পর্ব ৪
আজকের চতুর্থ পর্বে আমরা জানব এমন দশজন নারীর কথা যারা প্রত্যেকেই তাদের নিজ নিজ ক্ষেত্রে অনন্য। তাদের কেউ চিকিৎসক, কেউ কমেডিয়ান, কেউ ক্রীড়াবিদ, কেউবা আইনজীবী কিংবা খনি শ্রমিক! চলুন তাহলে শুরু করি আজকের পর্ব যুক্তরাষ্ট্রের কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বা এআই বিশেষজ্ঞ স্নেহা রেভানুর–এর সাথে।
কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা বিশেষজ্ঞ স্নেহা রেভানুর, যুক্তরাষ্ট্র
মাত্র কুড়ি বছর বয়স স্নেহা রেভানুরের, এরমধ্যেই কৃত্রিম বুদ্ধিমত্তা(অও) ক্ষেত্রে বেশ এগিয়ে গছেন তিনি। স্নেহা এনকোড জাস্টিস নামের একটি বৈশ্বিক যুব আন্দোলনের প্রতিষ্ঠাতা। এটি সুরক্ষিত ও ন্যায্য এআই নিশ্চিতের বিষয়ে কাজ করছে। ত্রিশটি দেশে এর সদস্য সংখ্যা প্রায় দেড় হাজার। রেভানুরের কাজ উদীয়মান প্রযুক্তির দ্বারা সৃষ্ট হুমকি প্রশমিত করার চেষ্টা করেন এবং তরুণদের সমালোচনামূলক কথোপকথনে অন্তর্ভুক্ত করে। স্নেহা স্ট্যানফোর্ড ইউনিভার্সিটির শিক্ষার্থী এবং সেন্টার ফর এআই অ্যান্ড ডিজিটাল পলিসির গ্রীষ্মকালীন ফেলো। সমপ্রতি তিনি টাইম ম্যাগাজিনের এআই বিষয়ে একশ প্রভাবশালী ব্যক্তির তালিকায় সর্বকনিষ্ঠ হিসেবে অন্তর্ভুক্ত হয়েছেন।
চিকিৎসক সাফা আলী, সুদান
২০২৩ সালে সুদানে তার হাসপাতালের কাছে প্রচন্ড যুদ্ধ শুরু হলে, চিকিৎসক সাফা আলি তার সহকর্মীদের সাথে পালানোর সুযোগ থাকা সত্ত্বেও হাসপাতালে রয়ে যান। একজন প্রসূতিবিদ ও গাইনোকলজি বিশেষজ্ঞ হিসেবে তিনি স্বেচ্ছাসেবী কর্মী এবং গর্ভবতী নারীদের নিরাপদ স্থানে সরিয়ে নিতে সহায়তা করতে শুরু করেন। প্রচন্ড গোলাগুলি এবং সেনাবাহিনী ও আধা–সামরিক র্যাপিড সাপোর্ট ফোর্সের সহিংস সংঘর্ষের মধ্যে জীবনবাজি রেখেই তিনি এই কাজ পরিচালনা করেন। বর্তমানে আল– সৌদি ম্যাটারনিটি হাসপাতালে প্রসূতিবিদ হিসেবে তিনি সিজারিয়ান অপারেশন করেন এবং চলমান সংঘাতের চ্যালেঞ্জ সত্ত্বেও নারীদের স্বাস্থ্য সমস্যা মোকাবেলা করেন। পাশাপাশি, তিনি প্রায় কুড়িজন নতুন স্নাতক নারী চিকিৎসককে প্রশিক্ষণ দিয়েছেন, যা চিকিৎসা কর্মীর ঘাটতি কমাতে সাহায্য করে।
খনি শ্রমিক অ্যানি সিনানদুকু মওয়াঙ্গে, ডেমোক্রেটিক
রিপাবলিক অফ কঙ্গো
কঙ্গোর খনিতে একজন শ্রমিক হিসাবে কাজ শুরু করে খনি ব্যবসায়ে একজন নারী উদ্যোক্তা হিসেবে নিজেকে তুলে ধরা অ্যানি সিনানদুকু মওয়াঙ্গে শিল্প কারাখানা কিংবা খনিতে বৈষম্য ও যৌন হয়রানির বিরুদ্ধে স্থানীয় পর্যায়ে আন্দোলন চালিয়ে যাচ্ছেন, কেননা কঙ্গোর খনিগুলোতে কর্মরত শ্রমিকদের অর্ধেকই নারী। জাতীয় নারী খনি নেটওয়র্ক ‘ ‘রেনাফেমে’র নেতা হিসেবে তিনি নিজেকে ‘মের বস’ বা ‘মা বস’ হিসেবে প্রতিষ্ঠিত করেছেন। তার উদ্যোগ এবং আন্দোলনের ফলে এখন নারীদের খনি পরিচালনার দায়িত্বে নিযুক্ত করা হচ্ছে যা পুরুষ সহকর্মীদের দ্বারা যৌন শোষণ প্রতিরোধে বেশ কার্যকর ভূমিকা রাখছে। নারীদের জীবিকা নির্বাহের জন্য বিনিয়োগ করে তিনি শিশু শ্রম হ্রাসের বিষয়েও বেশ আশাবাদী।
সমাজকর্মী জোয়ানা বাহামন, কলোম্বিয়া
কলম্বিয়ার একটি কারাগার পরিদর্শনে যান অভিনেত্রী জোহানা বাহামন, আর তারপরই তার জীবন যেন বদলে যায়! কারান্তরীন জীবনে যারা ‘আরেকটি সুযোগ’ পেতে চায় তাদের জন্য কাজ করতে অনুপ্রাণিত হয়ে উঠেন বাহামন। আর তাই ২০১২ সালে তিনি অভিনয়ের পাট চুকিয়ে কারাগার সংস্কারের পক্ষে কাজ শুরু করেন এবং ফান্ডাসিয়ন অ্যাকসিয়ন ইন্টার্না নামে একটি অলাভজনক প্রতিষ্ঠান প্রতিষ্ঠা করেন যা কলোম্বিয়ার কারাগারের বন্দি এবং মুক্তিপ্রাপ্তদের নানাবিধ সহযোগিতা করে থাকে। ইতমধ্যে প্রতিষ্ঠানটি কলম্বিয়াজুড়ে দেড় লাখের বেশি মানুষ এবং ১৩২টি কারাগারে সেবা পৌঁছে দিয়েছে বলে জানা যায়। ২০২২ সালের ‘সেকেন্ড অপরচুনিটিজ ল’–এর প্রবর্তকও তিনি যা ‘জোহানা বাহামন বিল’ নামে পরিচিত এবং যা কারাগার থেকে মুক্ত হওয়া ব্যক্তিদের কর্মসংস্থান এবং প্রশিক্ষণের ব্যবস্থার পাশপাশি আর্থিক প্রণোদনা দিয়ে থাকে।
জলবায়ু আইনজীবী আদেনিকে টিটিলোপে ওলাদোসু, নাইজেরিয়া
নাইজেরিয়ার ইকো–ফেমিনিস্ট আদেনিকে টিটিলোপে ওলাদোসু ‘আই লিড ক্লাইমেট অ্যাকশন’–এর প্রতিষ্ঠাতা, যা নারী এবং তরুণদের জলবায়ু পরিবর্তনের বিরুদ্ধে লড়াই করার জন্য একটি তৃণমূল পর্যায়ের উদ্যোগ। তিনি নাইজেরিয়ার চাদ হ্রদের পরিবেশগত সংকট সম্পর্কে সচেতনতা বাড়াতে কাজ করেছেন। ওলাদোসু তার কাজের মাধ্যমে পরিবেশগত এবং সামাজিক উভয় সমস্যার সমাধান করেন, বিশেষত যা আফ্রিকান নারীদের প্রভাবিত করে। তিনি মরুকরণের কারণে খাদ্য নিরাপত্তা ঝুঁকিতে থাকা অঞ্চলে টেকসই কৃষিতে নারীদের দক্ষতা বৃদ্ধিতে কাজ করছেন। ২০১৯ সাল থেকে জাতিসংঘের জলবায়ু পরিবর্তন নিয়ে বেশ কয়েকটি সম্মেলনে অংশ নিয়ে তিনি নীতিনির্ধারকদের আফ্রিকায় জলবায়ু সহনীয়তায় অগ্রাধিকার দেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন।
যৌনকর্মীদের অধিকার বিষয়ক ক্যাম্পেইনার
লুরদেস বারেতো, ব্রাজিল
ব্রাজিলে যৌনকর্মীদের অধিকারের জন্য অগ্রণী প্রচারাভিযানের নেতৃত্বদানকারী লুরদেস বারেতো তার জীবন যৌনকর্মীদের অধিকার উন্নয়নে নিবেদন করেছেন। আমাজন অঞ্চলের বেলেম দো পারা–তে তার কর্মজীবন শুরু করে, তিনি ১৯৮০–এর দশকে ব্রাজিলিয়ান নেটওয়ার্ক অফ প্রস্টিটিউটস–এর সহ–প্রতিষ্ঠা করেন। যা লাতিন আমেরিকার যৌনকর্মীদের প্রথম সংগঠিত আন্দোলনগুলির মধ্যে একটি। বর্তমানে বারেতো কয়েক দশক ধরে কুসংস্কারের বিরুদ্ধে লড়াই করে আসছেন। এইচআইভি প্রতিরোধ নীতিমালা তৈরিতে তিনি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করেন এবং স্বর্নের খনিতে কর্মরত সমপ্রদায়ের মধ্যে এইচআইভি বিস্তার প্রতিরোধের জন্য প্রচারণা চালিয়ে থাকেন। ২০২৩ সালে তার একটি আত্মজীবনী প্রকাশিত হয়েছে।
অলিম্পিক শ্যুটার কিম ইয়েজি, দক্ষিণ কোরিয়া
তার দক্ষতা, স্থির মনোভাব এবং বৈজ্ঞানিক কল্পকাহিনীর আদলের লুক! লক্ষ্য নির্ধারণে সাহায্য করার জন্য বিশেষ চশমা…সব মিলিয়ে কিম ইয়েজির ভিডিও সোশ্যাল মিডিয়ায় ভাইরাল হয়ে যায়। শ্যুটিংয়ে বিশেষ অর্জন এবং নিজস্ব কারিশমা দিয়ে কিম গত বছর বিশ্বের নজরে এসেছে। তার প্রথম অলিম্পিকে মহিলাদের ১০ মিটার এয়ার পিস্তল শুটিং–এ রৌপ্যপদক জিতেছিলেন। এর কয়েক মাস আগেই তিনি মহিলাদের ২৫ মিটার পিস্তল শুটিং–এ বিশ্ব রেকর্ড স্থাপন করেছিলেন। কিম ইয়েজি মাতৃত্বের সাথে সম্পর্কিত দায়িত্ব সম্পর্কে বেশ খোলামেলা কথা বলে থাকেন। তিনি তার ছয় বছর বয়সী মেয়ের সঙ্গে সময় কাটানোর জন্য খেলা থেকে সাময়িক বিরতিও নিচ্ছেন।
শিল্পী ট্রেসি এমেন, যুক্তরাজ্য
নব্বইয়ের দশকে ট্রেসি এমেন ‘মাই বেড’ এবং ‘দ্য টেন্ট’–এর মতো সাহসী কাজের জন্য পরিচিতি পান। দুটো সিরিজই মানুষকে তাদের যৌন অভিজ্ঞতাকে বিশ্লেষণ করার জন্য আমন্ত্রণ জানায়। তখন থেকেই শিল্প জগতে তিনি একটি পরিচিত নাম হয়ে উঠেন, তার স্বীকারোক্তিমূলক এবং আত্মজীবনীর আদলে করা কাজের জন্য তিরি আলোচিত হয়েছেন। মিডিয়ায় বিতর্কের ঝড় তোলা ‘মাই বেড’ সিরিজটি লন্ডনে প্রদর্শনীর ২৫ বছর পার হয়েছে। একসময় ব্রিটিশ শিল্পকলার ভিলেন চরিত্র হিসেবে চিত্রিত এমেনকে এবছর রাজা চার্লস ভিজ্যুয়াল আর্টে অবদানের জন্য ‘ডেম’ উপাধিতে ভূষিত করেছেন। তিনি যুক্তরাজ্যে ‘মার্গেটে ট্রেসি এমেন ফাউন্ডেশন’ প্রতিষ্ঠা করেছেন যা নতুন প্রতিভা খুঁজে বের করতে সহায়ক ভূমিকা রাখছে।
মেডিক্যাল অনকোলজিস্ট (ক্যান্সার বিশেষজ্ঞ)
জর্জিনা লং, অস্ট্রেলিয়া
টার্গেটেড থেরাপি এবং ইমিউন–অনকোলজির মাধ্যমে, জর্জিনা লং এমন একটি বিশ্ব দেখতে চান যেখানে ক্যান্সারে আর মৃত্যু হবে না। মেলানোমা ইনস্টিটিউট অস্ট্রেলিয়ার সহ পরিচালক হিসেবে, জর্জিনা ২০২৪ সালে সমন্বিত চিকিৎসা মডেল প্রণয়ন করে খ্যাতি অর্জন করেন। এই চিকিৎসা তার সহকর্মী এবং বন্ধু রিচার্ড স্কলিয়ারের জীবন বাঁচাতে সহায়ক হয়, যিনি একটি অত্যন্ত আক্রমণাত্মক ধরণের মস্তিষ্কের ক্যান্সারে আক্রান্ত হয়েছিলেন। লং এবং তার দল, যার মধ্যে রোগী নিজেও অন্তর্ভুক্ত থাকেন, তারা আবিষ্কার করেন যে ইমিউনোথেরাপিতে যখন টিউমার অপসারণের আগে ওষুধের একটি সংমিশ্রণ প্রয়োগ করা হয় তখন সেটি সবচেয়ে কার্যকর পদ্ধতি। তাদের অত্যাধুনিক কাজ, মেলানোমা বিষয়ে বহু বছরের গবেষণা থেকে প্রাপ্ত, যা ত্বকের ক্যান্সারে আক্রান্ত হাজারো রোগীর জীবন রক্ষা করছে।
কমেডিয়ান নাওমি ওয়াতানাবে, জাপান
জাপানের অন্যতম জনপ্রিয় ইনফ্লুয়েন্সার নাওমি ওয়তানাবে নারীদের জন্য কমেডি জগতে এক নতুন অধ্যায়ের সূচনা করেছেন। পুরুষ–প্রধান জাপানি কমেডিতে নারীদের জন্য সুযোগ তৈরি করেছেন এবং জনপ্রিয় ‘স্কেচ শো’ তৈরি করেছেন। ওয়াতানাবে জাপানে শরীর সংক্রান্ত বিশেষ করে নারী শরীরের প্রতি দৃষ্টিভঙ্গি পরিবর্তন আনতেও কাজ করছেন। তিনি ‘পোচাকাওয়াই’ নামে শরীরভিত্তিক একটি ইতিবাচক আন্দোলনের নেতৃত্ব দিচ্ছেন, যার অর্থ ‘মোটা এবং সুন্দর’। তিনি জাপানে প্লাস–সাইজের পোশাকের প্রথম ব্র্যান্ড চালু করেন। জাপানি টিভি এবং চলচ্চিত্রে দুর্দান্ত সাফল্য অর্জনের পর, তিনি এখন বিশ্বব্যাপী কমেডি মঞ্চে নিজের জায়গা করে নিতে বিশ্বভ্রমণে আছেন।
ক্রমশ…