সুফি আউলিয়াগণ সত্য। এঁরা সবসময় সত্যের পক্ষে, শোষিত– নিপীড়িতদের পক্ষে। এবং জালিমের বিপক্ষে। বাঙালির প্রতিটি আন্দোলন–সংগ্রাম ছিল সত্যের পক্ষে। শোষিত–নিপীড়িতসহ মানবতার পক্ষে। প্রতিটি আন্দোলনে সকল সুফি– আউলিয়ার সমর্থন ছিল। তাঁদের সমর্থন ও নেকনজর আন্দোলনে শক্তি যুগিয়েছে। সর্বোপরি বিজয় নিশ্চিত করেছে। ব্রিটিশ বিরোধী আন্দোলন, ৫২‘র ঐতিহাসিক ভাষা আন্দোলন, ৬ দফা আন্দোলন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা, ৬৯‘র গণঅভ্যুত্থান সহ ৭১‘র মহান মুক্তিযুদ্ধে মাইজভাণ্ডার শরিফের ভূমিকা অনন্য। এমনকি লাহোর প্রস্তাবেও মাইজভাণ্ডারী সুফিদের সমর্থন ছিল। লাহোর প্রস্তাব উপস্থাপনকারি শেরে বাংলা এ.কে ফজলুল হক ছিলেন মাইজভাণ্ডার শরিফের ভক্ত। তিনি প্রায় বলতেন, ‘মাইজভাণ্ডার শরিফের ছায়া যতদিন আমার উপরে থাকবে, ততদিন আমার কেউ ক্ষতি করতে পারবে না’। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানও দু‘বার মাইজভাণ্ডার এসেছিলেন। ১৯৫২ সালে জানুয়ারিতে সপরিবারে দরবার শরিফ এসে ফরদুল আফরাদ হজরত সৈয়দ আহমদ উল্লাহ (ক.) মাইজভাণ্ডারী এবং ইউসুফে সানি হজরত সৈয়দ গোলামুর রহমান শাহ্ (ক.) মাইজভাণ্ডারী‘র মাজার শরিফ জেয়ারত শেষে হজরত সৈয়দ দেলাওর হোসাইন মাইজভাণ্ডারী‘র সাথে হুজুরায় সাক্ষাত করে দোয়া ও পরামর্শ কামনা করেন। আলাপকালে বঙ্গবন্ধু বলেন, ‘মামা আমাকে দোয়া করেন, যেন বাঙ্গালিজাতিকে পশ্চিমাদের শোষণের কবল থেকে মুক্ত করতে পারি’। কীভাবে মুক্তি সম্ভব জানতে চাইলে বঙ্গবন্ধু বলেন,‘আন্দোলন করবো এবং এটাই আমাদের লক্ষ্যে পৌঁছার হাতিয়ার’।পুনরায় প্রশ্ন করলেন, ‘যদি ব্যর্থ হন’? জবাবে বঙ্গবন্ধু হাতে ছুরি নিয়ে আঘাত করার ভঙ্গিতে বলেন, ‘এইভাবে অস্ত্র ধরে’। শুনে হযরত দেলাওর হোসাইন দয়াপ্রদর্শন পূর্বক ডানহাত উপরে তুলে বলেন, ‘এই পথেই আসবে বাঙ্গালি জাতির মুক্তি। আমি দোয়া করলাম’। বঙ্গবন্ধু দ্বিতীয়বার আসেন ১৯৫৮ সালে জেনারেল আইয়ূব খান ক্ষমতাগ্রহণের পর। বাবাভাণ্ডারীর ছোট সাহেবজাদা হযরত সৈয়দ শফিউল বশর মাইজভাণ্ডারী সহ অন্যান্য আওলাদের সাথে সাক্ষাৎ শেষে বরাবরের মত হযরত সৈয়দ দেলোয়ার হোসাইন মাইজভাণ্ডারী‘র সহিত সাক্ষাতকালে বঙ্গবন্ধু দোয়াসহ বিভিন্ন বিষয়ে পরামর্শ চান। তিনি যেসব পরামর্শ দিয়েছেন, এর অধিকাংশই পরবর্তীকালে ছয় দফা দাবীতে বঙ্গবন্ধু বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছেন। এমনকী তিনি ঐতিহাসিক ছয় দফা আন্দোলন চট্টগ্রাম থেকেই ঘোষণার সিদ্ধান্ত নেন। চট্টগ্রাম থেকে ছয় দফা ঘোষণা সম্পর্কে শেখ সাহেব, গণপরিষদ সদস্য আব্দুল্লাহ আল হারুন চৌধুরীকে টেলিফোনে বলেন, ‘চট্টগ্রাম বার আউলিয়ার দেশ। ঐখান থেকেই আমি শুরু করতে চাই’। বঙ্গবন্ধু সিলেট কারাগারে বন্দীকালীন ‘আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা’ নামক মিথ্যা মামলা দায়ের করে তাঁকে পুন:গ্রেপ্তার দেখানো হয়। তিনি কারাগার থেকে চন্দনাইশ থানা নিবাসী নায়েক আব্দুর রহমান(সিলেটে কর্মরত) মারফত অসিয়ে গাউসুল আজমের নিকট দোয়া চেয়ে একশত টাকা নজরানা সহ একটি চিরকুট পাঠান। নজরানা ও চিঠি পেয়ে তিনি দোয়া করেন। এর পরপরই সসম্মানে মুক্তি, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা ভেস্তে যাওয়া সহ বঙ্গবন্ধু উপাধিতে ভূষিত হন।
মুক্তিযুদ্ধকালীন সবদিকে চলছে পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর ধ্বংসযজ্ঞ, ধর্ষণ, লুটপাট, ঘরবাড়ি পোড়াসহ চারিদিকে ভয়ানক অবস্থা। চলছে কারফিউ। এই পরিস্থিতিতেও অসিয়ে গাউসুলআজম ১৯৭১ সালে (২২ চৈত্র) ৫ এপ্রিল অনুষ্ঠিত হযরত সৈয়দ গোলামুর রহমান শাহ্ (ক.) প্রকাশ বাবাভাণ্ডারীর বার্ষিক ওরশের দিন সকাল সকাল (পরাধীন দেশে) বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা উড়িয়ে মিছিলসহকারে মাইজভাণ্ডার শরিফে আসবার জন্য আশেক ভক্তদের নির্দেশনা দেন। নির্দেশনা পেয়ে ভক্তগণ সত্য ও মুক্তিযুদ্ধের চেতনায় উজ্জীবিত হয়ে মানচিত্র খচিত পতাকা নিয়ে মিছিল, হাদিয়াসহকারে ওরশে আগমন করেন। সেদিক দিয়ে বলা যায়– মাইজভাণ্ডার শরিফের প্রত্যেক ভক্তই এক একজন মুক্তিযোদ্ধা। পাকিস্তানি হানাদার বাহিনীর রক্তচক্ষু উপেক্ষা করে সেদিন মাইজভাণ্ডার শরিফে বাংলাদেশের মানচিত্র খচিত পতাকা পতপত করে উড়েছিল। এর মাধ্যমে মাইজভাণ্ডারী সুফিগণ মুক্তিযুদ্ধের প্রতি শতভাগ সমর্থন এবং যুদ্ধে বিজয়ের ইংগিত দিয়েছেন। ভক্তগণ সেদিনই উপলব্ধি করতে পেরেছিল বাংলাদেশের বিজয় নিশ্চিত। মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ে মাইজভাণ্ডারী সুফিদের করুণাধারা গভীরভাবে জড়িত। মাইজভাণ্ডারী সুফিগণ মুক্তিযুদ্ধকে সমর্থন করে বাঙালির বিজয়কে আল্লাহর দরবারে গ্রহণযোগ্য করে তোলেন এবং অল্প সময়ের মধ্যেই মুক্তিযুদ্ধে বিজয় আসে। এমনকী দরবারের নির্দেশে অসংখ্য মাইজভাণ্ডারী ভক্ত মুক্তিযুদ্ধে অংশগ্রহণ করেছেন। খাগড়াছড়ি জেলার ময়ূরখিলস্থ দরবারের খামার, ফটিকছড়ি খিরামের সৈয়দ লকিয়ত উল্লাহ্ খামার এবং দেশব্যাপী মাইজভাণ্ডারী ঘরানার সকল সুফিআউলিয়ার দরবার, খানখাহ্সমূহ সহ ভক্তদের বাসগৃহ ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের নিরাপদ আশ্রয়স্থল ও ট্রানজিট ক্যাম্প। এজন্য পাকিস্তানী হানাদার বাহিনী এসব কেন্দ্রে অভিযান চালিয়ে নির্যাতন, হত্যা এমনকী ধর্ষণও করেছে। দরবারের বহু ভক্ত–মুরিদ মুক্তিযুদ্ধে শাহাদাত বরণ করেছেন। মাইজভাণ্ডার শরিফ বাঙালির ন্যায়সঙ্গত দাবির পক্ষে, স্বাধীনতার পক্ষে সক্রিয় ভূমিকা পালন করেছে। মুক্তিযোদ্ধাদের ক্যাম্প হিসেবে পরিচিত ময়ূরখিলস্থ খামারের পুকুরের মাছ, শাক সবজি, মুরগ–মুরগী সব মুক্তিযোদ্ধাদের জন্য বিলিয়ে দেওয়া হয়। মুক্তিযোদ্ধারা এখান থেকে বিভিন্ন গুরুত্বপূর্ণ অপারেশন করতেন। হানাদার বাহিনী খবর পেয়ে সেখানে আক্রমণ চালায়। তৎকালীন সুফি হযরত সৈয়দ দেলোয়ার হোসাইন মাইজভাণ্ডারী মুক্তিযোদ্ধাদের সাহায্য সহযোগিতা সহ মুক্তিযুদ্ধে বিভিন্নভাবে ভূমিকা রাখেন। ফটিকছড়ি নানুপুর নিবাসী মুক্তিযোদ্ধা মন্টু কাওয়াল বলেন, ‘হযরত সৈয়দ দেলাওর হোসাইন মাইজভাণ্ডারী আমাদের (মুক্তিযোদ্ধাদের) নিয়ে হজরত কেবলা ও বাবাভাণ্ডারী কেবলার মাজারে জেয়ারত করে সকল মুক্তিযোদ্ধা সহ দেশের জন্য দোয়া করতেন’। যুদ্ধকালীন ‘সোনার বাংলা শ্মশান কেন’ লেখা একটি পোস্টার মাইজভাণ্ডারে লাগানো ছিল। কুয়াশায় ভিজে ছিড়ে পড়ে গেলে অসিয়ে গাউসুলআজম তুলে নিয়ে বৃদ্ধাবস্থায় নিজ হাতে পেরেক ঠুকে লাগিয়ে দেন। শাহানশাহ হজরত সৈয়দ জিয়াউল হক মাইজভাণ্ডারীর নিকট মুক্তিযোদ্ধারা দোয়া চাইতে আসলে তিনি বলতেন, ‘অধিকার কেউ সহজে দেয় না, কেড়ে নিতে হয়’। তিনি যুদ্ধে সাহস রাখার জন্য প্রেরণা দিতেন। মুক্তিযুদ্ধে সুফিদের অবদানের ধারাবাহিকতায় ফটিকছড়ি পূর্ব ফরহাদাবাদ (নাজিরহাট) মতিভাণ্ডার দরবার শরিফও ছিল মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়স্থল ও ট্রানজিট ক্যাম্প। এ দরবারের অগণিত ভক্ত মুক্তিযুদ্ধে প্রত্যক্ষ ও পরোক্ষভাবে অংশগ্রহণ করেন। মতিভাণ্ডার দরবার শরিফের সুফি (দরবারের সাজ্জাদানশিন) হযরত মওলানা আবুল ফয়েজ শাহ্( রহ.) ও হযরত আবুল কাসেম মিঞা শাহ্ (রহ.) মুক্তিযোদ্ধাদের আশ্রয়সহ আহার–আপ্যায়ন করাতেন। এখান থেকে দক্ষিণ দিকে মুক্তিযোদ্ধারা অপারেশনে যেতেন। মুক্তিযোদ্ধা জোনাল কমান্ডার ও ফটিকছড়ির গণপরিষদ সদস্য জনাব মির্জা মনসুর সহ সপরিবারে মতিভাণ্ডার দরবার শরিফের দয়াপ্রাপ্ত একনিষ্ঠ ভক্ত ছিলেন। এমনকি তিনি ওরশ পরিচালনা কমিটির সভাপতিও ছিলেন। তার নেতৃত্বে ফটিকছড়ির সংসদ সদস্য মজহারুল হক শাহ চৌধরীসহ এই দরবারের অসংখ্য ভক্ত মুক্তিযুদ্ধে ঝাপিয়ে পড়েন। মির্জা মনসুর সহ আগত মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে হযরত শাহ সুফি মওলানা আবুল ফয়েজ শাহ, মজ্জুবেসালেক হযরত মওলানা মতিয়র রহমান শাহ্(প্রকাশ–শাহ্ সাহেব কেবলা)’র মাজার জেয়ারত করে যুদ্ধে জয়লাভ সহ দেশ ও জাতির জন্য দোয়া করতেন। মির্জা মনসুর, তাঁর থেকে যুদ্ধ সম্পর্কে পরামর্শ নিতেন। মজজুবেসালেক শাহ্সাহেব কেবলা ১৯৬৪ সালে ( ওফাতপূর্ব) ৭১‘র মুক্তিযুদ্ধ এবং যুদ্ধে জয়লাভের ভবিষ্যৎবাণী করেন। ১৯৭৪ সালে দুর্ভিক্ষেরও ভবিষ্যৎবাণী করেছেন। তিনি এমন একজন সুফি যার ইশারায় বিনামেঘে অঝোরে বৃষ্টি বর্ষণ হতো। (এটি তাঁর অসংখ্য অলৌকিকতার মধ্যে একটি)। এ যেন বৃষ্টি নয়, যেন করুণাধারা। তিনি ভক্তদের সামনে উদাস মনে তাকিয়ে দুর্ভিক্ষের ইঙ্গিত দিয়ে বলেছিলেন, ‘-সামনে কুকুর–মানুষে ভাতের লড়াই। লড়াই বন্ধ করতে বৃষ্টির আয়োজন। ওফাতপরবর্তী একাধিক ভক্তকে তিনি স্বপ্নযোগে মুক্তিযুদ্ধে জয়লাভের সু–সংবাদও দেন। যুদ্ধ বিজয়ের পর মির্জা মনসুর সাহেব কৃতজ্ঞতা ও শুকরিয়া জানানোর জন্য মুক্তিযোদ্ধাদের নিয়ে সাহেব সাহেব কেবলার দরবারে আসেন। এছাড়া মাইজভাণ্ডারী ঘরানার সুফিগণ যেসব পুস্তকাদি রচনা করেছেন (ব্রিটিশআমল থেকেই) অধিকাংশ গ্রন্থে পূর্ব পাকিস্তান নয় বরং ‘মুলকে বাঙ্গাল’ লিখেছেন। হজরত শাহসুফি সৈয়দ আমিনুল হক ফরহাদাবাদি তাঁর লিখিত পুস্তকে ‘বাংলাদেশ’ শব্দটি ব্যবহার করেছেন। এটিও সুফিদের বাংলাদেশের প্রতি পূর্ণ সমর্থনের বহিঃপ্রকাশ। তাই বাংলাদেশের সকল স্বাধীনতা সংগ্রাম সহ মুক্তিযুদ্ধে মাইজভাণ্ডারী সুফিদের ভূমিকা অনস্বীকার্য। বিজয়ের মাসে মুক্তিযুদ্ধে শহীদদের স্মরণসহ জাতির শ্রেষ্ঠ সন্তানদের জানাই বিনম্র শ্রদ্ধা।এবং সকল সুফি আউলিয়ায়ে কেরামকে জানাই বিনয়াবনত তাজিম।
লেখক–প্রাবন্ধিক ও গবেষক। সাজ্জাদানশিন, মতিভাণ্ডার দরবার শরিফ,
নাজিরহাট, ফটিকছড়ি চট্টগ্রাম।