ব্যাংক ঋণের চড়া সুদ, শিল্পায়ন ও বিনিয়োগে স্থবিরতা

বেড়েছে ব্যবসা পরিচালনার ব্যয় কর্মসংস্থান আমদানি-রপ্তানিতে নেতিবাচক প্রভাব

হাসান আকবর | শুক্রবার , ১০ জানুয়ারি, ২০২৫ at ৯:৪২ পূর্বাহ্ণ

ব্যাংক ঋণের চড়া সুদ হারের কারণে দেশের বিনিয়োগ ও শিল্পায়ন থমকে যাওয়ার শংকা প্রকাশ করা হয়েছে। ব্যাংকগুলো প্রচুর মুনাফা করলেও থেমে গেছে নতুন বিনিয়োগ ও শিল্পায়ন। ঋণের সুদের হার প্রায় দ্বিগুণের কাছাকাছি গিয়ে ঠেকায় দেশে ব্যবসা পরিচালনার ব্যয় বহুলাংশে বৃদ্ধি পেয়েছে। এতে কর্মসংস্থান ও আমদানিরপ্তানি বাণিজ্যে নেতিবাচক প্রভাবের পাশাপাশি বেড়ে যাচ্ছে মূল্যস্ফীতি। অথচ মূল্যস্ফীতি কমানোর দোহাই দিয়ে বাড়ানো হয়েছে ব্যাংকের সুদের হার। বিদ্যমান পরিস্থিতি লাগাতার হলে ব্যবসা বাণিজ্যে স্থবিরতার শংকাও প্রকাশ করা হয়েছে।

সূত্র জানিয়েছে, মূল্যস্ফীতি নিয়ন্ত্রণের কথা বলে আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল (আইএমএফ) দেশে ব্যাংকের সুদের হার বাড়ানোর জন্য চাপ দিয়ে আসছিল। এরই প্রেক্ষিতে দফায় দফায় ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাড়ায় বাংলাদেশ ব্যাংকে। যার ফলে রেপো রেট বা নীতি সুদহার ৫ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে ১০ শতাংশ করা হয়। ব্যাংক ঋণের সুদহার সর্বোচ্চ ৯ শতাংশ থেকে বাড়িয়ে প্রায় ১৬ শতাংশে গিয়ে ঠেকে। এতে দেশে ব্যবসা পরিচালনার ব্যয় বা কস্ট অব ডুইং বিজনেস অনেক বেড়ে গেছে। যা প্রত্যক্ষভাবে মূল্যস্ফীতি বাড়িয়ে দিচ্ছে বলে মন্তব্য করে সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলেছে, দেশে মূল্যস্ফীতি ১২ শতাংশ ছুঁই ছুঁই করছে।

চড়া মূল্যস্ফীতিতে ব্যাংক ঋণের সুদের হার বাড়ানোয় দেশের সাধারণ মানুষের উল্লেখ করার মতো উপকার না হলেও ব্যাংকগুলো পরিচালন মুনাফায় রেকর্ড সৃষ্টি করেছে। এক বছরের ব্যবধানে কোনো কোনো ব্যাংকের মুনাফা অর্জনের প্রবৃদ্ধি ৭০ শতাংশেরও বেশি ছাড়িয়ে গেছে। ইতোমধ্যে বিভিন্ন ব্যাংক বছর শেষে হিসেব নিকেশ কষে যেই হিসেব প্রকাশ করেছে তাতে ব্র্যাক ব্যাংক ২০২৪ সালে পরিচালন মুনাফা করেছে প্রায় ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকা। ২০২৩ সালে ব্যাংকটির পরিচালন মুনাফা ছিল ১ হাজার ৩৯৩ কোটি টাকা। অর্থাৎ গত বছর ব্র্যাক ব্যাংকের পরিচালন মুনাফায় প্রবৃদ্ধি ৭২ দশমিক ২৯ শতাংশ।

ব্র্যাক ব্যাংকের পরেই রেকর্ড পরিমাণ পরিচালন মুনাফা করেছে পূবালী ব্যাংক। এই ব্যাংক সদ্য বিদায়ী বছরে ২ হাজার ৩৭৫ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা করে রেকর্ড সৃষ্টি করে। আগের বছর ব্যাংকটির পরিচালন মুনাফা ছিল ১ হাজার ৫৬৬ কোটি টাকা। এ ব্যাংকের পরিচালন মুনাফায় প্রবৃদ্ধি ৫১ দশমিক ৬৬ শতাংশ। সিটি ব্যাংক ইতিহাসের সর্বোচ্চ পরিচালনা মুনাফা অর্জন করেছে গত বছর। ব্যাংকটি গত বছর ২ হাজার ২৮৭ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা অর্জন করে। যা আগের বছরের তুলনায় ৬৯ দশমিক ৫৩ শতাংশ বেশি। ২০২৩ সালে ব্যাংকটির পরিচালন মুনাফা ছিল ১ হাজার ৩৪৯ কোটি টাকা।

ডাচ্‌বাংলা ব্যাংক গত বছর ২ হাজার ২৮৫ কোটি টাকা পরিচালন মুনাফা অর্জন করেছে। আগের বছর ব্যাংকটির পরিচালন মুনাফা ছিল ১ হাজার ৪১৩ কোটি টাকা। এক বছরের ব্যবধানে মুনাফায় প্রবৃদ্ধি ৬১ দশমিক ৭১ শতাংশ।

২০২৪ সালে ব্যাংক এশিয়া ১ হাজার ৭০০ কোটি ( আগের বছর ১,১৫৩ কোটি টাকা), ইস্টার্ন ব্যাংক ১ হাজার ৬৭৫ কোটি টাকা (আগের বছর ১,১৪৫ কোটি টাকা), প্রাইম ব্যাংক ১ হাজার ৫০০ কোটি (আগের বছর ৯৩৭ কোটি টাকা), মিউচুয়াল ট্রাস্ট ব্যাংক (এমটিবি) ১ হাজার ১১০ কোটি টাকা ( আগের বছর ৭৩১ কোটি টাকা), শাহ্‌জালাল ইসলামী ব্যাংক ১ হাজার ৫০ কোটি টাকা (আগের বছর ৮৮৮ কোটি টাকা), এঙ্মি ব্যাংক ৯৭৫ কোটি (আগের বছর ৭৩৬ কোটি টাকা), প্রিমিয়ার ব্যাংক ৮৫০ কোটি টাকা (আগের বছর এই ব্যাংক পরিচালন মুনাফা অর্জন করেছিল ৯১৪ কোটি টাকা), ওয়ান ব্যাংক ৮৩০ কোটি টাকা ( আগের বছর ৩৬১ কোটি টাকা), মার্কেন্টাইল ব্যাংক ৬৪৪ কোটি টাকা (আগের বছর ৫৫৮ কোটি টাকা) এবং মেঘনা ব্যাংক ২০৪ কোটি টাকা টাকা ( আগের বছর ১৬০ কোটি টাকা) পরিচালন মুনাফা লাভ করেছে।

উল্লিখিত ব্যাংকগুলোর মধ্যে কেবল প্রিমিয়ার ব্যাংকের পরিচালন মুনাফা আগের বছরের তুলনায় কিছুটা কমলেও বাকি সবক’টি ব্যাংক বিপুল পরিমাণে প্রবৃদ্ধি লাভ করেছে।

একাধিক ব্যাংকার জানিয়েছেন, ব্যাংকিং সেক্টরে বেশ সমস্যা বিরাজ করলেও গত বছর প্রচুর আয় হয়েছে। আয় থেকে ব্যয় বাদ দিয়ে নির্ধারণ করা হয় পরিচালন মুনাফা। পরিচালন মুনাফা থেকে খেলাপি ঋণ ও অন্যান্য সম্পদের বিপরীতে প্রভিশন (নিরাপত্তা সঞ্চিতি) সংরক্ষণ এবং সরকারকে কর পরিশোধ করার পর যে অর্থ থাকে সেটিই একটি ব্যাংকের প্রকৃত মুনাফা। পরিচালন মুনাফার একটি বড় অংশ নিরাপত্তা সঞ্চিতি এবং করে ব্যয় হয় উল্লেখ করে ব্যাংকাররা বলেন, এবছর প্রতিটি ব্যাংকেরই নিট মুনাফা আশাতীত থাকবে। তারা বলেন, দেশের ব্যাংকিং সেক্টরের ইতিহাসে ২০২৪ সালের মতো বেহাল বছর আর কখনো ছিল না। এই সেক্টরে গত ১৫ বছর ধরে যে পরিমাণ লুটপাট, মুদ্রা পাচার, ঋণ কেলেংকারির ঘটনা ঘটেছে অতীত বাংলাদেশে তার নজির নেই। এসব বিষয় প্রকাশ্যে আসার পর ব্যাংকিং সেক্টরের প্রতি মানুষের আস্থা তলানিতে গিয়ে ঠেকে। এই সময় বিভিন্ন দুর্বল ব্যাংক থেকে জামানত উঠিয়ে গ্রাহকেরা খুব সামান্য সুদে হলেও অপেক্ষাকৃত ভালো ব্যাংকগুলোতে রেখেছেন। যার সুফল পেয়েছে ভালো ব্যাংকগুলো। তারা স্বল্প সুদে যেমন প্রচুর জামানত পেয়েছে তা কাজে লাগিয়ে প্রচুর মুনাফাও করেছে। তবে দুর্বল ব্যাংকগুলোর অনেকেই তেমন একটা মুনাফার মুখ দেখেনি বলেও তারা উল্লেখ করেন। অনেক ব্যাংক এখন পর্যন্ত হিসেবে নিকেষই প্রকাশ করতে পারেনি।

সুদের হার বাড়ার ফলে ব্যাংকগুলো প্রচুর মুনাফা করলেও দেশের সাধারণ মানুষ মূল্যস্ফীতিতে ভুগছে। প্রখ্যাত অর্থনীতিবিদ প্রফেসর ড. মঈনুল ইসলাম আগামী মাসগুলোতে মূল্যস্ফীতি কমে আসবে বলে আশাবাদ ব্যক্ত করে বলেন, স্থানীয় উৎপাদন বৃদ্ধি পাওয়ায় মূল্যস্ফীতি কমে আসবে। এছাড়া সরকার নানাভাবে মূল্যস্ফীতি কমানোর জন্য কাজ করছে বলেও তিনি উল্লেখ করেন।

সুদের হার বৃদ্ধি এবং ব্যাংকগুলোর বিপুল মুনাফার ব্যাপারে প্রিমিয়ার সিমেন্ট লিমিটেড এবং বাংলাদেশের এলপিজি অপারেটরস ওনার্স এসোসিয়েশনের চেয়ারম্যান আমিরুল হক বলেন, ব্যাংক ঋণের চড়া সুদের কারণে শিল্প কারখানা স্থাপন এবং বিনিয়োগে স্থবিরতা বিরাজ করছে। যা দেশের কর্মসংস্থান, আমদানি রপ্তানির ক্ষেত্রে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। মূল্যস্ফীতিও মানুষকে কষ্ট দিচ্ছে। বিদ্যমান পরিস্থিতিতে দেশে শিল্প কারখানা স্থাপন কিংবা ব্যবসা পরিচালনা কঠিন বলেও তিনি উল্লেখ করেন। তিনি বিষয়টিকে সর্বাধিক গুরুত্ব দিয়ে সংস্কার না করলে পরিস্থিতি আরো নাজুক হবে বলেও আশংকা প্রকাশ করেছেন।

পূর্ববর্তী নিবন্ধলন্ডনে প্যাট্রিক কেনেডির অধীনে খালেদা জিয়ার চিকিৎসা শুরু
পরবর্তী নিবন্ধচট্টগ্রামের জলাবদ্ধতা নিরসনে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার নির্দেশ প্রধান উপদেষ্টার