নগর সরকার ধারণা ও সংস্কার প্রসঙ্গে

অভীক ওসমান | বৃহস্পতিবার , ১৯ ডিসেম্বর, ২০২৪ at ১০:৪৫ পূর্বাহ্ণ

১৯৬৭ সালে আমি যখন নগরে আসি তখন আন্দরকিল্লায় ছিল পৌরসভা অফিস। ফজল করিম চেয়ারম্যান ছিলেন। জেনারেল হাসপাতালের অপজিটে তার ফলমন্ডি ছিল। সিরাজুল হক মিয়া ভাইস চেয়ারম্যান। এর আগে নুর আহমদ চেয়ারম্যান প্রাথমিক শিক্ষার জনক হিসেবে খ্যাতি পেয়েছেন। এরশাদ আমলের ব্রিগেডিয়ার মফিজ, সেকান্দর হোসেন মিয়া প্রশাসক ছিলেন। মাহমুদুল ইসলাম চৌধুরী মেয়র হলেন। খুবই ডিপ্লোমেটিক। তিনি প্রথমে উপমন্ত্রী পরে একদিনের মাথায় প্রতিমন্ত্রী ক্ষমতা পান। তার তিনজন ডেপুটি মেয়র ছিলেন। মীর নাছির উদ্দিন লইয়ার তার সর্বদলীয় উপদেষ্টা পর্ষদ ছিল। আইনের লোক হিসেবে গুড এডমিনিস্ট্রেটর ছিলেন। এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী মূলত পাবলিক লিডার। আ জ ম নাছির উদ্দিন চৌধুরী বিলবোর্ড সরানোর পজিটিভ কাজ করেছেন। রেজাউল করিম চৌধুরীর সর্বদলীয় দৃষ্টিকোণ ছিল।

ডা. শাহাদাত হোসেন শপথ গ্রহণকালে অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের উপদেষ্টা হাসান আরিফ বলেছেন, ‘জুলাই আগস্ট বিপ্লবোত্তরকালে দেশের প্রধান বন্দরনগরী চট্টগ্রামের প্রথম মেয়র ডা. শাহাদাত হোসেন। তাঁর দায়িত্ব অনেক।’ স্পোর্টস ইনজুরির এই বিরল চিকিৎসক, সুদর্শন মেয়র জেনারেল হাসপাতালের ডেঙ্গু চিকিৎসা, মশক ঔষধ পর্যবেক্ষণ, বিপ্লব উদ্যানের দোকান উচ্ছেদ, বাকলিয়ার পর্যটন নগরী স্থাপন, বর্জ্য ব্যবস্থাপনা, বৈদ্যুতিক ও টিএনটি তার আন্ডারগ্রাউন্ডে নিয়ে যাওয়া, সিডিএর সাথে বৈঠক, মিডিয়া বান্ধব হিসেবে নিজেকে প্রতিষ্ঠা করার জন্য সচেষ্ট।

আমাদের সংবিধানের ৫৯ ধারা অনুযায়ী স্থানীয় সরকার সমূহ স্বায়ত্তশাসিতভাবে চালানোর অধিকার দিয়েছেন। কিন্তু গরিষ্ঠ উন্নয়ন কাজ শর্তসাপেক্ষ, কেন্দ্রীয় সরকারের অনুমতিসাপেক্ষ, স্ট্যান্ডিং অর্ডার ইত্যাদির কারণে সিটি করপোরেশনসমূহ ‘পাপেট’ হয়ে দাঁড়ায় (ইঞ্জিনিয়ার এম আলী আশরাফ)

এর জন্য এবিএম মহিউদ্দিন চৌধুরী সিটি গভর্নমেন্টের কনসেপ্ট দেন। একই সময়ে ঢাকার মেয়র হানিফও এই প্রস্তাব দেন। সম্প্রতি ঢাকায় অনুষ্ঠিত এক সেমিনারে স্থানীয় সরকার এক্সপার্টগণ বলেছেন: ‘স্বায়ত্তশাসন ও দক্ষতা ইত্যাদির ওপর প্রশ্ন তুলেছেন। সেখানে ক্যাশলেস লেনদেনের একটি চমৎকার প্রস্তাব এসেছে।’

চন্দনাইশ মিডিয়া ক্লাবের রিসিপশন অনুষ্ঠানে ডা. শাহাদাত হোসেন সিটি গভর্নমেন্টের উপর জোর দেন। এ প্রসঙ্গে উল্লেখ্য যে, ব্রিটিশ কলোনিয়াল বিধি ও ধারায় শাসিত আমরা। এখন ব্রিটেনেও, লিবারেল প্রোপিপল ধারা সংযুক্ত হয়েছে। যুক্তরাষ্ট্রের সিটিসমূহের শাসনের জন্য নিরীক্ষামূলক আইন পরিবর্তিত হয়েছে।

মূলত সেবা সংস্থা সমূহের সমন্বয়হীনতা চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের উন্নয়ন কার্যক্রম দায়ী প্রায় ১৫টি মন্ত্রণালয়ের অধীনে ৩২টি সংস্থার সহযোগিতা মেয়রের দরকার। প্রতিরক্ষা বাহিনী, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, বিভাগীয়জেলা প্রশাসন, চট্টগ্রাম বন্দর কর্তৃপক্ষ, চট্টগ্রাম উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ, ওয়াসা, পিডিবি, পানি উন্নয়ন বোর্ড, কেজিসিডিএল ও ট্রেডবডিসমূহ উল্লেখ্য।

অতীতে চট্টগ্রামের তথাকথিত উন্নয়নের দায়িত্বপ্রাপ্ত মন্ত্রী একটি সমন্বয় বৈঠক করতেন। আনিসুল ইসলাম মাহমুদ, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী, . হাসান মাহমুদ উল্লেখ্য।

নগর সরকারের ধারণা

. মেয়র সিটি গভর্নমেন্ট অনিবার্যভাবে ভোটারদের দ্বারা সরাসরি নির্বাচিত হবেন। তিনি হবেন প্রধান নির্বাহী। তিনি নীতি নির্ধারণ, সিটি গভর্মেন্টের এক্সিকিউটিভ শাখা তদারক, প্রশাসক কার্যক্রম চালানোর জন্য সিটি ম্যানেজারকে সহায়তা করবেন।

. সিটি কাউন্সিল: চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের আর্টিকেল ২৯/১৯৮২ সংশোধন করে ৪১ জন কাউন্সিলর নিয়ে সিটি কাউন্সিলর গঠিত হবে। সকল উন্নয়ন প্রকল্প, এন্যুয়াল বাজেট সিটি কাউন্সিলর পাশ করবে।

. ন্যায়পাল নিয়োগ : সিটি কাউন্সিলের গরিষ্ঠ ভোটে একজন ন্যায়পাল (ওমবাডসম্যান) নিয়োগ করবেন। ডিপার্টমেন্টের রেকর্ডস, শপথ অনুষ্ঠান পরিচালনা, যেকোনো তদন্ত তিনি পরিচালনা করবেন।

. এডমিনিস্ট্রেটিভ কাউন্সিলএকটা সেকশন থাকবে।

. সিটি ম্যানেজার: বর্তমানে নিযুক্ত চিফ এক্সিকিউটিভ অফিসার, সচিব কার্যক্রম পরিচালনা করেন। ট্রান্সফারেবল এই পোস্টের কারণে উন্নয়ন কার্যক্রম ব্যাহত হয় এবং আন্তরিকতার অভাব থাকে। মেয়র একজন সিটি ম্যানেজার নিয়োগ করবেন। মেয়রের নির্দেশক্রমে তিনি মেয়রের সচিবালয়, রেকর্ড কিপিং সংগ্রহ করবেন।

. নতুন ডিপার্টমেন্ট সৃজন: বর্তমানে এক্সিস্টিং ডিপার্টমেন্টসমূহ ছাড়া সিটি ডুয়েলার সার্ভিস, এনভায়রনমেন্ট প্রটেকশন, ইন্টারনাল অডিট ইত্যাদি ডিপার্টমেন্ট খোলা যেতে পারে। সিটি গভর্নমেন্টের মেয়র ১৫টি মন্ত্রণালয় এবং ৩২টি ডিপার্টমেন্টকে আন্ডারওয়ান আমব্রেলা সার্ভিসে আনবেন।

. সিটি পুলিশ: করপোরেশন এলাকায় সকল পুলিশকে সিটি পুলিশ সার্ভিসে অন্তর্ভুক্ত করে নিয়ে আসতে হবে। বাদবাকিরা সেন্ট্রাল গভর্মেন্টের অধীনে থাকবে।

. ‘ওয়াসা, সিপিএ সংশ্লিষ্ট সবাই সিটি গভর্মেন্টকে ট্যাঙ জমা দেবেন। এর ফলে কেন্দ্রীয় গ্রান্টের উপর নির্ভরতা ক্রমান্বয়ে হ্রাস পাবে। সিটি গভর্নমেন্টের পরিবর্তন আনতে হলে চসিক আইন ১৯৮২ এর ২৭(বি), ১৯৫৪() এর পরিবর্তন করতে হবে। বিশেষ করে ‘২৭(বি)’ সরকার কর্তৃক নিয়ন্ত্রিত প্রতিষ্ঠান/সার্ভিসের ব্যবস্থাপনা সিটি গভর্নমেন্ট দ্বারা নিয়ন্ত্রিত হবে।’ এভাবে প্রতিস্থাপিত হবে।

মেয়রের চেয়ারে বসার সময় ডা. শাহাদাত হোসেন বলেছিলেন, ‘তিনি যখন করপোরেশনের চেয়ারে থাকবেন তখন তিনি ‘নোপার্টিজান’। তিনি এসি’র মানুষ নন, মাটির মানুষ। ইদানীংকালে তাকে অতিরিক্তভাবে মিটিং সেমিনারের উদ্বোধন, সামাজিক অনুষ্ঠানে দেখা যায়।

প্রিয় মেয়র আপনি বলেছেন, ‘সময় কম কাজ বেশি।’ তাই এগুলো কমাতে পারেন। ৪১ ওয়ার্ডের নির্বাহীদের একটি স্কুল, একটি ক্লিনিক, একটি সড়কের অগ্রাধিকার ভিত্তিতে উন্নয়নের দায়িত্ব দিন।

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের লাইব্রেরি, থিয়েটার ইনস্টিটিউট, প্রিমিয়ার বিশ্ববিদ্যালয় দক্ষ জনবল ও ইনোভেটিভ আইডিয়া নিতে পারেন। তাহলে গ্রিন সিটি, ক্লিন সিটি, হেলদি সিটির পাশাপাশি কালচারাল সিটিও গড়ে উঠতে পারে।

তথ্যসূত্র : তোফায়েল আহমেদ, এলজিআরডি এক্সপার্ট; ইঞ্জিনিয়ার এ এ এম জিয়া হোসেন, সাবেক সদস্য, বেপজা

চট্টগ্রাম সিটি করপোরেশনের ১৯৮২ সালে অর্ডিনেন্স; ইঞ্জিনিয়ার এম আলী আশরাফ, সাবেক উপউপাচার্য, সাউদার্ন ইউনিভার্সিটি।

লেখক : সাবেক সচিব ও প্রধান নির্বাহী, চট্টগ্রাম চেম্বার ও উন্নয়ন গবেষক

পূর্ববর্তী নিবন্ধবিজয়ের আনন্দে বেদনাও মিশে একাকার
পরবর্তী নিবন্ধস্নেহ বালা চৌধুরী