‘যে ব্যক্তি (নিজেকে) পরিশুদ্ধ করে নিয়েছে, সে অবশ্যই সফলকাম হয়েছে এবং সে নিজের মালিকের নাম স্মরণ করেছে, অতঃপর সে নামাজ আদায় করেছে কিন্তু তোমরা তো দুনিয়ার জীবনকেই আখেরাতের উপর প্রাধান্য দিয়ে থাক, অথচ আখেরাতের জীবনই হচ্ছে উৎকৃষ্ট ও স্থায়ী। নিশ্চয়ই একথা আগের কিতাবসমূহে রয়েছে, (মজুদ আছে) ইব্রাহীম এবং মুসার কিতাবসমূহেও’। সূরা আল–আ’লা একটি মাক্কী সূরা। এটির আয়াত সংখ্যা ১৯, রুকু সংখ্যা ০১। কুরআনুল করীমের ৮৭ নং সূরা। প্রথম আয়াতে উপস্থাপিত আ’লা শব্দটিকে এর নাম হিসেবে গণ্য করা হয়েছে। এই সূরাটি প্রথম দিকে অবতীর্ণ সূরাগুলোর অন্যতম। এই সূরার ৬ষ্ঠ আয়াতে আল্লাহতায়ালা তাঁর রাসূল (সাঃ) কে উদ্দেশ্য করে বলেছেন, ‘আমি তোমাকে পড়িয়ে দিব, তারপর তুমি আর ভুলবে না’। এর মাধ্যমে আমরা জানতে পারি–এটি এমন এক সময় অবতীর্ণ হয়েছিল যখন রাসূল (সাঃ) ভালভাবে ওহি আয়ত্ত করার অভ্যাস গড়ে তুলতে পারেননি এবং ওহি নাজিলের সময় তার কোন শব্দ ভুলে যাবেন বলে তিনি আশংকা করতেন। এই সূরা যে মাক্কী সূরা তার প্রমাণ এই যে, বা’রা ইবনে আযিব (রাঃ) থেকে বর্ণিত–তিনি বলেন, নবী করিম (সাঃ) এর সাহাবীগণের মধ্যে যারা সর্বপ্রথম আমাদের নিকট আসেন তাঁরা হলেন, মূসআ’ব ইবনে উমায়ের (রাঃ) এবং ইবনে উম্মে মকতুম (রাঃ)। তারা আমাদেরকে কোরআন পড়াতে শুরু করেন। অতপর হযরত বেলাল (রাঃ), হযরত আম্মার (রাঃ), হযরত সাদ (রাঃ) আগমন করেন। উমর ইবনে খাত্তাব (রাঃ) ২০ জন সাহাবী সহকারে আমাদের নিকট আসেন। তারপর নবী করিম (সাঃ) আসেন। আমি মদিনাবাসীকে অন্য কোন ব্যাপারে এত বেশি খুশি হতে দেখিনি যতটা খুশি তারা নবী করিম (সাঃ) এর আগমনে হয়েছিলেন। ছোট ছোট শিশু ও অপ্রাপ্ত বয়স্ক বালকরা পর্যন্ত আনন্দে কোলাহল শুরু করে বলতে থাকে যে, আমাদের কাছে যিনি এসেছেন তিনি হলেন আল্লাহর রাসূল (সাঃ)। রাসূল (সাঃ) এর আগমনের পূর্বেই আমি সূরা আল–আ’লা অন্যান্য সূরাগুলোর সাথে মুখস্থ করে ফেলেছিলাম। এই সূরাটি রাসূল (সাঃ) ঈদের সালাতে পড়তেন। যদি ঘটনাক্রমে একই দিনে জুমায়াহ ও ঈদের সালাত আদায় করতে হত তাহলে তিনি উভয় সালাতে সূরা দু’টি পড়তেন। মুসনাদে আহমদে বর্ণিত আছে, উম্মুল মুমেনিন হযরত আয়েশা (রাঃ) বলেন, রাসূল (সাঃ) বিতরের সালাতে এই সূরাটি পড়তেন, সাথে সূরা কাফিরুন ও সূরা ইখলাসও পড়তেন। এই সূরাতে সর্বপ্রথম নবী করিম (সাঃ)কে নিশ্চয়তা দান করা হয়েছে যে, ‘তুমি চিন্তা কর না, আমি এই বাণী তোমাকে পড়িয়ে দেব এবং তুমি আর ভুলে যাবে না’। বেশ কিছুকাল পর যখন সূরা কেয়ামাহ নাযিল হতে থাকে তখন তিনি ওহির শব্দগুলো পুনরাবৃত্তি করতে থাকেন। তখন বলা হয়, ‘হে নবী! এই ওহি দ্রুত মুখস্থ করার জন্য নিজের জিহবা সঞ্চালন কর না। এগুলো মুখস্ত করানো ও পড়িয়ে দেওয়ার দায়িত্ব আমার। কাজেই যখন আমি এগুলো পড়ি তখন তুমি এর পড়া মনোযোগ সহকারে শুনতে থাক, তারপর এর অর্থ বুঝিয়ে দেওয়ার দায়িত্ব আমার’। আল্লাহতায়ালা রাসূল (সাঃ) এর উদ্দেশ্যে আরও বলেন, ‘আর কোরআন পড়ার ব্যাপারে তাড়াহুড়া কর না, যতক্ষণ পর্যন্ত তোমার কাছে এর ওহি সম্পূর্ণরূপে পৌঁছে না যায়’। এই সূরাটির বিষয়বস্তু মোট ৩টি। ১– তাওহিদ, ২– নবী করিম (সাঃ)কে উপদেশ দান, ৩– আখেরাত। তাওহীদের শিক্ষাকে প্রথম আয়াতের একটি বাক্যের মধ্যেই সীমিত করে দেওয়া হয়েছে। এখানে বলা হয়েছে, ‘তোমার সুমহান রবের নামে তাসবীহ পাঠ কর’। আমরা শেষের ৬টি আয়াত সম্পর্কে আলোকপাত করব। প্রথম আয়াতের ব্যাখ্যায় তাফসীর ইবনে কাসীর–এ এসেছে, ‘যে ব্যক্তি চরিত্রহীনতা থেকে নিজেকে পবিত্র করে নিয়েছে এবং রাসূল (সাঃ) এর প্রতি যা নাযিল হয়েছে সে হুকুম আহকামের পুরোপুরি তাবেদারি করেছে এবং সালাত প্রতিষ্ঠিত করেছে শুধুমাত্র আল্লাহর আদশ পালন ও তাঁর সন্তুষ্টি অর্জনের উদ্দেশ্যে, সে মুক্তি ও সাফল্য লাভ করেছে’। মদিনাবাসী ফিত্রা আদায় করা এবং পানি পান করানোর চেয়ে উত্তম কোন সাদকার কথা জানতেন না। হযরত ওমর ইবনে আব্দুল আজিজও (রহঃ) লোকদেরকে ফিতরা আদায় করার নির্দেশ করতেন এবং এই আয়াত পাঠ করে শুনাতেন। হযরত আবুল আহওয়াস (রহঃ) বলেন, ‘যদি তোমাদের মধ্যে কেহ সালাত আদায় করার ইচ্ছা করে এবং এই অবস্থায় কোন ভিক্ষুক এসে পড়ে তাহলে যেন সে তাকে কিছু দান করে’। অতঃপর তিনি প্রথম দু’টি আয়াত পাঠ করতেন। হযরত কাতাদাহ (রহঃ) বলেন যে, এই আয়াত দুটির ভাবার্থ হল: যে নিজের সম্পদকে পবিত্র করেছে এবং স্বীয় সৃষ্টিকর্তাকে সন্তুষ্ট করেছে (সে সফলকাম হয়েছে)। সাফল্য কেবল তাদের জন্য–যারা আকিদা বিশ্বাস, কর্ম ও চরিত্রের পবিত্রতা ও নিষ্কলুষতা অবলম্বন করবে এবং নিজেদের রবের নাম স্মরণ করে নামাজ পড়বে। ১৬ ও ১৭ নং আয়াতের ব্যাখ্যায় বলা হয়েছে, পরকালের তুলনায় ইহকালের জীবন নিতান্তই মূল্যহীন। আল্লাহতায়ালা বলেন, ‘তোমরা তো পার্থিব জীবনকেই প্রাধান্য দিয়ে থাক’। অর্থাৎ তোমরা আখেরাতের উপর পার্থিব জীবনকে প্রাধান্য দিচ্ছ, অথচ প্রকৃতপক্ষে আখেরাতের জীবনকে দুনিয়ার জীবনের উপর প্রাধান্য দেওয়ার মধ্যেই তোমাদের কল্যাণ নিহিত রয়েছে। লোকেরা শুধুমাত্র এই দুনিয়ায় আরাম–আয়েশ এবং এর স্বার্থ ও আশা আনন্দের চিন্তায় বিভোর হয়ে আছে। অথচ তাদের আখেরাতের চিন্তা করা উচিত। দুনিয়াটা হল ক্ষণস্থায়ী, অমর্যাদাকর। পক্ষান্তরে, আখেরাতের জীবনই হল চিরস্থায়ী ও মর্যাদাময়। দুনিয়ায় নেয়ামতের তুলনায় আখেরাতের নেয়ামত অনেক বেশি ও অনেক উন্নত পর্যায়ের। মুসনাদে আহমদ শরীফে হযরত আবু মুসা আশআরী (রাঃ) থেকে বর্ণিত আছে যে, রাসূল (সাঃ) বলেছেন, ‘যে ব্যক্তি দুনিয়াকে ভালবেসেছে সে আখেরাতে কষ্ট পাবে, আর যে ব্যক্তি আখেরাতকে ভালবেসেছে সে দুনিয়ায় ক্ষতির সম্মুখীন হবে। হে জনমন্ডলী! যা চিরস্থায়ী থাকবে তাকে অস্থায়ীর উপর প্রাধান্য দাও’। এই চরম সত্যটি কেবলমাত্র আল্লাহর কোরআনে বর্ণনা করা হয়নি, হযরত ইব্রাহীম (আঃ) ও হযরত মুসা (আঃ) এর সহীফাসমূহেও মানুষকে একই সত্যের সন্ধান দেওয়া হয়েছিল। অতএব, এই ৬টি আয়াত থেকে আমরা এই শিক্ষা গ্রহণ করতে পারি, দুনিয়ার জীবনকে তুচ্ছ জ্ঞান করে আমাদেরকে আখেরাতের চিন্তায় সবর্দা মশগুল থাকতে হবে।
লেখক: সভাপতি–রাউজান ক্লাব, সিনিয়র কনসালটেন্ট (ইএনটি),
রাঙামাটি জেনারেল হাসপাতাল