বর্তমানে সরকারি বেসরকারি প্রত্যেক মাদ্রাসায় উচ্চ শ্রেণিতে হাদীস শরীফ পাঠদান করা হয়। হাদীস শরীফের উপর যারা জ্ঞানী তাদেরকে মুহাদ্দেস বলা হয়। পবিত্র মক্কা ও পবিত্র মদিনা থেকে হাদীস শরীফের উৎপত্তি হলেও তা আরব পারস্যসহ আশপাশের এলাকায় বিকশিত ছিল। ভারতবর্ষে ব্যাপকতা লাভ করে আরও অনেক পরে। পুরাতন দিল্লিতে শায়িত রয়েছেন মহান আশেকে রাসূল ধর্মীয় বিজ্ঞজন ১১৬ টি ছোট বড় গ্রন্থের রচয়িতা হযরত শেখ আবদুল হক মুহাদ্দেস দেহলভী (রহ.)। তাঁর গ্রন্থগুলোর মধ্যে একটি গ্রন্থ বারে বারে পড়ার সৌভাগ্য হয়। আর তা হল– ‘জজবুল কুলুব ইয়া দিয়ারিল মাহবুব’। এই গ্রন্থটি দেওবন্দ মতাদর্শের প্রখ্যাত ব্যক্তিত্ব মরহুম মাওলানা মুহিউদ্দিন খান এবং পরবর্তীতে চট্টগ্রামের আরেক মহান ব্যক্তিত্ব শাহ মাওলানা আবদুল জব্বার (রহ.) বাংলা অনুবাদ করেন। উভয় অনুবাদগ্রন্থ আমার পড়ার সৌভাগ্য হয়। এতে এই মহান আশেকে রাসূলের প্রতি হৃদয় থেকে শ্রদ্ধা এসে যায়। ভারতবর্ষে দেওবন্দ মতাদর্শের আন্তর্জাতিক খ্যাতি সম্পন্ন ব্যক্তিত্ব সৈয়দ আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.)। দেওবন্দ মতাদর্শের মধ্যে এমন অনেকে রয়েছেন যারা সংকীর্ণতার উর্ধ্বে থেকে উদারতায় থাকতে স্বাচ্ছন্দ্যবোধ করেন। তৎমধ্যে হযরত সৈয়দ আবুল হাসান আলী নদভী (রহ.) অন্যতম। তার পরিচিতি ভারতবর্ষ পেরিয়ে বিশ্বব্যাপী বলা যাবে। তিনি কয়েক খণ্ডে বিশ্বের মহান ধর্মীয় বিজ্ঞজনের উপর গ্রন্থ রচনা করেন। গ্রন্থের নাম দেয়া হয়েছে-‘তারীখে দাওয়াত ওয়া আযীমাত’। আমার কাছে বড় বড় ৫ ভলিয়াম তথা ৫ খণ্ড রক্ষিত আছে। এতে তিনি ভারতবর্ষে এলমে হাদীস শরীফের উপর বর্ণনা দিয়েছেন।
তিনি বলতে চাচ্ছেন, সিন্দুতে আরবদের শাসন বিলুপ্ত হয়ে গেলে গজনবী ও গৌরি শাসকবর্গ এই অঞ্চল দখলে নেয়। এতে এলমে হাদীস শরীফ এই অঞ্চলে হ্রাস পেতে থাকে। এমনকি এক প্রকার বিলুপ্ত হয়ে যায়। মানুষের মাঝে কবিত্ব, জ্যোতিশাস্ত্র, গণিতশাস্ত্র আর ধর্মীয়শাস্ত্রের মধ্যে ফিকাহ ও উসুলে ফিকাহ এর প্রচলন বেড়ে যায়। এই অবস্থা দীর্ঘকাল পর্যন্ত চলতে থাকে। অপরদিকে ভারতবর্ষে ধর্মীয় ব্যক্তিত্বগণের মাঝে ব্যস্ততা এনে দেয় ইউনানী দর্শন চর্চা। এতে উদাসীনতা বাড়ে এলমে তাফসীর ও হাদীস শরীফ চর্চায়। ফিকাহ এর মাসায়েল সম্পর্কে সামান্য কিছু যে আলোচনা কুরআন সুন্নাতে এসে যেত তাতেই তারা পরিতৃপ্ত থাকত। কেউ যদি আরও বেশি জ্ঞানার্জনের আকাঙ্ক্ষা পোষণ করত তাহলে তারা মিশকাত শরীফ পড়ে নিত। তাকেই হাদীস শরীফের উপর উচ্চ জ্ঞানী মনে করা হত। এর মূলে ভারতবর্ষে হাদীস শরীফের জ্ঞানের গুরুত্ব, প্রয়োজনীয়তা ও মর্যাদা সম্পর্কে ছিল অল্প বা উদাসীনতা। না তারা হাদীস শরীফের ইমামগণের সম্পর্কে জানত, না হাদীস শরীফের চর্চায় ছিল। কেবল বরকতস্বরূপ তারা মিশকাত শরীফ পড়ে নিত। তাদের জন্য সবচেয়ে বড় পুঁিজ ছিল ফিকাহ শিক্ষা করা, অনুকরণ করা, গবেষণা করা বা তথ্য অনুসন্ধান করা। এই কারণেই ঐ সময় ফতোয়া প্রদান ও ফিকাহ এর প্রচলন বেড়ে গিয়েছিল। হযরত সৈয়দ আবুল হাসান আলী নদভী এই বিষয়ের উপর ভারতবর্ষে সেই সময়কার ৮ জন খ্যাতিমান বিজ্ঞজনের নাম উল্লেখ করেন। তিনি আরও উল্লেখ করেন, ভারতবর্ষে হাদীস শরীফ শিক্ষার সীমিত পরিসরে কেন্দ্রস্থল ছিল গুজরাটের সুরাট বন্দর। এই বন্দর দিয়েই সাগরপথে প্রাচীনকাল থেকে হেজাজে যাওয়া–আসা হত। তিনি আরও লিখেন–ভারতবর্ষে হাদীস শরীফের প্রচার–প্রসার এর জন্য মহান আল্লাহ পাক হযরত শেখ আবদুল হক মুহাদ্দেস দেহলভী কে মনোনীত করেন। তাঁর দ্বারা হাদীস শরীফ প্রচার–প্রসারে বিরাট কাজ হয়েছে। তিনি রাজধানী দিল্লিতে হাদীস শরীফ শিক্ষার জন্য মাদ্রাসা স্থাপন করেন। নিজের সর্বাত্মক চেষ্টা সাধনা ও যোগ্যতাকে ব্যয় করেছেন হাদীস শরীফের প্রচার ও প্রসারে। তাঁর মাদ্রাসা থেকে অনেক ওলামায়ে কেরাম হাদীস শরীফের জ্ঞানার্জন করেন, অনেক কিতাবাদি লিখেন। শুধু তাই নয়, তিনি যাতে দিল্লি বাদেও ভারতবর্ষে হাদীস শরীফ শিক্ষা ব্যাপকতা লাভ করে তার প্রচার ও প্রসারে অক্লান্ত চেষ্টা–সংগ্রাম চালিয়ে যান। এতে তাঁর ব্যক্তিত্ব ও জ্ঞান দ্বারা আল্লাহ পাকের অনেক বান্দার প্রভূত কল্যাণ সাধিত হয়। পরবর্তীতে তারই সুযোগ্য সন্তান হযরত শেখ নুরুল হক মুহাদ্দেস দেহলভী (ইন্তেকাল ১০৭৩ হিজরি) হাদীস শরীফ শিক্ষার খেদমত প্রচার–প্রসারে ঝাণ্ডা উত্তোলন করেন। এতে তার শত শত ছাত্র এই খেদমতে নিয়োজিত হন। এই গ্রন্থে তিনি আরও লিখেন, হযরত খালিক আহমদ নিজামী যর্থাথই লিখেছেন, হযরত শেখ আবদুল হক মুহাদ্দেস দেহলভী যে সময় হাদীস শরীফ শিক্ষার আসন বেছে নিয়েছিলেন, তখন উত্তর ভারতে হাদীস শরীফ প্রায় এক প্রকার বিলুপ্তি বলা চলে। হযরত শেখ আবদুল হক মুহাদ্দেস দেহলভীর বংশের পর্যায়ক্রমে অনেকে তাদের বংশের নয়নমণির অনুকরণ অনুসরণে হাদীস শরীফের প্রচার–প্রসারে খেদমত করে গেছেন। তিনি আরও লিখেন হিজরি ১২ শতকের মাঝামাঝি সময়ে দিল্লির পাশাপাশি লক্ষ্মৌতে এ হাদীস শরীফ শিক্ষা ব্যাপকতা লাভ করে। বস্তুতঃ হযরত শেখ আবদুল হক মুহাদ্দেস দেহলভী হযরত ইমামে রব্বানী মুজাদ্দেদে আলফেসানীর সমসাময়িক ছিলেন। তিনি ৯৫৮ হিজরিতে দিল্লিতে জন্মগ্রহণ করেন। হিজরি ১০৫২ সালে ২১ রবিউল আউয়াল ইন্তেকাল করলে পুরাতন দিল্লিতেই তাকে সমাহিত করা হয়। প্রথম পুত্র হযরত শেখ নুরুল হক মুহাদ্দেস দেহলভী তাঁর জানাজা পড়ান। তাঁর রচিত কিতাবের সংখ্যা ৬০ টি। ছোট ছোট পুস্তক রচনাবলী সংযুক্ত করা হলে এ সংখ্যা দাঁড়াবে ১১৬টি। নতুন দিল্লি রেল স্টেশনের প্রায় ১ কি.মি উত্তরে নবী করিম নামক এলাকায় চৌরাস্তার পশ্চিমপার্শ্বে রয়েছে কয়েক একর এরিয়া নিয়ে বহু বছর আগেকার কবরস্থান। এই কবরস্থানে শায়িত রয়েছেন হযরত খাজা বাকী বিল্লাহ (রহ.)। তিনি মাত্র ৪০ বছর জীবিত ছিলেন। হযরত খাজা বাকী বিল্লাহ (রহ.) হযরত ইমামে রব্বানী মুজাদ্দেদে আলফেসানী (রহ.)’র পীর ছাহেব ছিলেন। সাথে শেখ আবদুল হক মুহাদ্দেস দেহলভীরও পীর ছাহেব। আজ ভারতবর্ষে সরকারি বেসরকারি বড় বড় প্রত্যেক মাদ্রাসায় উচ্চ শ্রেণিতে হাদীস শরীফ শিক্ষা অতীব গুরুত্ব লাভ করে। যা হযরত শেখ আবদুল হক মুহাদ্দেস দেহলভীর প্রেরণা প্রচেষ্টার ফসল বললে বাড়িয়ে বলা হবে না। ১৯৮০ সাল থেকে ভারতের যাওয়া–আসা হয়ে থাকলেও তাঁর উপর ধারণা লাভ করি আরও পরে থেকে। যখনি জানতে পারলাম তিনি মহান আশেকে রাসূল, তাঁর রয়েছে ভারতবর্ষে বিশাল খেদমত এতে দিল্লি গমন করলেই মন চটপট করে তাঁর কবরে গিয়ে সালাম পেশ করতে। পুরাতন দিল্লিতে শায়িত রয়েছেন হযরত খাজা কুতুব উদ্দিন বখতিয়ার কাকী (রহ.)। তাঁর মাজার থেকে মাত্র ১ কি.মি বা কম বেশি দূরত্বে হযরত শেখ আবদুল হক মুহাদ্দেস দেহলভী শায়িত। এই এলাকাটির নাম ইসলামপুর। প্রসঙ্গক্রমে উল্লেখ্য উজবেকিস্তান সফরকালে ইমাম বোখারী (রহ.) ও ইমাম তিরমিজি (রহ.)’র যেয়ারত করার সৌভাগ্য হয়। অপরদিকে ইমাম মুসলিম (রহ.) শায়িত রয়েছেন নিশাপুরে। ইরানের পূর্বাঞ্চলীয় অঞ্চল খোরাসানের প্রাণকেন্দ্র মাশাদ। মাশাদে রাত্রিযাপন করে সকালে টেক্সি নিয়ে ১৪০ কি.মি দূরত্বে নিশাপুর যাওয়া হয়। এখানে হযরত ফরিদ উদ্দিন আত্তার ও কবি ওমর খৈয়াম এর যেয়ারত করা হয়। কিন্তু এই শহরের নাসেরাবাদ কবরস্থানে হযরত ইমাম মুসলিম (রহ.) শায়িত। ভাষাগত প্রতিকূলতায় এখানে পৌঁছা সম্ভব হয়নি। বস্তুত হযরত সৈয়দ আবুল হাসান আলী নদভী তার রচিত ‘তারীখে দাওয়াত ওয়া আযীমাত’ গ্রন্থে অনেক কিছুর মধ্যে ভারতবর্ষের ধর্মীয় সাধক পুরুষ সুফি দরবেশের কথাও উল্লেখ করে গেছেন। হযরত খাজা মঈন উদ্দিন চিশতী, হযরত খাজা কুতুবউদ্দিন বখতিয়ার কাকী, হযরত খাজা ফরিদ উদ্দিন গঞ্জেশকার, হযরত খাজা নেজাম উদ্দিন আউলিয়া, হযরত শেখ শরফুদ্দীন ইয়াহিয়া মুনায়েরী, হযরত মুজাদ্দেদে আলফেসানী, হযরত শেখ আবদুল হক মুহাদ্দেস দেহলভী, হযরত শাহ ওয়ালি উল্লাহ মুহাদ্দিস দেহলভীসহ অনেক সুফি দরবেশ ভারতবর্ষে ইসলামের বিকাশে খেমতের কথা বিস্তৃতভাবে উল্লেখ করে গেছেন। এতে তিনি গতানুগতিক এই সমস্ত সুফি দরবেশগণের কারামতের দিককে গুরুত্ব না দিয়ে ভারতবর্ষে তাদের দ্বারা ইসলামের বিকাশে খেদমতের কথা লিখে গেছেন। তৎমধ্যে মহান আশেকে রাসূল হযরত শেখ আবদুল হক মুহাদ্দেস দেহলভী অন্যতম। আমারও সৌভাগ্য হল হযরত শেখ আবদুল হক মুহাদ্দেস দেহলভী (রহ.)’র উপর নিজের জানা এবং সম্মানিত পাঠক মহলকে জানাবার।
লেখক : প্রাবন্ধিক, গবেষক, কলামিস্ট।