আওয়ামী লীগ সরকারের পতন ঘটলে গোলাম রাব্বানীকে হত্যার জন্য পরিকল্পনা করেন শাহরিয়ার ও রিয়াজ। রাব্বানী কক্সবাজারে বেড়াতে যাওয়ার খবর জেনে শাহরিয়ার ও রিয়াজ হত্যার ছক আঁকেন। ৭ জানুয়ারি গোলাম রাব্বানী কক্সবাজার বেড়াতে আসেন। ৯ জানুয়ারি কক্সবাজার আসেন শাহরিয়ার, এলকো রিপন, রায়হান শেখ ও রিয়াজুল ইসলাম। তাঁরা ওঠেন শহরের সৈকত বহুমুখী সমবায় সমিতির আবাসিক এলাকার কক্স কুইন রিসোর্টের দ্বিতীয় তলার ২০৮ নম্বর কক্ষে। রাত ৮টা ২০ মিনিট থেকে ৮টা ৩০ মিনিটের মধ্যে সৈকতের সুগন্ধা পয়েন্টের হোটেল সি–গালের পশ্চিম পাশে ফুটপাতের ওপর গোলাম রাব্বানীকে পিস্তল দিয়ে মাথায় গুলি করে হত্যা করেন শাহরিয়ার ইসলাম।
রাব্বানীর নারী সঙ্গী ঋতু সম্পর্কে আরো যা জানা গেলো : পুলিশ জানিয়েছে, খুলনা সিটির দৌলতপুরের শীলপাড়ার সেলিম আকনের মেয়ে ঋতু। এসএসসি পর্যন্ত পড়া ঋতু ২০১৫ সালে বিয়ে করেন। তাঁর স্বামী মাদকের ব্যবসা করতেন। ঋতুর নামেও দুটি মাদকের মামলা ছিল। ২০১৮ সালে আইনশৃক্সখলা রক্ষাকারী বাহিনীর সঙ্গে বন্দুকযুদ্ধে স্বামীর মৃত্যু হলে ২০১৯ সালে দ্বিতীয় বিয়ে করেন ঋতু। সংসারে তিন বছর বয়সী এক সন্তান রয়েছে তাঁর। ৮ জানুয়ারি সন্তানকে মায়ের কাছে রেখে ঋতু চলে আসেন কক্সবাজারে। রিয়াজ ও ঋতু একই এলাকার বাসিন্দা। রিয়াজের মাধ্যমে ঋতুর সঙ্গে পরিচয় হয় শাহরিয়ারের। বন্ধুত্ব রক্ষা করতে গিয়ে ঋতু রাব্বানী হত্যার পরিকল্পনায় জড়িয়ে পড়েন বলে জবানবন্দিতে উল্লেখ করেছেন।
হত্যায় আরেক কাউন্সিলর ইফতেখারের সম্পৃক্ততা : পুলিশ জানিয়েছে, গোলাম রাব্বানী হত্যার ঘটনায় খুলনা সিটির ১৬ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক কাউন্সিলর শেখ হাসান ইফতেখারের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। তিনি ওই ওয়ার্ড আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক। হত্যাকাণ্ডের রাতে র্যাব হোটেল গোল্ডেন হিলে অভিযান চালিয়ে ইফতেখারকে গ্রেপ্তার করে। একই সময়ে শহরের টেকপাড়ার নিজ বাসা থেকে গ্রেপ্তার করা হয় মেজবাহুল হক নামের আরেকজনকে।
জেলা পুলিশের মুখপাত্র ও অতিরিক্ত পুলিশ সুপার মো. জসিম উদ্দিন চৌধুরী বলেন, রাব্বানীর হত্যার ঘটনায় কাউন্সিলর ইফতেখারের সম্পৃক্ততা পাওয়া গেছে। পুলিশের হাতে গ্রেপ্তার অন্য আসামিরা প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে ইফতেখারের নাম উল্লেখ করেছেন। ইফতেখার ও মেজবাহুল হককে জিজ্ঞাসাবাদের জন্য আদালতে ১০ দিনের রিমান্ড আবেদন করে পুলিশ। এই আবেদনের শুনানিও আজ রোববার অথবা সোমবার হতে পারে।