চট্টগ্রামের পাহাড়, প্রকৃতি ও পরিবেশ মহান স্রষ্টার অকৃত্রিম দান। বাগান–উদ্যান, পার্ক, সবুজ গাছপালা ও ফাঁকা খোলা জায়গা ইত্যাদি নাগরিকদের জন্য এক মৌলিক প্রয়েজনীয় চাহিদা। নগরবাসীর জন্য এটি এক মৌলিক অধিকারও বটে। নগর জীবনের কোলাহলময় ব্যতিব্যস্ত জীবনধারায় এইসব পার্ক বা উদ্যান ছোটো বড় সকলের জন্য শান্তিময় প্রাকৃতিক অবসর বিনোদন স্থল। এসব পার্ক বা উদ্যান নগরবাসীদের নন্দনতাত্ত্বিক স্বস্তি জোগায়, তাদের সুস্বাস্থ্য নিশ্চিত করে, আয়ু বৃদ্ধি করে, ভ্রমণ বিলাসী বক্তিদেরকে আকৃষ্ট করে, তাদের আনন্দ দান করে এবং তাদের নৈতিক মূল্যবোধ বজায় রেখে দৈহিক ও মানসিক বিকাশে সহায়ক হয়। বড় ধরনের সংকট এড়িয়ে, কংক্রিটসম পরিবেশের মাঝে এ পার্কগুলো শ্যামল মরু–উদ্যানের মতো স্বস্তি জোগায়। তাই পাহাড়, প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষা করা নাগরিকদের দায়িত্ব। কিন্তু দুঃখের বিষয়, চট্টগ্রামের পাহাড় কাটা রোধ করা যাচ্ছে না, প্রকৃতি ও পরিবেশ আজ বিপন্ন প্রায়। তাই নগরীর ১০৫ জন পরিবেশ ও মানবাধিকার আইনবিদ চট্টগ্রামে নয়নাভিরাম টিলা ও পাহাড় কর্তন, নদী ও খাল দখলের মাধ্যমে সবুজ প্রকৃতির যে অবাধ ধ্বংসযজ্ঞ চলছে অবিলম্বে তা রুখে দিতে নোবেল জয়ী প্রফেসর ড. মুহাম্মদ ইউনুস সরকারের প্রতি জোর দাবি জানিয়েছেন। তাঁরা বলেছেন, ‘চট্টগ্রাম মহানগর ও জেলার প্রায় সর্বত্র নানা কৌশলে নালা, টিলা ও পাহাড় নিধন এবং নদী ও খাল দখলের উৎসব চলছে। প্রশাসনের নাকের ডগার উপর এসব অবৈধ কর্মকাণ্ড বেপরোয়া গতিতে চলছে। কোন কোন ক্ষেত্রে এসব বেআইনী কর্মকাণ্ডে প্রশাসনের দুর্নীতিবাজ ব্যক্তিরা তাদের পৃষ্ঠপোষকতা করছে মর্মে অভিযোগ পাওয়া যাচ্ছে। বিশেষ করে চট্টগ্রাম মহানগরে জামালখানস্থ আসকার দীঘি এলাকায় ভুল রেকর্ডের ভিত্তিতে পাহাড়কে বাড়ি শ্রেণি দেখিয়ে চউক এর কথিত অনুমোদন নিয়ে পাহাড় কেটে দালান নির্মাণ কাজ চালিয়ে যাচ্ছে। এক্ষেত্রে চউক অনুমোদনের শর্ত অনুযায়ী পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র আবশ্যকীয় হলেও নির্মাণকারীরা তার কোন তোয়াক্কা করছে না। এমনকি তারা পরিবেশ অধিদপ্তরকে ম্যানেজ করে ছাড়পত্র প্রয়োজন নেই মর্মে সম্প্রতি একখানা পত্র যোগাড় করে মর্মে অভিযোগ পাওয়া গেছে। এইভাবে প্রভাবশালী কতিপয় চক্র চট্টগ্রামের বিভিন্ন জায়গায় পাহাড় কর্তনের মাধ্যমে চট্টগ্রাম মহানগরীকে একটি শ্রীহীন ইট পাথরের জঞ্জালের নগরীতে পরিণত করছে। যা নগরীর প্রকৃতি ও পরিবেশের বিরাট ক্ষতির কারণ ঘটাচ্ছে। তাই এই বিষয়ে দ্রুত ও কার্যকর ব্যবস্থা গ্রহণ করা না হলে প্রফেসর ড. ইউনূসের থ্রি জিরোর ধারণার বাস্তবায়নকে দুরূহ করে তুলবে।’
পরিবেশবিদ ও সংশ্লিষ্টদের অভিযোগ–দিনের পর দিন পাহাড় কেটে নগরীতেও বসতি নামের মৃত্যুপুরী গড়ে তোলা হলেও তা নিয়ে পরিবেশ অধিদপ্তরের যেন কোন মাথা–ব্যথাই নেই। অথচ পাহাড় কাটা রোধ ও বিপন্ন হওয়া থেকে পরিবেশ রক্ষায় সরকারের আইনগত প্রতিষ্ঠান এটি। যতক্ষণ তৃতীয় কোনো ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান থেকে অভিযোগ না আসে কিংবা গণমাধ্যমে রিপোর্ট না আসে ততক্ষণ পর্যন্ত প্রকাশ্যে পাহাড় কাটার ধূম চললেও তাদের তেমন পদক্ষেপ চোখে পড়ে না। যদিও এ অভিযোগ সত্য নয় বলে দাবি পরিবেশ অধিদপ্তরের। পাহাড় কাটা প্রতিরোধে কার্যকর ভূমিকা রাখতে না পারার নেপথ্যে পরিবেশ অধিদপ্তরের বিভিন্ন সীমাবদ্ধতাকেই বড় করে দেখেন পরিবেশবিদরা। তাঁরা বলেন, ক্ষমতাশালী লোক যদি পাহাড় কাটে তাহলে অধিদপ্তরের কতটুকুইবা করার মতো থাকে। তাই অধিদপ্তরের পদক্ষেপকে ছোট করে দেখাটা ঠিক হবে না। একথাও অস্বীকার করা যাবে না যে, নগরায়ণের চাপে জলাভূমি হারিয়ে যেতে বসেছে। প্রাকৃতিক জলাধার সংরক্ষণ আইন–২০০০ অনুযায়ী কোনো পুকুর–জলাশয়, নদী–খাল ভরাট করা বে–আইনি কিন্তু আইন অমান্য করে বহু প্রভাবশালী ব্যক্তি ও প্রতিষ্ঠান প্রাকৃতিক জলাভূমি ধ্বংস করে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট করছেন। নতুন নতুন আবাসনের চাহিদা পূরণ করতে গিয়ে খাল–বিল–পুকুর ভরাট করা হচ্ছে। যারা ভরাট করছে, তারা পরিবেশের কথা চিন্তা করে না। এমনকি অপরিকল্পিত নগরায়ণও পুকুর ও খাল–বিলের সংখ্যা কমে যাওয়ার পেছনে ভূমিকা রাখে। তাই দখলদারিত্বের দৌরাত্ম্য বন্ধ করতে হবে। নাগরিকদের পরিবেশ রক্ষায় সচেতন করে তুলতে হবে। এই পরিস্থিতি থামাতে বৈষম্য বিরোধী সরকারের জরুরি হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন মানবাধিকার আইনবিদগণ। আমরাও মনে করি, তাঁদের এ দাবি যৌক্তিক। তাই চট্টগ্রামের পাহাড়, প্রকৃতি ও পরিবেশ রক্ষায় সরকারকে কঠোর হতে হবে।