বান্দরবানের পাহাড়ে বনমোরগের খামার গড়ে তুলেছেন মারমা দম্পতি। পাহাড়ে বনের ভেতরে কুড়িয়ে পাওয়া বনমুরগির ডিম গৃহপালিত স্থানীয় জাতের দেশি মুরগির মাধ্যমে উত্তাপ লাগিয়ে বাচ্চা ফুটিয়ে চমকে দিয়েছেন স্থানীয়দের। সফল খামারি হিসেবে এ দম্পতি বেশ সাড়া ফেলেছেন পার্বত্য জনপদে। প্রাণিসম্পদ বিভাগ ও স্থানীয়রা জানান, বান্দরবান সদর উপজেলার রাজবিলা ইউনিয়নের ৯ নং ওয়ার্ডের মেওয়াপাড়া এলাকার বাসিন্দা হ্লাশৈঅং মারমা এবং শৈমেচিং মারমা দম্পতি ৪ বছর আগে বনমোরগের খামার গড়ে তোলে। খামার গড়ে তুলতে বাড়ির চারপাশে উঁচু বেড়া তৈরি করে আঙিনায় বিভিন্ন জাতের গাছপালা লাগিয়ে প্রাকৃতিক বনের পরিবেশ সাজিয়ে তোলে। জেলা সদর থেকে প্রায় ২৩ কিলোমিটার দূরে এই খামারের অবস্থান। ঘণ্টা দেড়েক মোটর সাইকেল চালিয়ে এবং পায়ে হেঁটে পাহাড়ের উঁচুনিচু পথ পাড়ি দিয়েই পৌঁছাতে হয় এই বনমোরগের খামারে।
সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, বর্তমানে পাহাড়ে প্রাকৃতিকভাবে গড়ে তোলা বনমোরগের খামারে ছোট–বড় মিলিয়ে ৭০টি মোরগ–মুরগি রয়েছে। এগুলোর জন্য প্রতিদিন ৫ কেজির মতো ধানের প্রয়োজন হয়। বনমোরগ আকারে দেশীয় মোরগের থেকেও ছোট। ওজনেও কম। বড় সাইজের একেকটি মোরগের ওজন সর্বোচ্চ ৮শ গ্রাম থেকে ১ হাজার গ্রামের মতো হয়। মুরগির ওজন ৬শ থেকে ৭শ গ্রামের মতো। সফল খামারি দম্পতি হ্লাশৈঅং মারমা ও শৈমেচিং মারমা জানান, ৪ বছর আগে পাহাড়ে জুম খেতে কাজে যাওয়ার পথে ৫টি ডিমসহ বনমুরগির একটি বাসা দেখতে পান। শখের বসে বনমুরগির ডিমগুলো সংগ্রহ করে বাড়িতে এনে যত্ন সহকারে স্থানীয় দেশীয় জাতের মুরগির ডিমের সঙ্গে বাচ্চা ফোটানোর চেষ্টা করেন। প্রথম দফায় ৫টি ডিমের মধ্যে ৩টি ডিম নষ্ট হয়। তবে ২টি ডিমে বাচ্চা ফোঁটাতে সক্ষম হয়। দুটির মধ্যে ১টি মুরগি, অপরটি মোরগ।
বনমুরগিকে মারমা ভাষায় বলে তোয়াইং গ্যাং বা তইক ক্যাং। পোষ মানা বনমোরগের গঠন, আকার–আকৃতি ও ডাক সবই অভিন্ন। তাই পাহাড়ের বনমোরগকে ফাঁদে ফেলে জীবন্ত উপায়ে শিকার করার জন্য তোঁয়াইং গ্যাং বা তইক ক্যাংকে ব্যবহার করা হয়। বর্তমানে পাহাড়ের জঙ্গলে বনমোরগের সংখ্যা কম হলেও এদের চাহিদা অনেক। তাই দেশি মুরগির মতো কিছুটা হলেও চাহিদা মেটাতে এই বনমুরগির বাণিজ্যিক সম্ভাবনাকে কাজে লাগাতে বড় আকারে খামার করার স্বপ্ন দেখছেন তারা।
হ্লাশৈঅং মারমা আরও জানান, দেশীয় মুরগির বাচ্চাদের সাথে বেড়ে উঠার সময়ে হঠাৎ অসুস্থ হয়ে পড়ে বনমুরগির বাচ্চারা। আপ্রাণ চেষ্টা করেও যখন বাচ্চাগুলো সুস্থ হচ্ছে না, তখন মানসিক ভাবেও ভেঙে পড়েন স্বামী–স্ত্রী দুজন। বুদ্ধি করে খাবার বদলিয়ে ধানের শক্ত দানা এবং পাহাড়ের জঙ্গল থেকে পিঁপড়ের ডিমসহ হরেক রকমের পোকামাকড় ধরে এনে খাওয়ান। এতে আস্তে আস্তে পুরোপুরি সুস্থ হয়ে উঠে বনমোরগ–মুরগির বাচ্চা। বনমুরগির বাচ্চা দুটিকে আলাদা যত্ন এবং ভিন্ন খাবার দেওয়ার মাধ্যমেই মূলত খামারটি গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখেন। কুড়িয়ে পাওয়া ডিমের ফোটানো দুটি বাচ্চা থেকেই বংশবৃদ্ধির মাধ্যমে গড়ে উঠে বনমোরগের পরিকল্পিত একটি খামার। খামার গড়ে তোলার পর থেকে তিনি নিজে মুরগির মাংস খাওয়া ছেড়ে দিয়েছেন। সন্তানের মতো লালন করেন মুরগিগুলো।
খামারি পত্নী শৈমেচিং মারমা জানান, গড়ে তোলা খামারের মুরগি বিক্রি করে লাভবান হচ্ছেন স্বামী–স্ত্রী দুজন। কয়েকবছরে খামারে দেড়শর মতো বনমোরগ–মুরগি হয়েছে। চলতি বছরের শুরুর দিকে রোগে ৩০টি মুরগি মারা গেছে। পাহাড়ের বন বিড়ালও ১০টি মুরগি খেয়ে ফেলেছে। বড় সাইজের একেকটি মোরগ ৩ হাজার থেকে সাড়ে ৩ হাজার এবং মাঝারি সাইজের মোরগ ২ হাজার থেকে আড়াই হাজার টাকায় বিক্রি হয়। তবে যোগাযোগের ভালো ব্যবস্থা এবং মোবাইল নেটওয়ার্ক না থাকায় বিক্রি কম হচ্ছে। বর্তমানে বেশকিছু অর্ডার আছে।
বিষয়টি নিশ্চিত করে জেলা প্রাণিসম্পদ বিভাগের কর্মকর্তা ডা. জুলহাস আহমেদ জানান, বনমুরগির কুড়িয়ে পাওয়া ডিম স্থানীয় দেশি মুরগির মাধ্যমে বাচ্চা ফুটিয়ে বনমোরগের খামার গড়ে তোলার সাফল্য সাড়া জাগিয়েছে পার্বত্যাঞ্চলে। সফল এ খামারি দম্পতি সবার জন্য অনুপ্রেরণা। খামারের মুরগি বিক্রি করে তারা অর্থনৈতিকভাবেও অনেকটা স্বাবলম্বী। মোরগ–মুরগির গুটিবসন্ত বা ফঙ, কলেরা রোগ হচ্ছে, এগুলোর জন্য টিকা আছে। রোগের প্রতিকারে সার্বিক পরামর্শসহ প্রয়োজনীয় সহযোগিতা দেওয়া হবে।