রাষ্ট্র গঠনের একটি অপরিহার্য অঙ্গ হচ্ছে সরকার। স্বাধীনতা পরবর্তী প্রতিটি সরকারই দলীয় স্বার্থকে প্রাধান্য দিতে গিয়ে বার বার আপামর জনসাধারণের স্বার্থকে জলাঞ্জলি দিয়েছে। প্রতিটি সরকার চাকরির ক্ষেত্রে বিভিন্ন পদক্ষেপ নিতে থাকে। উচ্চ শিক্ষা লাভের পরে শিক্ষার্থীরা একটি ভালো চাকুরির জন্য নতুন করে নিজেকে তৈরি করতে থাকে। ধাপে ধাপে আমাদের শিক্ষাক্ষেত্রে ও চাকুরির ক্ষেত্রে অনেক পরিবর্তন আসে। শিক্ষাব্যবস্থায় অনেক পরিবর্তন হতে থাকে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠানগুলো শিক্ষার মান উন্নয়নের জন্য বিভিন্ন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়। বেসরকারি এবং সরকারি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে শিক্ষা লাভের পরে শিক্ষার্থীরা আবার ভালো চাকরি লাভের আশায় নতুন করে প্রস্তুতি নিতে থাকে। একটা সরকারি চাকরির জন্য চেষ্টার ত্রুটি করে না। ক্যাডার ভিত্তিক চাকরির জন্য বিসিএস পরীক্ষা দেওয়ার জন্য সকল ধরনের প্রস্তুতি নিতে থাকে। একবার দুইবার তিনবার শুধু নয়। বেশ কয়েকবার অনেকেই বি সি এস পরীক্ষা দেওয়ার চেষ্টা করে। একটা সুন্দর জীবন যাপন করতে জীবনের অনেক অংশ শিক্ষা লাভের জন্য ব্যয় করে। কিন্তু চাকরির ক্ষেত্রে এসে তাদেরকে অনেক বাধা–বিপত্তির সম্মুখীন হতে হয়। আর একটি প্রচলিত ধারণা আছে তদবির করতে না পারলে ও ভালো পরিমাণে টাকা দিতে না পারলে মনের মতো চাকরি পাওয়া যায় না। এই ধরনের মন মানসিকতা থেকে অনেক শিক্ষার্থী বিভিন্ন ধরনের অন্যায়ের সাথে জড়িয়ে যায়। অনেক শিক্ষার্থী প্রাথমিক থেকে উচ্চ শিক্ষা পর্যন্ত যোগ্যতা ও দক্ষতার প্রমাণ দিয়ে থাকলেও চাকরির ক্ষেত্রে বিভিন্ন কারণে সেই যোগ্যতা দক্ষতার প্রমাণ দিতে তারা ব্যর্থ হয়।
পাবলিক পরীক্ষায় প্রশ্নপত্র ফাঁসের ঘটনা বর্তমানে একটি সাধারণ বিষয়ে যেন পরিণত হয়েছে। সাম্প্রতিক সময়ে তদন্ত সাপেক্ষে সম্পূর্ণভাবে নিশ্চিত হয়; গত কয়েক বছরের বিসিএস পরীক্ষায়ও প্রশ্নপত্র ফাঁস হয়। এধরনের দুর্নীতির মাধ্যমে অনেকে চাকরি নিয়েছে। এধরনের নিয়োগের ক্ষেত্রে যে অনিয়মগুলো ধরা পড়েছে সেগুলো খুবই লজ্জাজনক এবং দুঃখজনক। সবচেয়ে বেশি আস্থার জায়গা দুদকেও অনেক ধরনের লেনদেন চলে। যত উপরের লেভেলে যেতে থাকে ততই দুর্নীতির মাত্রা আরো বেশি বাড়তে থাকে। বাস্তবতায় ভালো চাকরির জন্য এবং নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করার জন্য এক সময় অন্যায় অনিয়মের সাথে নিজেকে জড়িয়ে ফেলে। যারা বিভিন্ন জায়গায় প্রতিষ্ঠিত হতে পেরেছে তারা আবার সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে বিভিন্নভাবে নির্যাতিত ও নিষ্পেষিত হয়ে থাকে। লক্ষণীয় যে; বিশেষভাবে দলীয় নিয়োগ প্রাপ্ত লোকগুলোর পদোন্নতি ঘটে এবং দলের অবর্তমানে তাদেরকে আবার বিভিন্ন ভাবে অপদস্ত হতে হয়। সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে উচ্চ পর্যায়ে পদমর্যাদা ছিনিয়ে নেওয়া হয়। আবার কারো কম যোগ্যতা থাকলেও দলীয় সমর্থনে পদোন্নতি দেয়া হয়। এভাবে সরকার পরিবর্তনের সাথে সাথে উচ্চ স্তরের পদগুলোর পরিবর্তন ঘটে। যে সরকার যতদিন ক্ষমতাসীন থাকবে সেই সরকার তার নিজস্ব ক্ষমতার দাপটে সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করে। শিক্ষা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে ব্যবসা–বাণিজ্য এবং সেবা প্রতিষ্ঠান থেকে শুরু করে এতিমখানা পর্যন্ত ক্ষমতাসীনদের দখলে থাকে। আর যারা অন্য দলের সমর্থক তাদেরকে কোনো ধরনের পদোন্নতি না দিয়ে মাঝে মাঝে আবার তাদেরকে ওএসডি করে রাখা হয়। এ ধরনের মন মানসিকতা সরকারের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ন করে।
বাংলাদেশের ইতিহাস পর্যালোচনা করলে দেখা যায়; যে দল সরকার গঠন করে নিজেদের পাকাপোক্ত করে রাখার জন্য সর্বস্তরে তাদের নিজের দলীয় লোককে নিয়োগ দেওয়া হয়। আবার প্রতিষ্ঠানের অন্যান্যদেরকে সেই উচ্চপদস্থ কর্মকর্তার মন জুগিয়ে চলতে হয়। যারা দলীয় সরকারের প্রচারণায় ব্যস্ত থাকতে পারে তারা অফিস আদালত ও বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানে খুব ভালো অবস্থায় থাকে। এর ফলে মানুষের মধ্যে দলগুলোর প্রতি আস্থা দিন দিন কমতে থাকে। একসময় দেশ গড়ার ক্ষেত্রে সবাই নিজেরাই এগিয়ে আসতো। তখন টাকার প্রতি কোন মোহ ছিল না। তখন দেশপ্রেমই ছিল প্রধান। ক্ষমতাসীনদের আশ্রয়স্থলে থেকে দলীয় ব্যক্তিরা বিভিন্ন অপরাধের সাথে যুক্ত হয়ে যায়। আমাদের ইতিহাসে দেখা যায়; যেই সরকার আসবে সেই সরকার তার নিজস্ব প্রয়োজনে তা সবকিছু ঢেলে সাজায়। অথচ সাধারণ মানুষের কোনো ভাগ্যের পরিবর্তন হয় না। অর্থাৎ নিম্ন আয়ের মানুষ যে যেখানে আছে সেখানেই থেকে যায়। আধুনিক প্রযুক্তির ব্যবহারের মাধ্যমে নিম্ন আয়ের মানুষগুলো দেশের অবস্থা খুব ভালো করে বুঝতে পারে। এক সময় মানুষের চোখে ধুলা দিয়ে সবকিছু করা যেত। কিন্তু বর্তমানে তা আর সম্ভব নয়। আধুনিক প্রযুক্তির মাধ্যমে প্রতি মুহূর্তের খবর মানুষ জানতে পারে। তাই সরকার পরিবর্তন হোক আর না হোক মানুষ তাদের জীবন যাত্রার ব্যাপারে খুবই সচেতন। কলেজে আসা–যাওয়ার পথে টেক্সিওয়ালার সাথে দেশের পরিস্থিতি নিয়ে কথা বলি। আমি আশ্চর্য হয়ে যায়; দেশের প্রতিটি ব্যাপার নিয়ে তারা খুব সচেতন। কখন কোথায় কে কী করছে; কোথায় কী ঘটেছে; এমনকি কোথায় কী ঘটতে পারে অনায়াসে ঠিক বলে দিচ্ছে। সকালে খবর সকালেই তারা জানতে পারছে। রাজনৈতিক পটপরিবর্তনে খেটে খাওয়া মানুষগুলো আমাদের চেয়ে অনেক বেশি সচেতন। গৃহকর্মী, ড্রাইভার, দারোয়ান, সবজিওয়ালা ও ফুলবিক্রেতা সঠিক পরিস্থিতিগুলো বিচার বিশ্লেষণ করতে পারে। তাই রাজনীতিবিদদের একটা জিনিস মাথায় রাখা উচিত; এখন আর সেই সময় নেই। কোন কিছু গোপন করে ও খেয়াল খুশি মতো সিদ্ধান্ত নেওয়া সম্ভব না ।
অন্তর্র্বর্তীকালীন সরকার অনেক ধরনের সংস্কারের পদক্ষেপ নিচ্ছে। এ ধরনের সংস্কারগুলো সম্পূর্ণভাবে প্রশ্নাতীত হওয়া উচিত। রাজনৈতিক ও দলীয় স্বার্থকে বিসর্জন দিয়ে যারা দেশের স্বার্থকে ও জনগণের স্বার্থকে অগ্রাধিকার দিবে তারাই আস্থা অর্জন করতে সক্ষম হবে। বর্তমান বাংলাদেশের রাজনীতিতে মানুষের বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের মধ্যে বিশাল একটি তফাৎ আছে। সবার মাঝে এক ধরনের নেতিবাচক মনোভাব থাকে। কোন ধরনের অন্যায় ও অপরাধমূলক সিদ্ধান্ত না নিয়ে বরং জনগণের সুযোগ–সুবিধাকে প্রাধান্য দিতে হবে। যে কোনো সিদ্ধান্ত গ্রহণের আগে যাচাই–বাছাই করা উচিত। শুধু নিজেদের প্রয়োজনে ও ক্ষমতায় টিকে থাকার জন্য যে সিদ্ধান্তগুলো নেওয়া হয় তাতে একসময় সাধারণ মানুষের ভিতরে ক্ষোভের সঞ্চার করে। রাজনৈতিক পট পরিবর্তনের পর আপামর জনসাধারণের একটাই ইচ্ছা; জীবনযাত্রার মান সুন্দর হোক। ভোটারদের সহযোগিতা পাওয়ার জন্য দলীয় রাজনীতিবিদদের আরো বেশি ইতিবাচক মন মানসিকতায় এগিয়ে আসতে হবে। কোন সরকার দীর্ঘদিন ক্ষমতায় থাকলে আস্তে আস্তে স্বৈরাচারী হতে থাকে। কোন ধরনের জবাবদিহিতা থাকে না। তারা পরাজয় মেনে নিতে চায় না। যথেচ্ছা ব্যবহার করতে থাকে। তাই প্রতি দুই মেয়াদ পর পর সরকার পরিবর্তন করা দরকার। কেউ যেন দুবারের বেশি নির্বাচনে অংশগ্রহণ করতে না পারেন। নতুনদের এগিয়ে আসার সুযোগ নিশ্চিত করতে হবে। একটা সুষ্ঠু সুন্দর নির্বাচনের মাধ্যমে নতুন সরকার গঠন হোক। যে দলই সরকার গঠন করুক সকলের মেনে নেওয়ার মনমানসিকতা থাকা উচিৎ।
ভোটের অধিকার ও নির্বাচনের প্রতি মানুষের আস্থা অনেক দিন আগেই চলে গেছে। তাছাড়া জনগণের মধ্যে একটা আতঙ্ক থাকে – ভোটকেন্দ্রে গেলে হয়তো যেকোনো ধরনের বিশৃঙ্খলা হতে পারে। নির্বাচন পরবর্তী ফলাফলের উপর অনেকেরই জীবন আশঙ্কাজনক হয়ে যায়। তাই মানুষের এই মানসিকতার পরিবর্তন এর জন্য এগিয়ে আসতে হবে রাজনৈতিক দলকে। সরকারের যেকোনো সংস্কারের আগে ব্যক্তিগত মন মানসিকতার সংস্কার প্রয়োজন। জনসাধারণের চাহিদা তেমন বেশি কিছু না। পরিবারের সবাইকে নিয়ে দুবেলা দুমুঠো খাওয়ার জোগাড় করা। আপামর জনসাধারণ জীবনকে উপভোগ করার জন্য রাত দিন কষ্ট করছে না বরং জীবনকে চালিয়ে নেওয়ার জন্য ও ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য একটি নিশ্চিত পরিবেশ সৃষ্টি করার চেষ্টা চালাচ্ছে। সংস্কার কার্যক্রম হোক জনগণের কল্যাণে। নির্বাচন ও ভোটাধিকারের প্রতি জনগণের আস্থা আবার ফিরে আসুক। রাজনীতিতে মানুষের বিশ্বাস ও অবিশ্বাসের দ্বন্দ্বটি যেন আর না থাকুক। নতুন বছরে নতুন সূচনা সকলের কাম্য।
লেখক: কলামিস্ট ও অধ্যাপক, ইংরেজী বিভাগ, ডাঃ ফজলুল–হাজেরা ডিগ্রী কলেজ, চট্টগ্রাম