পটিয়ায় পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের অপহরণ বাণিজ্য

৮ মাসে ৫০ জন অপহৃত হয় আতংকে খামারি ও বাগান মালিকরা, চাষাবাদ ব্যাহত

শফিউল আজম, পটিয়া | বুধবার , ১৫ জানুয়ারি, ২০২৫ at ৮:১২ পূর্বাহ্ণ

পটিয়া ও চন্দনাইশের পাহাড়ি অঞ্চলে পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের অপহরণ বাণিজ্য চলছে। এতে করে স্থানীয় খামারি ও বাগান মালিকরা আতংকে আছেন। স্থানীয় কৃষকসহ বিভিন্ন মহল সেখানে সেনা ও পুলিশ ক্যাম্প স্থাপনের দাবি জানিয়েছেন। গত ৮ মাসে পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা প্রায় ৫০ জন বাগান মালিক ও শ্রমিককে অপহরণ করে নির্যাতন ও মুক্তিপণ আদায়ের পর ছেড়ে দেয়। এছাড়া পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের হাতে একাধিক খুনের ঘটনাও ঘটেছে। পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের পাশাপাশি রাঙ্গুনিয়া উপজেলার পাহাড়ি এলাকার কিছু বাঙালিও অপহরণ বাণিজ্যে জড়িত রয়েছে বলে অভিযোগ স্থানীয়দের। সন্ধ্যা হলেই অপহরণকারীরা ভারী অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে লোকালয়ে আসে। শুষ্ক মৌসুম এলে ক্ষেতখামার, লেবু ও পেয়ারা বাগান এবং গাছ বাগানের মালিক ও শ্রমিকদের অস্ত্রের মুখে অপহরণ করে নিয়ে যায়। অপহরণকারীদের ওপর চালানো হয় নির্যাতন। পরে মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দেওয়া হয়। এতে করে পাহাড়ি খামারি ও বাগান মালিকরা আছেন আতঙ্কে। পাশাপাশি ক্ষোভও আছে। অপহরণের ঘটনায় স্থানীয়রা ভয়ে মুখ খুলতে সাহস পান না। অপহরণ আতংকে স্থানীয়রা নাম প্রকাশ না করলেও গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে তথ্য প্রদান করেন।

জানা গেছে, ১৩ জানুয়ারি পটিয়া উপজেলার হাইদগাঁও পাহাড়ের পূর্ব পাশে শসাক্ষেতে কাজ করার সময় সাদা পোশাকে অস্ত্রধারী সন্ত্রাসীরা খামারি ও শ্রমিকদের ঘিরে ফেলে। এ সময় কয়েকজন পালিয়ে গেলেও হাইদগাঁও এলাকার মনির আহমদের পুত্র মুজিবকে ধরে ফেলে। সন্ত্রাসীদের আস্তানায় নিয়ে গেলে মুজিব কৌশলে পালিয়ে যান। এর মধ্যে ৩০ হাজার টাকা মুক্তিপণ দিয়ে হামিদ মুক্তি পান। উপজেলার কেলিশহর খিল্লাপাড়াদারোগাহাট এলাকার মনছুর আলম ও মো. নাছের, উপজেলার মৌলভী বাজারের পূর্ব পাশে পাগলীর মুখ এলাকায় খামার ও লেবু বাগানে কাজ করার সময় দুজনকে পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা অস্ত্রের মুখে অপহরণ করে নিয়ে যায়। তাদের রাঙামাটির রাজস্থলী নিয়ে যাওয়ার পর মনসুর থেকে ৮০ হাজার টাকা ও নাছির থেকে ৪০ হাজার টাকা মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দেয়। ৩ জানুয়ারি বোয়ালখালীর করলডেঙ্গা এলাকার বাগান মালিক রুবেল ও তার ৪ জন শ্রমিক লেবু বাগানে কাজ করতে গেলে বিকাল ৫টায় সন্ত্রাসীরা তাদের অপহরণ করে নিয়ে যায়। এতে ৫ জন থেকে ৬০ হাজার টাকা মুক্তিপণ নিয়ে রাতের মধ্যে ছেড়ে দেয়।

১১ জানুয়ারি বিকাল ৫টায় চন্দনাইশের হাশিমপুর এবং কাঞ্চননগর এলাকা থেকে আহমদ হোসেন, মোহাম্মদ রহিম, রবিউল আলম, মোহাম্মদ কামাল, জুনাইদসহ ৫ জনকে পেয়ারা বাগান থেকে ফেরার পথে বান্দরবনের সন্ত্রাসীরা অপহরণ করে নিয়ে যায়। ওইদিন রাতে ১ লাখ ১০ হাজার টাকা মুক্তিপণ নিয়ে সন্ত্রাসীরা তাদের ছেড়ে দেয়।

২০২৪ সালের জুন মাসে পটিয়াচন্দনাইশের সীমান্ত এলাকা থেকে ৫ জন, ২০ মে কাঞ্চননগর এলাকা থেকে ৯ জনকে পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা অপহরণ করে নিয়ে যায়। ৩/৪ দিন পর মুক্তিপণ আদায় করে তাদেরকে ছেড়ে দেয়। গত বছর চট্টগ্রাম নগরীর সাবেক মেয়র মনজুর আলমের কেয়ারটেকার নুরুল আলমের পিতা আবদুছ ছত্তারকে অপহরণ করে নিয়ে ৪ দিন পর ১ লাখ ৭০ হাজার টাকা মুক্তিপণ নিয়ে ছেড়ে দেয়।

জানা যায়, বর্তমানে রাঙ্গুনিয়ার সরফভাটা পেকুয়া পাড়া, চেমিপাকা, মীরের খীল এলাকার কিছু সন্ত্রাসী এই অপহরণ বাণিজ্যে জড়িত হয়েছে। কল্লাকাটা কামালের নেতৃত্বে একটি গ্রুপ এই অপহরণ বাণিজ্য চালাচ্ছে। রাঙামাটির চাকমাদের একটি গ্রুপ পাতা রঙের পোশাকে, বান্দরবনের মারমা গ্রুপ বিডিআরের পোশাকে, ত্রিপুরার গ্রুপ সাদা পোশাকে এসে লোকজনকে অপহরণ করে নিয়ে যায়। অপহরণকারীরা অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে চোখমুখ বেঁধে অজ্ঞাত স্থানে নিয়ে বন্দি রাখে। বাড়িতে খবর দিয়ে দালালের মাধ্যমে টাকা আদায়ের পর তাদের ছেড়ে দেয়। পটিয়ারাঙ্গুনিয়া সীমান্তে কমলাছড়ি এলাকায় একটি গ্রুপ মদ তৈরি করে। এই মাদক ব্যবসায়ী থেকে সন্ত্রাসীরা মোটা অংকের চাঁদা নেয় বলে জানা গেছে।

ভুক্তভোগীরা জানান, কেলিশহর ছত্তার পেটুয়ার পূর্ব পাশে মৌলভী বাজার এলাকা, খরনা কমচতর এলাকা ও কাঞ্চননগরের চা বাগান এলাকায় যৌথবাহিনীর অভিযান এবং সেনাবাহিনী ও পুলিশের ক্যাম্প স্থাপন করা হলে পাহাড়ি সন্ত্রাসীদের অপহরণ বাণিজ্য বন্ধ হতে পারে। তারা বলেন, এত অপহরণের ঘটনা, কিন্তু প্রশাসনে অভিযোগ দিলেও কোনো কাজ হয় না।

পটিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার ফারহানুর রহমান বলেন, বিষয়টি নিয়ে জেলা আইনশৃঙ্খলা মিটিংয়ে আলোচনা হয়েছে। একটি টাস্কফোর্স গঠন করে বিষয়টি কীভাবে সমাধান করা যায় এ বিষয়ে একটি সিদ্ধান্ত নেওয়ার পরিকল্পনা রয়েছে।

পটিয়া থানার ওসি আবু জায়েদ মোহাম্মদ নাজমুন নূর বলেন, পাহাড়ি সন্ত্রাসীরা ভারী অস্ত্রে সজ্জিত। তাদের প্রতিরোধে যৌথ বাহিনীর অভিযানের প্রয়োজন রয়েছে। ইতোমধ্যে বেশ কিছু অপহরণের ঘটনা শুনেছি। তবে কেউ অভিযোগ দেয়নি।

পূর্ববর্তী নিবন্ধতল্লাশিকালে পুলিশের উপর হামলা, গ্রেপ্তার ২
পরবর্তী নিবন্ধসাবেক ডেপুটি গভর্নর এস কে সুর গ্রেপ্তার, কারাগারে প্রেরণ